শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবি। শুধু কবি নন, বাংলা কবিতার ভাষাকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কেউ যদি বলে, আসলে কবিতা বলে তিনি যা লিখেছেন, সেসবই গান! এমনটাই বলেছিলেন কবীর সুমন। তাও আবার খোদ কবিকেই। সোমবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে 'উড়ালপুল সাহিত্য সম্মাননা ২০২০' অনুষ্ঠানে সেই গল্প বলেছিলেন কবীর সুমন।
এবারের শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার তুলে দেওয়া হল কবীর সুমনের হাতে। সেই পুরস্কার নিতে গিয়েই স্মৃতির তর্পণ করছিলেন তিনি। গলার স্বর কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল, খানিক বয়সের ভারে আর খানিক স্মৃতির আচ্ছন্নতায়। সুমন যখন কলেজে পড়তেন, শক্তি-সুনীল তখন বাংলা সাহিত্য জগতের কিংবদন্তি। কবিকে সেভাবে কাছ থেকে পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। পেয়েছিলেন একবারই। তখন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানের সুরে, কথায় একটু একটু করে বুঁদ হচ্ছেন বাঙালি। তাঁর নিজের তখন ফোন নেই। বাড়িওয়ালার ফোনে একদিন ফোন করেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে কবি নাকি বলেছিলেন, "যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পদ্য লেখে সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়।" এভাবে পরিচয় দিতে তো তিনিই পারেন!
তারপর একদিন শক্তি নিজেই চলে এসেছিলেন সুমনের বাড়ি, এক বন্ধুর অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আবদার নিয়ে। হঠাৎ এসে উপস্থিত হওয়ায় আশ্চর্য হয়েছিলেন সুমন। তবে কবি নিজে নাকি বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সুমনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, "আপনাকে সবাই ভয় করে।" সুমন বললেন, "আপনি ভয় করেন না?" শক্তি বলেছিলেন, "না"।
এভাবেই আলাপ শুরু দুই কিংবদন্তির। যাঁদের একজন বাংলা কবিতার ভাষাকে পাল্টে দিয়েছিলেন, আর অন্যজন পাল্টে দিচ্ছিলেন বাংলা গানের ভাষা। কথায় কথায় সুমনকে শক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি নিয়মিত লেখেন, না?" সুমন জানালেন তিনি রোজ লেখেন। অস্বস্তি প্রকাশ করে শক্তি বলেছিলেন, "আমার রোজ লেখা হয় না, জানেন!" এভাবেই কিছুক্ষণের মধ্যে আলাপ জমে ওঠে। তখন হঠাৎ সুমন বলে বসলেন, "কিছু মনে করবেন না। আপনি না, ঠিক কবি নন।" শক্তি বললেন, "হ্যাঁ, আমি পদ্য লিখি।" সুমন আরও জোর দিয়ে বললেন, "না, আপনি একজন গীতিকার।" স্বভাবলাজুক শক্তি সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু সুমন ছাড়বেন কেন? তিনি পড়তে শুরু করলেন,
"দু এক পশলা বৃষ্টি পড়ছে গাছের ও কদমের শাখায়
আমার উড়নচণ্ডী চলা থামবে নাকি ভিজলে পাখা..."
শুনতে শুনতে কবির চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, "এগুলো কবিতা না?" সুমন বলেন, না এটা গান। একধার থেকে তাঁর সব লেখাই নাকি গান। কয়েকটা কবিতা। যেমন উদাহরণ দিয়েছিলেন, "ডালে ডালে পুষ্প তুমি নষ্ট হও"। বলেছিলেন, "এর মধ্যে গান নেই।"
সুমনের কথায় আগ্রহ পেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সুমন বলেছিলেন, গীতবিতান দেখে একটু গানের দৈর্ঘ্যগুলো খেয়াল করলেই অনায়াসে তিনি গান লিখতে পারবেন। আর বলেছিলেন, "পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস" এরকম শব্দবন্ধ যেন না লেখেন। এগুলো বড্ড কবিতা। এতে সুর হয় না। কীভাবে গান লেখা হয়, আরও খুঁটিয়ে বুঝে নিতে চাইছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সুমন তাঁকে বললেন মোহিনী চৌধুরীর কথা। কবি বললেন, তিনি নাম শুনেছেন কিন্তু গান শোনেননি। সুমন বললেন, অবশ্যই শুনেছেন। 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে' এবং 'জেগে আছি কারাগারে'র কথা বলাতে কবি বললেন, "এগুলো ওঁর লেখা, না? পড়তে হবে।"
শেষ বয়সে এসে নতুন কিছু লিখতে চাইছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সুমনের কথায় আগ্রহ পেলেন। লিরিক লেখার কাজে হাত দেবেন বলেছিলেন। তাঁর পুরনো লেখার শব্দশরীর তখন সুরারোপের অপেক্ষায়। কিন্তু শক্তি পূর্ণাঙ্গ লিরিক লেখার কথাই ভাবলেন। আর সুমন দায়িত্ব নিলেন সেইসব লেখায় সুর দেওয়ার। সেইদিন আরও অনেক কথাই হয়েছিল দুজনের। কিন্তু তার কিছুদিনের মধ্যেই সব কথা নিভে গেল। 'শব্দের ঝর্ণায় স্নান' অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখায় সুর দেওয়ার প্রক্রিয়াও আর এগোয়নি। শক্তির মৃত্যুর পর, সুমন লিখলেন – ‘ঘুমোও বাউণ্ডুলে, ঘুমোও এবার।’
এই স্মৃতিচারণার সূত্রেই প্রশ্ন এসে পড়ে, কোথায় সীমানা টানব গান আর কবিতার? সেই বিতর্ককেই আরো উস্কে দিয়ে যায় উড়ালপুল পত্রিকা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার এতদিন দেওয়া হত উল্লেখযোগ্য কবিদের। সেই তালিকায় এবার গীতিকার কবীর সুমন। অনেক বাঙালিই তো তাঁকে কবি মনে করেন। কিন্তু সুমন সেকথা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, কবিতা আর গানের ধর্ম আলাদা। তিনি কবি নন।
কিন্তু মহাভারতের কাহিনি থেকে কালিদাস যখন 'শকুন্তলা' লিখলেন একটি পূর্ণাঙ্গ বাচিকশিল্প হিসাবে, তখন তাঁকে কী বলা যায়? গান না কবিতা? সেই ট্র্যাডিশনেই তো সুমনের প্রত্যেকটা গান আসলে একেকটি নিখুঁত কাব্যশিল্প। মানপত্রে সেই ট্র্যাডিশনের কথাই বলেছেন উড়ালপুলের সম্পাদক গৌতম দত্ত। তবে অনেক কবিতার ভিতরেই যে গান লুকিয়ে থাকে, একথা স্বীকার করেন কবীর সুমন। তেমনটাই ছিল শক্তির কবিতায়। সেইসব গানের শব্দশরীর সুরের ছোঁয়া পেল না শুধু।