‘আমায় যে হত্যা করেছিল সে তোমাদের মধ্যেই আছে!’

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৪

আগের পর্বে

ভৌতিক গল্পে কুকুর-বেড়ালের মতো চতুষ্পদরাও এসেছে অশরীরীর বেশে। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘খোদা জমিন’ এমনই এক গল্প। লিখতে চেয়েছিলেন ঐতিহাসিক উপাখ্যান কিন্তু তার বদলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়াল সাহিত্য। একটা কুকুর আর বিড়াল যেখানে ঘৃণ্য দৃষ্টি নিয়েই তাকিয়ে থাকে প্রধান চরিত্র হিকমতের দিকে। তবে বাকিদের কাছে সে অদৃশ্য। প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখাতেও এসেছে ‘কালো বিড়াল’-এর মোটিফ। শরদিন্দু দেখিয়েছেন, নিজ-প্রাণ দিয়ে কুকুর রক্ষা করছে মনিবকে। আবার এই দৃশ্যই বদলে গেছে প্রবোধকুমারের লেখায়। সেখানে মৃত্যুর পর ‘কুকুর-দানব’ স্বয়ং প্রভুভক্ত পোষ্য সারমেয়।

উইলিয়ম পিটার ব্লেটি ১৯৭১ সালে একটি উপন্যাস লেখেন, নাম হচ্ছে ‘একজরসিস্ট’, যা দ্রুত ‘কাল্ট’ হয়ে উঠবে এবং ফেটে পড়বে তার খ্যাতি। মার্কিন মুলুকের একটি বালিকা রেগান-কে ভর করেছিল প্রত্নযুগের ‘অশুভ সত্তা’।  বয়স খুব জোর বারো... হলে কী হবে, রেগান অতি দ্রুতই একজন ভীতিকর ব্যাক্তি হয়ে ওঠে, গলার স্বর তার হয়ে যায় পুরুষের, চোখের মণি ভরে ওঠে কটা রঙে, ডাক্তার চিকিৎসা করলে গেলে সে কুৎসিত গাল পাড়ে, এমনকি... ‘খপ করে অন্ডকোষ চেপে ধরে’ এবং আর্তনাদের কারণ হয়। - রেগানকে অশুভের ভর থেকে কী ক’রে ঝাড়ানো হবে – সেই গল্পই ব্লেটি লিখেছেন তাঁর বইতে, উইলিয়ম ফ্রিডকিন যাকে অমর ক’রে রাখেন সেলুলয়েডে।  

উইলিয়ম পিটার ব্লেটি (১৯২৮-২০১৭),‘একজরসিস্ট’-এর লেখক

 

খুঁজে দেখছি বাংলায় ‘একজরসিস্ট’ লেখা হয়ে গেছে। ১৪০৭ বঙ্গাব্দের ‘শুকতারা’ শারদীয়া সংখ্যায় ‘রহস্যময় রোগী’ নামে নভেলা বেরোয়, লেখেন মানবেন্দ্র পাল, ফি বছর ভয়ের কাহিনিই তিনি লিখতেন ‘শুকতারা’র পাতায় এবং সেগুলির জাত ছিল ‘গথিক হরর’ কিংবা ‘সুপারন্যাচারাল হরর’। ‘রহস্যময়...’ নভেলায় ছায়া ফেলে আছে তিনশো ষাট বছরের পুরোনো অভিশাপ। এখানে ‘রেগান’ হচ্ছে রাজবাড়ির পালিতা কন্যা ‘অম্বুজা’, এগারো বছর বয়েসেই যে কথা বলে কর্কশ পুরুষালি স্বরে, পাক্কা বড়দের ভাষায়, চোখের রঙ তারও কটা, শহরের ডাক্তার এলে সে ক্ষেপে ওঠে ও  উদ্যত হয় ক্ষতিসাধনে। 

এবং শীঘ্রই... ডাক্তার জানছেন একটা বিচিত্র তথ্য। অম্বুজার অবসেশন হল ‘দাঁড়কাক’ পোষা,   ত্রিশ চল্লিশটা কাক সে খাঁচায় পুরে রাখে, যারা এরপর হামলা করবে ডাক্তারকেই – সেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়াল ও মরিয়া-ঝাঁপ ফ্রেম টু ফ্রেম মিলে যায় সাসপেন্স সম্রাট আলফ্রেড হিচককের ১৯৬৩ সালের ছবি – ‘দা বার্ডস’-এর সঙ্গে।

আরও পড়ুন
কুকুর-দানব, ভূতুড়ে বাড়ি, নরকের কবিতা

আলফ্রেড হিচকক (১৮৯৯-১৯৮০), সাসপেন্স গল্পের গুরু, ‘দা বার্ডস’ ছবির নির্মাতা

 

ব্লেটির গল্পে ‘একজরসিস্ট’ বা ‘রোজা’র দায়িত্ব নেন নাস্তিক পাদ্রী ও মনোচিকিৎসক ডমিয়েন কারাস এবং তাঁর সিনিয়ার পাদ্রী বৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক ল্যাংকেস্টার মেরিন; ভূত ছাড়ানোর শেষে তাঁরা কেউই বাঁচেননি। ...নাছোড় জেদে অম্বুজা-রহস্যের শেষ অবধি দেখতে চান ডাক্তার আর সেই চাওয়াই তাঁকে এক নরকে টেনে আনে... নিশুত রাতে পলাতকা রোগিণীর পিছু নেন তিনি, অতীতের শ্মশান ব’লে কুখ্যাত পরিত্যক্ত পশ্চিমের চরায় এক বিকট অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। প্রাণে  বেঁচে যান কিছুটা দৈবে ও এক পাগলী বুড়ির দয়ায়, যে বুড়ি তাঁকে খুলে বলে অম্বুজার সমস্ত রহস্য, যাকে... ‘কিন্তু আপনি তাহলে কে?’ শুধোতেই হাসির সঙ্গে খোনা গলায় জবাব আসে, ‘তিনশো বছর ধরে আমি এখানে আছি। লোকে আমায় বলে ডাইনি। জমিদার খেদিয়ে দিলে আমাকে। তবু রয়েছি... নইলে প্রেতদের ঠেকাবে কে?’


আরও পড়ুন
‘হলুদপোড়া’... ভূতের ‘ভর’ নাকি যৌন বিকারের ভয়াল দৃষ্টান্ত?

এই গল্পে রোজা তাহলে ‘ডাক্তার’ আর ‘ডাইনি’ – দুজনেই। অম্বুজার ওপর চেপে-বসা অশুভ আত্মা তাকে ছেড়ে গেলে নিষ্পাপ কন্যা ঘুমিয়ে থাকে – ব্লেটির উপন্যাসেও মিষ্টি সরল রেগানকে আমরা ফিরে পাই, শয়তানের কাছে ‘পরাজিত’ দুই পাদ্রী নিজেদের জীবনের মূল্যে তাকে ‘সুস্থ’ করেছেন। 

মানবেন্দ্র পাল (১৯২৬ – ২০১১)

ভয়ের কাহিনি লেখায় মানবেন্দ্রবাবু সর্বদাই ডিস্টিংশন পাবেন কেননা এই ব্যাপারে তাঁর মতো নিরবচ্ছিন্ন লেখক আমাদের বাংলাতে প্রায় নেই। কখনোই তিনি কৌতুক ক’রে ভূতের গল্প লেখেন না, বরং... ফি কাহিনিতেই আনেন ম্যাকাবর রস। যা পড়লে গা শিরশির করবে, অস্বস্তি হবে; যেখানে বহাল থাকে আদিম যক্ষের সঙ্গে তুল্য একটি ব্যক্তি - সাক্ষী ও রক্ষক, (‘পাথরমহল’ নভেলায় যেমন মুকুন্দ দুশো বছর ধরে পাহারা দেয় অভিশপ্ত নীলকুঠি); বারম্বার যেখানে আসে প্ল্যানচেট-প্রসঙ্গ (‘খুনী’ গল্পে আহুত বিদেহী আহবানকারীদের জানিয়ে যায় ‘আমায় যে হত্যা করেছিল সে তোমাদের মধ্যেই আছে!’) এবং অপদৈবিক শক্তির প্রসঙ্গ (‘পাথরমহল’-এ পাচ্ছি অসভ্য জাতির কুকুর-দেবতা ‘সারমেয়রাজ’-এর কথা, যিনি ক্ষুধার্ত হলে গর্জন করেন আর কামনা জানান শিশু-রক্তের), কখনো পুরাকাহিনি থেকে চরিত্রদের তুলে আনা হয় সমকালে। 

আরও পড়ুন
সমাজে প্রেস্টিজ বজায় রাখতে আত্মহত্যা করেছিল সেই ভূত!

পুরোনো শারদীয়া ‘শুকতারা’-র পাতায় ‘ম্যাকবেথের তরোয়াল’, ইলাস্ট্রেশন 

 

...‘ম্যাকবেথের তরোয়াল’ শেষটির চমৎকার দৃষ্টান্ত। স্কটিশ সেনাপতি (পরে রাজা) ম্যাকবেথের মর্মন্তুদ কাহিনি পাঁচশো বছর আগে বলে গেছেন উইলিয়ম শেক্সপিয়ার; সেই গল্পেরই হতভাগ্য নিহত চরিত্র ‘ব্যাঙ্কো’ আবার ফিরে আসে, মনুষ্যবেশে খুঁজতে থাকে ম্যাকবেথের মন্ত্রঃপূত তলোয়ার। অভিজিৎ ও জুলি, দু’জনেই জড়িয়ে পড়ে তার অনুসন্ধানে এবং পাহাড়ি অরণ্যে একটি প্রাচীন কক্ষের দেওয়ালে ‘Slaughter House’  শব্দদুটি তাদের চোখ ঘষে দেয় ( টকটকে লাল রঙে লেখা এবং তখনও তা থেকে রক্ত গড়িয়ে নামছে)। 


আরও পড়ুন
বৃক্ষের ‘ভূত’ও অমিল হয়নি আমাদের ভৌতিক সাহিত্যে!

লেখকের অনেকগুলি আখ্যান একত্রে পাওয়া যাবে ‘ভৌতিক অমনিবাস’ বইতে (প্রকাশক, ‘দেব সাহিত্য কুটির’)।  আগামী গবেষকদের কর্ষণের অপেক্ষা করছে একটি অনাদৃত অঞ্চল; আমাদের ভৌতিক কাহিনির ইতিহাসও এই সংকলনটি ছাড়া নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করতে রাজি নয়।  

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে সত্যি সত্যি এলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল... লিখছেন আশাপূর্ণা দেবী