বাংলা খেয়াল : সত্যকিঙ্করের স্বপ্ন আর সুমনের লড়াই

“গাঙুরের স্মৃতিস্রোত বয়ে আনে গান/অন্ত্যজ বাংলার কলিজার জান।/আমি সেই চণ্ডাল মরদ তোমার/আমার ঘরণী তুমি মেয়ে বাংলার।/ওলাবিবি মনসার কাব্য এখানে/পীরের দরগা আছে আমাদের গানে/বনবিবি পালা আর সুরেলা আজান/অন্ত্যজ বাংলার কলিজার গান।”

সাম্প্রতিক এই বন্দিশের অক্ষরমালা চোখে ভাসতেই কোনো এক ভোর রাতের কল্পনা করছিলাম। নামজাদা ওস্তাদ বা পণ্ডিত গাইছেন, গেয়েই চলেছেন। শ্রোতারা বিভোর। ক্রমশ কল্পনা জুম হলে খটকা লাগে। কল্পনাট্যে ছেদ পড়ে। উপমহাদেশের অন্তরে আজও বয়ে চলে যে রাগরাগিনীর ধারা, সে ধারায় ভাষা পুষ্ট হয়৷ ভালবাসা ও নিষ্ঠায় তা ধারণ করলে হয় চারণক্ষেত্র। না, এ কল্পনার শেষে কোনও বাঙালি নামজাদা শাস্ত্রীয় সংগীতের কুশীলব উচ্চারণ করে উঠতে পারলেন না কৌম বাংলার বন্দিশ।

সময়টা হিন্দি আগ্রাসনের। রেকর্ড, ক্যাসেটের দশকগুলি পেরিয়ে, জামগাছ বা লাইটপোস্টের চোঙা-মাইক এখন অতীত। কানে গোজা হেডফোনটিতে একা মানুষের বিনোদন। লিরিকে, বন্দিশে, সংলাপে কোন ভাষা বাজে? জানা হয় না। শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা জানান দেয় - হিন্দি বন যাও। কৌমযাপন, লোকজমির চাষাভুষোদের লং শটে ধরে আলতো গেরুয়া ডিসলভ। হিন্দি ইন, বাংলা আউট। বিন্দুমাত্র হিন্দি বলতে না পারা গাইয়ে – ঠোঁটস্ত করে নেন হিন্দি বন্দিশ। তারপর রাগের স্রোতে ভেসে চলে কথা।

সেই কবে জমিদারের আয়েসি কক্ষে তান ধরলেন লখনউয়ের গাইয়ে, আজ বাংলা মুভিজের সুচিন্তিত চিত্রনাট্যে উচাঙ্গ সঙ্গীতে উচ্চে ওঠা গল্পে বন্দিশ নামে হিন্দিতে। উচ্চ জাত, উচ্চ বংশ, উচ্চ সঙ্গীত! তোমার ভাষা কোথায় কৌম? কোনজন জিজ্ঞাসিবে? জানা নেই, আমরা শুধু জেনে নেবো,  মেঘে ঢাকা তারা মানে - হংসধ্বনি। যার উচ্চাঙ্গে বাংলা নেই। যেমন চর্যাপদের প্রান্তদেশে উড়িয়া বা অসমীয়া পায় ধ্রুপদের তকমা। মধ্যভাগের ভূখণ্ডে অবহেলা বা আত্মবিস্মৃতি!

আরও পড়ুন
'এক বিশ্ব সুমন', ১৯ সেপ্টেম্বর গানওয়ালার প্রথম ডিজিটাল কনসার্ট

আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা খেয়ালের স্বপ্ন দেখেছেন। চেষ্টা করেছিলেন খুব। আমলাময় আকাশবাণীকে বোঝাতে বোঝাতে দিন আচার্য সত্যকিঙ্করের কাবার। বাংলাদেশের আজাদ রহমান বরং খানিক বাংলা ভাষায় গাঁথলেন রাগ। তবু তা যথার্থ নয় ! ভাষা দিবস, ভাষা মূর্ছনা, ভাষা যাপনে দশকের পর দশক পার করা বঙ্গজরা বাংলা-বন্দিশে মজে না। আর ধ্রুপদী সংগীতও থেকে যায় উচ্চকোটির অঙ্গশোভা হয়ে। বাংলা ভাষার নিকানো উঠনে ভীষ্মলোচন রাগরাগিণী আজ গাইছেন বটে, তবে তা বাংলা কাব্যিকতা দূরে রেখেই।

কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরল বা অন্ধ্রপ্রদেশের মন্দিরে রাগরাগিণীর চর্চা হয়। আজও হয়। কোন ভাষায়? না, হিন্দিতে নয়। মাতৃভাষায়। আর হিন্দি চাপিয়ে দেবার আগ্রাসন দেখা দিলে – রাগে আজও প্রচণ্ড হয়ে ওঠে দক্ষিণ। এই তো বৈচিত্রের পক্ষপাত। আপন মনের মাধুরীতেই গোদাবরী আর কাবেরীর পথে বয়ে যান তানসেন।

আরও পড়ুন
ও পারে সুমন, এ পারে আমরা, মেলাবে ডিজিটাল কনসার্ট

কবীর সুমন আচার্য সত্যকিঙ্করের স্বপ্ন দেখেন। আজাদ রহমানের কল্পনায় ঠেস দেন। বিশ্বাস করেন – বাংলাভাষা খেয়ালের ভাষা। বাহাত্তুরে প্রাত্যহিকতায় স্মৃতির সুরে খুঁজে বেরান রোজকার বাংলা শব্দ। না, তাতে পুরাণের গল্পগাছা নেই। নেই জমিদার বাড়ির ঝাড়বাতিখানি। খোঁজ আছে কৌম কথার, কৌম ভাবের। যে কৌম যাপন ভেঙ্গে বৈচিত্রহীন উত্তুরে কঠোর হিন্দুত্ব চাপিয়ে হিন্দুস্থানি লোকজন বলছেন – বন্ধ করো বাংলা, হিন্দি পাকড়ো। না, হিন্দি ভাষার সঙ্গে সে অর্থে এই কলমচির বিরোধ নেই। তবে এই চাপিয়ে দেবার বিরোধিতা থাকবে। আর সেখানেই বাংলা খেয়ালের সঙ্গে থাকবে – স্বচেতন পক্ষপাত। বাংলা আধুনিক গানের অভিমুখ নির্মাণ করা কারিগর, তা তিনি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হন বা হিমাংশু দত্ত বা সলিল, হাজারো সুরের ধারায়, পরিবেশনের মেজাজে গড়ে তুলেছেন বাংলা গান। সুমন সে কাজের – আধুনিকতম সংযোজন। বিরলও। আরবান, বিশ্বায়িত সমকালীন হবার পথে তার গান ঠেস দিয়েছে – লোকায়ত সুর ও রাগরাগিণীতে। না, রাগপ্রধান নামক ব্রাকেটে নয়, বরং প্রবাহমান স্বাভাবিকতায়। জাগে জাগে রাত বা সূর্যোদয়ের রাগে গান ধরে ভীমসেন যোশী – তরুণ শ্রোতার শহুরে কানে দেয় হাজার বছরের আবেশ। এই সুমনই দাবি করেন – বাংলা খেয়ালের ভাষা। তাঁর দাবি সৃষ্টিতে বদলালে – টাইম লাইনে ডাক পান বাংলা খেয়ালের স্বপ্ন দেখা আচার্য সত্যকিঙ্কর স্বয়ং।

এ লেখার শেষে অতীত বর্তমান পেরিয়ে, অদূর ভবিষ্যতে কোনো বাঙালি পণ্ডিত বা ওস্তাদের কণ্ঠে বাংলা খেয়াল গাইতে দেখা দুষ্কর। হিন্দুস্তানি কালোয়াতি সঙ্গীতের নামজাদা প্রাতিষ্ঠানিকরা জানেন, খেয়াল আসলে হিন্দুস্থানি। যে ভাবে ইংলিশ মিডিয়াম জানে বাংলা মানে বেঙ্গলি। এই ভাষা আগ্রাসনের সময়ে ভাষা সৈনিক না হলে, সে কণ্ঠে খেয়ালের ভাষা হবে না লালন বা জীবনানন্দের ভাষা। তাই, বাংলা খেয়ালের ভবিষ্যৎ জানি না। শুধু জানি, বৈষ্ণবঘাটা বাই লেনে প্রবীণ এক, রাগ গুনগুন করেন আর খুঁজে ফেরেন বাংলা বন্দিশ।

আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত প্রেমে মিশে গেল কলকাতাও, ঝড়ের বেগে ‘তোমাকে চাই’ লিখলেন কবীর সুমন

Powered by Froala Editor