মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুর্গাপুজোয় প্রচলিত ছিল নরবলি; এখনও রয়েছে তার প্রতীক

হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম পাটুলি। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই সামান্য নিম্নবিত্ত কৃষিজীবী। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর কেউ উৎপন্ন করেন ধান, কেউ বা শাকসবজি। কেউ আবার পেটের দায়ে বেছে নিয়েছেন ভাগচাষির জীবিকা। তবে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ই পাটুলি গ্রাম অন্য একটি কারণে হয়ে উঠেছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মদনমোহন তর্কালঙ্কার এক সময় এই গ্রামে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম ডাকসাইটে সমাজ সংস্কারক আবার অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকও।

এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিধবা বিবাহ। যেখানে পাত্র ছিলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কালিমতী। এই পাত্র-পাত্রীর পরিচয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। কথিত আছে, পাটুলী গ্রামে থাকাকালীন এক রাতে মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান মদনমোহন। তাঁর সেই স্বপ্নাদেশের ভিত্তিতেই শুভারম্ভ ঘটে দুর্গাপুজোর। যে দুর্গাপুজোর আয়োজনে এখনও বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।

পাটুলি গ্রামের জমিদারের অনুমতিক্রমে মদনমোহন তর্কালঙ্কার শুরু করেন এই দুর্গাপুজো। এই গ্রামের দুর্গামূর্তিও অদ্ভুত। গাত্রবর্ণ শিউলি ফুলের মতো, তার দশটি হাতের পরিবর্তে রয়েছে দুটি হাত। শোনা যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে দেবী দুর্গা স্বপ্নে এসে আদেশ দেন তিনি দশ হাতের পরিবর্তে দুহাতে খাবেন। সেই থেকেই হুগলির এই প্রত্যন্ত গ্রামের মূর্তি দুহাতের। এমনকি এই গ্রামেই দেবীর ডানদিকে কার্তিক এবং বামদিকে গণেশ বিরাজমান। 

তবে এ তো গেল শুধুমাত্র মূর্তির বিবরণ। সব থেকে আশ্চর্যের কথা হল, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতো সমাজ সংস্কারক যে দুর্গাপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেই দুর্গাপুজোতেও একসময় নরবলি হত প্রতিবছর মহাষ্টমীর রাতে। যদিও বর্তমান সময়ে বন্ধ হয়েছে এই অমানবিক প্রথা, কিন্তু প্রতীকী নরবলির প্রচলন আছে আজও। বর্তমানে চালের পিটুলি দিয়ে তৈরি করা হয় একটি পূর্ণাকৃতি মানুষ। বলি দেওয়া হয় সেই মানবাকৃতির চালের পিটুলিকেই। 

এবার যাওয়া যাক গড়জঙ্গল এলাকায়। অজয় নদের একপ্রান্তে গড়জঙ্গলে ঘন জঙ্গলের মধ্যে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি দুর্গামন্দির। হুগলির অখ্যাত গ্রাম পাটুলিতে যেমন দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তেমনই গড়জঙ্গলের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে প্রেমের কবি জয়দেবের নাম। তবে সে বিবরণ পরে, তার আগে গড়জঙ্গলের ইতিহাস কিছুটা বলে নেওয়া যাক।

গড়জঙ্গল এলাকায় ইছাই ঘোষের হাতে সূচনা ঘটে দুর্গোৎসবের। কথিত আছে কোনো একদিন ইছাই ঘোষ লাউসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার তোড়জোড় করছিলেন, এমন সময় ইছাই ঘোষকে দেবী দুর্গা স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে নিষেধ করেন সেদিন যুদ্ধে যেতে। কিন্তু ইছাই ঘোষ সেই নিষেধ অমান্য করে যুদ্ধে গেলে লাউসেনের হাতে নিহত হন নির্মমভাবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা অনুযায়ী, এখনও মহাষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর আগের মুহূর্তে তিনবার তোপধ্বনি শোনা যায় জঙ্গলের মধ্যে থেকে। তারপরেই শুরু হয় এই অঞ্চলের সন্ধিপুজো। তবে এখানেই শেষ নয়। স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন ভবানী পাঠক দেবী চৌধুরানীকে গড়জঙ্গলের এই দুর্গামন্দিরেই সাধন-ভজনে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন।

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো ‘বনাম’ রামলীলা : যোগী সরকারের ফরমান কি বাঙালি-বিদ্বেষেরই প্রতিফলন?

প্রেমের কবি জয়দেবের কাহিনি দিয়েই শেষ হোক এই প্রতিবেদন। গড়জঙ্গল দুর্গামন্দিরে কোনো একসময় এক কাপালিক শুরু করে নরবলি। তার স্থির বিশ্বাস ছিল নররক্তে দেবী দুর্গা তুষ্ট হন। এই খবর যায় কবি জয়দেবের কাছে। তিনি কি এই খবর পাওয়ার পর স্থির থাকতে পারেন? জয়দেব একদিন দেখা করেন সেই কাপালিকের সঙ্গে। তিনি তাকে বলেন, নরবলির মাধ্যমে যে দেবী দুর্গা তুষ্ট হন একথা তিনি বিশ্বাস করেন না। এই শুনে সেই কাপালিক রাগের বশে কবি জয়দেবকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন, নররক্তে হাত রাঙানোর কারণেই নাকি দেবী তার ওপর খুশি হয়ে তাকে তাঁর প্রকৃত রূপদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছেন। এই শুনে জয়দেব বলেন তিনিও দেবীর প্রকৃত রূপ দেখতে আগ্রহী। কিন্তু কাপালিক যদি ব্যর্থ হয় তবে মন্দির প্রাঙ্গণে নরবলি তাকে চিরদিনের মতো বন্ধ করতে হবে। কাপালিক এই শর্তে রাজি হয় কিন্তু বহু চেষ্টার পরেও পাথরের দুর্গামূর্তির মধ্য থেকে দেবীর প্রকৃত রূপদর্শনের সুযোগ হয়নি জয়েদেবের। তখন পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো কাপালিক গড়জঙ্গলের দুর্গা মন্দিরে নরবলি বন্ধ করে দেন।

একদিকে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মতো আধুনিকমনস্ক মানুষ থাকার পরেও রমরমিয়ে চলে এসেছে নরবলির মতো নারকীয় প্রথা। অন্যদিকে জয়দেবের হাতেই বন্ধ হলো এই মধ্যযুগীয় নৃশংসতা। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলার মাটি সাক্ষী ছিল এমন হাজারো ঘটনার।

তথ্যসূত্রঃ
১। গভীর অরণ্য থেকে ভেসে আসে তোপধ্বনি, শুরু হয় মায়ের পুজো, শিবশঙ্কর ভারতী, নীলকণ্ঠ
২। অর্ধরাত্রির পুজোয় নরবলি হত মঠবাড়িতে, এখন খবর

আরও পড়ুন
অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি?

Powered by Froala Editor

More From Author See More