লম্বা হাত বাড়িয়ে হজমের গুলি চেয়ে নিলেন ব্রহ্মদৈত্য

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৭

আগের পর্বে

রক্তপায়ী শিক্ষককে নিয়ে বাংলা ছায়াছবি সম্প্রতি সাড়া ফেলে দিয়েছে দর্শকদের মধ্যে। তবে বাংলা সাহিত্যে বহু আগে থেকেই ছিল এই সংস্কৃতি। সৌজন্যে অনীশ দেব। ‘পিশাচের রাত’-এ কোচিং স্যর হরিহরবাবুর মধ্যেই ছিল এই রক্তপায়ী প্রবৃত্তি। আদিবাসীদের করে দেওয়া এক উল্কির কারণেই তাঁর মধ্যে জেগে উঠত ‘ওয়ারউলফ’। অবশেষে ছাত্ররাই গুলি করে তাঁকে। তবে সেখানেই শেষ নয় রহস্যের। আরেকটি উপন্যাস ‘আমি পিশাচ’-এও রয়েছে এই রক্তপায়ী শিক্ষকের গল্প। রয়েছে শুভ-অশুভের এক দ্বৈরথ। তবে এসবেরও আগে সত্যজিৎ লিখেছেন ‘শিবু ও রাক্ষসের কথা’। যেখানে জনার্দন স্যর নরখাদক ‘পিরিণ্ডি’ জাতির বংশধর। গল্পের শেষে পাগল স্ফটিকদার অদ্ভুত বুদ্ধিতে অবশ্য রক্ষা পেয়েছিল শিবু।

ওদের হ্যালোউইন, আমাদের ভূত-চতুর্দশী। ...‘টিকিটিও দেখতে পেলাম না’, ক্ষোভ জানালেন সদ্য-আলাপ-হওয়া বন্ধুটি। ‘কী যে ঢপের বিষয় নিয়ে ইয়েটা চালান!’ খিকখিক করে একটু হাসলেনও, ‘এই ডিজিটাল যুগে কী আর ওঁয়ারা...!’ ধবধবে দাঁত প্রকাশ পেল, ‘দেখবেন, শেষে... হেঁহেঁ... দপ্তর-উঠিয়ে-নে-মা... সেই বন্দোবস্ত না হয়।’   

‘বন্দোবস্ত কিন্তু আছে।’ নরম গলায় তখন বলেছি, ‘সরকারের তরফে ভূত-বাঁচাও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, আর তা ছাড়াও...’

‘ভূত? বাঁচাও? প্রকল্প?’   বন্ধুটি আগাপাশতলা আমায় দেখলেন। বুঝলাম, একজামিন চলছে... পাগল - কিন্তু কতটা?   

‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ নরম ক’রেই জানিয়েছি, ‘বিশিষ্ট ভূত-বিশেষজ্ঞ, মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, ভূতনাথ পাত্র – তিনিই এই ঘোস্ট-প্রজেক্টের কর্তা। -কোথায় প্রজেক্ট? -রামচন্দ্রপুরে। ...আমাদের সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মহৎ লেখক, এই নিয়ে যা-যা লিখবার ‘নিঝুম রাতের আতঙ্ক’ কিস্যায় সবই লিখেছেন।’ 

বন্ধু অতঃপর গলা খাঁকড়ে কিছু বলতে যাবেন, আমি তাঁর কথা ডিঙিয়ে দ্রুত বলে যেতে থাকি, ‘ভূতনাথ পাত্রের মামা গজপতিবাবু কথাটা পেড়েছিলেন ভবভূতির কাছে। অনেকদিনের ইয়ার-দোস্ত। ...হ’লে কী হবে, ভবভূতি শুনেই বলেছেন, ‘গুল।’ গজপতি চটেছেন। সরেজমিনে ঘোস্ট-প্রজেক্ট দেখাবেন ব’লে রামচন্দ্রপুর অবধি টেনে এনেছেন ভবু-কে। 

‘রাতের স্টেশন। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে নেমেছেন দু’জন। ...গজপতিই ঠাহর করলেন জিনিসটা। একটা কাঠের ফলক, তাতে বড় বড় হরফে লেখা -

‘রামচন্দ্রপুর ভূত প্রকল্প। (ব্র্যাকেটে) - তেরোটি প্রজাতির ভূতের অভয়ারণ্য।’

পাশেই আরেকটা বড় নোটিশ – সেটা আপনাকে শোনাই-

‘সাবধান! কেহ উহাদের উত্যক্ত করিবেন না। ঘাড় মটকাইয়া দিলে সরকার দায়ী হইবেন না। কেহ যদি আদর করিয়া ইহাদের কিছু খাওয়াইতে চান, তাহাতে আপত্তি নাই। ...তালিকার খাদ্যগুলি ব্যাতীত কিছু দিলে জরিমানা করা হইবে।’’

 

‘খাবারগুলো কী?’ ভুরু কুঁচকোলেন বন্ধু।

‘সে খুব চমৎকার। দুধ, তারপর রসগোল্লা।’ আমি আউড়ে যাই, ‘হাড়গোড়, শুকনো গোবর, খাঁটি সরিষার তৈল, পাকা কলা, টিকটিকির ডিম ও লেজ, মাছ (সিঙ্গি বাদে), আরশোলার ঠ্যাঙ’...

শ্রোতার নাকমুখের ইতোমধ্যে-বদল যেন খেয়ালই করিনি, ‘...ইত্যাদি ইত্যাদি। গজপতিও ভবভূতিকে সবটা পড়তে দেননি। ‘চলো চলো, ভাগ্নের অফিসে গিয়ে জেনে নেবে’- ব’লে তাড়া দিয়েছেন।

‘অফিস ঘরে বিজলি নেই, মোমবাতি জ্বলছে। ভাগ্নে ডঃ ভূতনাথ পাত্র, সিড়িঙ্গে চেহারা, কুচকুচে কালো রঙ, চুলগুলো ছোট আর কাঁটার মতো খাড়া... খাতির করেই বসালেন দুই প্রৌঢ়কে। সেখানেই জানা গেল ভূত কয় প্রকার ও কী-কী। এর মধ্যেই ভূতে খানিক বিশ্বাস এসেছে ভবভূতির।’

‘বিশ্বাসের কথা যখন উঠলই’, বন্ধু অধৈর্য ভাবে বলতে গেলেন এবং আমি হাত তুলে তাঁকে থামালাম, ‘নির্যস! সেই কথাটাই বলছি। তিনরকম প্রজাতি হয় ভূতেদের। মানুষ-ভূত, অর্থাৎ যাকে বলে প্রেত। প্রকৃত ভূত –মানুষ বা জন্তু, কারোরই অশরীরী আত্মা নয় – স্রেফ ভূত। তৃতীয় প্রজাতি হচ্ছে প্রাণীজ-ভূত – মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী ম’রে যে-ভূতের জন্ম। যেমন ধরুন গরু ম’রে যে ভূত হয়েছে তার নাম’- 

‘গো-ভূত।’ শ্রোতা ফিল ইন দা ব্ল্যাংক ক’রে দিলেন। গলা তেতো ও সুর টিটকিরির।

‘না।’ গায়ে না মেখে (শ্রোতা - নিশ্চিত আরো ক্রুদ্ধ) জানালাম, ‘তার নাম এখন রাখা হয়েছে ‘গো-দানো’। কিন্তু সে যাক। যা বলছিলাম। রামচন্দ্রপুরের চক্করে যে অভিজ্ঞতা হল ভবভূতির, এর পর তো আর সন্দেহ চলে না! – অন্তত চললে সেটা ভালো দেখায় না।  

‘কিন্তু সেই যে। – স্বভাব যায় না। ফের একদিন আড্ডায় ভূত নিয়ে ফাজলামি মারতে গেলেন এবং শেষমেশ পড়তে হল ব্রহ্মদৈত্যের খপ্পরে।’ 

‘ব্রহ্ম-দৈত্য!’ শ্রোতা-বন্ধু উচ্ছে-খাওয়া মুখে শুধোলেন, ‘সেটা আবার কোন গল্প?’ 

‘সে অন্য এক গল্প।’ উদার ও প্রসন্ন মুখে বলেছি, ‘মুস্তাফা সিরাজ তার কথাও আরেক কিস্যায় লিখে গেছেন।’

‘সে গল্পের নাম কী?’ বন্ধু সন্দিগ্ধ হলেন। 

‘ঘুঘুডাঙার ব্রহ্মদৈত্য।’

‘ঘু-ঘু-ডা-ঙা!’ যেভাবে তারিয়ে তারিয়ে তিনি বললেন এবং সরু চোখে তাকালেন তাতে মনে হল  ঘুঘুর বদলে তিনি আমায় ফাঁদই দেখাতে চান।

‘এবং শুনলে আশ্চর্য হবেন’, আমি যেন আরো উৎফুল্ল, ‘সেই ব্রহ্মদৈত্য অত্যন্ত সজ্জন। সম্পর্কে তিনি ছিলেন গজপতির পিসতুতো জামাইবাবু, গজু তাঁকে জ্যান্ত দেখেন নি। - থাকতেন একটি প্রাচীন বেলগাছে। গাছ থেকে উঠোনে প্রায়ই নামতেন পায়চারি করতে, পিসতুতো দিদি শুধোতেন, ‘কী গো! গরম লাগছে?’ ব্রহ্মদৈত্য বলতেন, ‘না গো! আজ সন্ধ্যেয় বেজায় ভোজ খাওয়া হয়ে গেছে, তাই হজম করার তালে আছি।’  

‘দিদি তখন ডাকছেন, ‘হজমের গুলি নিয়ে যাও।’ মস্ত কালো হাতখানা তখন ব্রহ্মদৈত্য জানলা অবধি বাড়িয়ে দিতেন, তাতে কাঁড়ি লোম। ...গজপতি তখন নেহাতই বালক। বলতেন, ‘ও কে গো, যাকে হজমি দিলে?’ দিদি বলতেন, ‘চুপ চুপ! বলতে নেই।’

‘তা শুধু হজমি কেন? তিনি তো বললেন বেলগাছের বাসিন্দা – বেলের শরবৎ খেতেন না?’ ...শ্রোতা-বন্ধুর টিপ্পনী ক্রমে ভয়াবহ, ‘মগডাল থেকে পাকা বেল পেড়ে দিলেই হল। বাঁশের ডগায় বেঁধে শরবতের জগ আপনি তুলে দেবেন! সেটাও তো খুব মন্দ হবে না।’

‘অবিকল! ঠিক এইটেই বলেছিলেন ভবভূতি!’ খুশিতে ঝলমল ক’রে উঠে আমি বলেছি, ‘হ্যাঁ, গজপতিকেই – তবে একটু অন্য ভাবে। দিদিও অনেকদিন দেহ রেখেছেন, ঘুঘুডাঙার সেই বাড়িটি নিরালা এবং গজু তার মালিক। ততদিনে ভবভূতি সেটা জেদ ক’রে কিনেছেন এবং  শুরু করেছেন বসবাস। গজুকে লম্বা চিঠিতে চিমটি সহ জানাচ্ছেন পাকা বেল ও ব্রহ্মদৈত্যের সংবাদ। -  ঘোর নাস্তিকের যা হয়।’

‘তাহলে?’ বাঁকা হাসি হাসলেন শ্রোতা, ‘ছিল না সেই দৈত্য? পুরোটাই আপনার গজপতির ভুল – ইয়ে গুল?’

‘এই, না-না!’ জিভ কাটি তৎক্ষণাৎ, ‘অমন বলবেন না। কেন থাকবেন না, অবশ্যই ছিলেন। ভবভূতি যখন জমিয়ে বসছেন, সেই ক’টা দিন বেলগাছ ছেড়ে তিনি গেছিলেন একটু তীর্থ করতে। দু’জনের সাক্ষাৎ হবে বইকি! না হয়ে যায়? ভবভূতি দৈত্যকে মানবেনও। সে এক বিরাট কেচ্ছা।’  

‘তীর্থে গেছিলেন?’ যে-বাঁকা হাসিটি এতক্ষণ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেটি গিলে নিলেন শ্রোতা, ‘এত সব... মশাই, গাঁজাখুরি... আপনি, পান কোথা থেকে?’

‘আজ্ঞে পুরোনো বইয়ে। দপ্তর চালাচ্ছি যা ভাঙিয়ে।’ কান অবধি হাসি টেনে ধরি, ‘সিরাজের ‘ভৌতিক সমগ্র’ খুললেই পাবেন।’   

জ্বলজ্বলে চোখে তিনি আমাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। চুপ। ...চাপা, একটু সূক্ষ্ম ধরনের হাসি কি ঠোঁটে?

আরো যেন কী বলতে যাচ্ছি, কিন্তু... না। যেখানে আসা-ইস্তক ঠায় বসেছিলেন, সেই কাঠের চেয়ারেই... কোথা হইতে কী হইল, অল্প বেঁকে-চুরে, তারপর গলে গিয়ে একরাশ ধোঁয়া হয়ে  গেলেন শ্রোতা ভদ্রলোক। খোলা ও জোড়া চোখে, তাঁকে, আমি আমার সামনে বাতাসে মিশে... হারিয়ে যেতে দেখলাম।  

তাঁর পরিশীলন ছিল সন্দেহের অতীত। ‘চলি’ কিংবা ‘গুড বাই’ – যাওয়ার আগে কিছু একটা বলেও ছিলেন। - কানের ভুল? ‘চালিয়ে যাও’ -সূক্ষ্ম হাসি ও তারিফের সঙ্গে কি এটাই শুনেছি?

আজ দিশি-হ্যালোউইন। এখন দল বেঁধে সন্ধ্যেরা নামছে। ...শেষ হাসিটা নিজেই ফিকফিক ক’রে হেসে ফেলছি দেখলাম।

Powered by Froala Editor