‘প্রকৃতি রহস্য সহ্য করে না, যদিও সে নিজেই খুব রহস্যময়’

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৯
আগের পর্বে

অদৃশ্যের সঙ্গে কথোপকথন। হীরেন চট্টোপাধ্যায় ‘চোখের বাইরে’ গল্পে ‘মণিপিসি’ এভাবেই কথা বলতেন ‘তেনাদের’ সঙ্গে। বাড়ির অন্যেরা ভাবতেন স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত তিনি। একই থিম নিয়ে গল্প লিখেছিলেন শৈলেন ঘোষ। মৃত এক কিশোর সেখানে মূল চরিত্র। তাঁর গলা শুনেই ভয়ে কেঁপে উঠত লোকজন। কিন্তু কেন তাকে ভয় পাচ্ছে সকলে কিছুতেই বুঝতে উঠতে পারছে না সে। আবার গল্পে ভূতের করুণাবস্থা তুলে ধরেছেন মহাশ্বেতাদেবী। ধড় হারিয়ে ফেলায় সেখানে নিজেই আতঙ্কিত ভূত। ফলে মানুষের থেকে অবধারিত দাবড়ানি। খাঁটি ভূতের এই উদ্ভট ও অপরূপ হিউমর দেখা যায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সিগনেচার গল্প ‘ইঁদারায় গণ্ডগোল’-এ। কুয়োর তলায় লুকিয়েই সেখানে তাণ্ডব চালিয়ে যায় অশরীরী। শেষ অবধি জমিদারের পুরোহিত এসে হুংকার ছাড়েন, না বেরিয়ে এলে থুতু ফেলবেন তিনি।

এক রাতে ‘দা এক্সরসিস্ট’ অনুবাদ করেন হুমায়ূন আহমেদ, কারণ ছিল অর্থাভাব। সেই প্রসঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, ‘এখানে নাস্তিক পাদ্রী (ডোমিয়েন কারাস)-এর চরিত্রটি আমায় আকর্ষণ করেছিল।’ অতিপ্রাকৃত ঘটনার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন কারাস এবং সেই পথে বেশ কিছুটা এগিয়েও শেষ অবধি ব্যর্থ হন – লজিকের জগৎকে হাঁ-মুখ দুঃস্বপ্ন ভক্ষণ ক’রে নেয়। 

পাঠকেরা জানেন, এরপর ‘পেপারব্যাক সিরিজে’র প্রথম বইটি লিখতে অনুরোধ করা হলে হুমায়ূন সম্মত হবেন, লেখা হবে ‘দেবী’ - জনাব মিসির আলি-র প্রথম কাহিনি। আমেরিকান মনোবিদ, সদ্য-নিযুক্ত পাদ্রী, নাস্তিক, নিঃসঙ্গ ডোমিয়েন কারাস ভোল-পালটে দেখা দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টাইম লেকচারার (পড়ানোর বিষয় – অ্যাবনর্মাল সাইকোলজি), রুগণ, ব্যাচেলর, মধ্যবয়সী মিসির আলি হয়ে!    

তাঁরই কাছে এসেছিল একটি নতুন ‘কেস’। রূপসী, বিবাহিতা, অল্পবয়সী রানুর অসুস্থতা কি ক্লিনিকাল, না প্যারানর্মাল? রানুর বয়ানকে ভিত্তি ক’রে হাইপোথিসিস খাড়া করেন মিসির আলি যেখানে অতিপ্রাকৃতকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। ...ক্রমে, ‘তদন্ত’ আরো এগোলে, মিসির জানবেন রানুর জগৎ অর্ধেক যুক্তি ও অর্ধেক অযুক্তি দিয়ে তৈরি, যুক্তিশাস্ত্র বীরোচিত উপায়ে সফল ও করুণ ভাবে ব্যর্থ - একইসঙ্গে।   

ল্যাবিরিন্থ সদৃশ জোড়া রহস্য এই কাহিনিতে অল্পে অল্পে ছড়িয়ে গিয়েছে - রানুকে ঘিরে থেকেছে ‘দৈব’ উপস্থিতি এবং তারই প্রতিবেশী নীলুকে বেছে নিয়েছে অপরিচিত সুদর্শন ‘শয়তান’। ভূত নেই কিন্তু অশরীরী আছে – সত্যিই কি আছে? এই দ্বিধায় কাহিনিটি নিজে ভুগেছে এবং ভিত থেকে প্যারানোইয়া-র অতিকায় প্রাসাদ গেঁথে তুলেছে।  

‘দেবী’র সিকোয়েল হিসেবে লেখা হয় ‘নিশীথিনী’, এখানেও পূর্বের আলোআঁধারি অক্ষুণ্ণ থাকে। সাইকোপ্যাথ খুনির কাজকর্ম যখন মিসিরের যুক্তি পেড়ে ফেলেছে, তার ‘অমানুষিক’ উত্থানের জিগস পাজল মিলে গিয়েছে খাপে খাপে... নীলুর অদ্ভুত ‘অসুখ’ ও ‘দেবীত্ব’ সেই কাঠামোটিকে ভঙ্গুর করে দেয়, মৃতপ্রায় মিসির আলি অনুভব করেন অলৌকিককে; অপার্থিব সৌরভ, খিলখিল হাসি ও নুপুরের ধ্বনি পান টের। প্যারাডক্স হল এই হ্যালুসিনেশনের কাছেই তিনি আরোগ্য চাইছেন... ‘বড় কষ্ট! ...কষ্ট কমিয়ে দাও!’ এবং পর মুহূর্তে তাকে খণ্ডন করছেন, ‘তুমি কেউ না। আমার মন এখন দুর্বল, তুমি আমার উইশফুল থিংকিং! দেবী আবার কী!’  

পাঠক-সত্তাকেও এই মর্মে দুটি অংশে ছিঁড়ে ফেলা হয়, একটি ভাগ মিসির আলির মতোই বিশ্লেষণ-প্রবণ ও স্বচ্ছতাকামী – অন্য ভাগটি চায় রহস্য আরো ঘনিয়ে উঠুক, পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলুক! যেখানে দেবী হচ্ছে বাস্তব, সমস্ত ‘অস্বাভাবিক’ যখন সত্য। ...এটি হচ্ছে মনোভূমির সেই ফাইন লাইন – যা টানা হলে তিমিরবিনাশী ও তিমিরবিলাসী অঞ্চল আলাদা হয়ে যায়।

গোয়েন্দা গল্পে অশরীরীর স্থান নেই।  দুটি উপন্যাসকেই আমরা স্বচ্ছন্দে হরর ফিকশন বলে ডাকতে পারি। 

একই গোত্রের ফিকশন হতে-হতেও হয় না ‘বৃহন্নলা’, একটি গ্রোটেস্ক ভূতের গল্প এখানে ‘সমস্যা’ হিসেবে রাখা হয়েছে। মিসির আলি কীভাবে এই ভৌতিক-কে নাকচ করলেন বাকিটা তারই পরম্পরা। প্যারানর্মাল নয় বরং খাঁটি ডিটেকটিভ গল্প – রহস্য যখন সম্পূর্ণ উদঘাটিত, অতিপ্রাকৃতের আতঙ্ক বদলে গিয়েছে বিশ্লেষণের স্বস্তিতে। ‘হাউন্ড অব দা বাস্কারভিল’-এ যেমন দেখেছি, মহামহিম শার্লক হোমস ‘কিংবদন্তী’কে প্রকট করেন ব্যাখ্যাগ্রাহ্য ক’রে – ‘বৃহন্নলা’তেও সমান মোচড় লক্ষ করা গেছে। দুটি লেখাতেই অপরাধীরা নিজের কুকর্ম ঢাকতে ‘অশরীরী’কে খাড়া করেছে। 

গোর-দেওয়া মৃতদেহের জাগরণ হুমায়ূনের একটি প্রিয় প্রসঙ্গ, সায়েন্স ফিকশন ‘শূন্য’-এ উপকাহিনি হিসেবে আছে ‘কাফনের কাপড় চিবিয়ে খেয়ে নিচ্ছে শব’ এবং ‘ছায়াসঙ্গী’ গল্পে ‘কবরের অন্ধকারে অপর সত্তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে মৃত’। এই গল্পগুলিকে স্কেচ হিসেবে ধরলে  ‘কুটু মিয়া’ উপন্যাসকে পূর্ণাঙ্গ পেইন্টিং বলা যাবে।

কু-দর্শন, সেরা রন্ধনশিল্পী, অনুগত, বিনীত নফর কুটু মিয়াকে আমরা দেখছি বন্ধুত্বপূর্ণ অশুভ হিসেবে - মনিবের অনুরোধে যে শুনিয়েছিল নিজের মৃত্যু ও দাফনের কথা। গোরের ভিতর কেউ তাকে সঙ্গ দিত, জানাচ্ছে কুটু, যাকে সে চিনতে পারেনি। অনেক দিন কেটে গেলে, গোর থেকে উঠে কুটু গিয়েছে দেশান্তরে, পারঙ্গম হয়েছে রান্নায়, আশ্রয় নিয়েছে একাধিক মনিবের এবং সাক্ষী থেকেছে তাঁদের মর্মান্তিক মৃত্যুর। রিচুয়ালিস্টিক, অভ্যস্ত নিয়মে কুটু আসে একজনের জীবনে; এর পরিণতির কথা সে জানে আগে থেকেই; সবটাই তার মুখস্থ; এই চক্র থেকে তারও মুক্তি নেই।  

নিরাবেগ ও শুষ্ক গদ্য চলতে থাকে, যেমন কিনা কুটু মিয়া-র কণ্ঠ, নির্বিকার এবং স্বাভাবিক ...যার তুলনা হতে পারে সংবাদ পাঠের ভঙ্গি। অবলীলায় ও অবহেলায়, রুক্ষ দৈনন্দিন ঢাকা শহরে অপ্রত্যাশিত নরক তৈরি ক’রে ফেলেন হুমায়ূন... হরর ফিকশনের যিনি গ্র্যান্ডমাস্টার, শাহেনশা, একমেবাদ্বিতীয়।       

অজ্ঞেয় ও-পারে, নিশ্ছিদ্র রহস্যে, না-ফেরার দেশে তিনি চিরশান্তিতে থাকুন।

Powered by Froala Editor