ধর্মীয় মৌলবাদ এবং চলচ্চিত্র

ছায়াছবি-কথা – ১৩

আগের পর্বে

তাইওয়ানের চলচ্চিত্র পরিচালক সাই মিং লিয়াং-এর নবতম ছবি – ডেজ। চিত্রনাট্যহীন সিনেমার ইতিহাস নতুন নয়। কিন্তু এ ছবি ধারণাবিহীনও বটে। দুই পুরুষের সারাদিনের জীবনের ছবি এই সিনেমা। একজন পঞ্চাশের কোঠায় আর অন্যজন বিশ। সিনেমার সময় আর বাস্তবের সময় মিলিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। ১২৭ মিনিটের ছবিতে আছে ৫০টিরও কম শট। এক সমপ্রেমের যৌনদৃশ্য চমকে দেয় দর্শকদের। প্রতিদিনের জীবন থেকে অসংখ্য প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায় ‘ডেজ’।

উনুনে গনগনে আঁচে রান্না চলছে রান্নাঘরে। মাছ ভাজা হচ্ছে, বেশ অনেকগুলো। যিনি রাঁধছেন তিনি একটা ব্রিফকেস খুঁজছেন প্রতিবেশীর থেকে, ফোনে। আর কয়েক মুহুর্ত পেরোলে বোঝা যায় যে একটা চিত্রনাট্য নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। আরও একটু সময় গেলে বোঝা যায়, একটা কাহিনীচিত্রের শুটিং-এর তোড়জোড় চলছে। সেই শুটিং দলের জন্যেই রান্নাবাড়া আর তারপর মেঝেতে গোল হয়ে বসে সবাই মিলে দ্রুতগতিতে খাওয়াদাওয়া। লোকলস্কর, যন্ত্রপাতি, ব্যবস্থাদির তাড়াহুড়ো সবই আছে; কিন্তু সংখ্যায়, পরিমাণে বেশ নগণ্য। তেমন জৌলুসও চোখে পড়ছে না গতানুগতিক অর্থে। একটু ঘরোয়া যেন বা। দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় মূল অভিনেত্রীর। পরিচালক নবাগত। যাকে একটু আগে রান্না করতে দেখেছি, তিনি এই ছবির প্রযোজক। তাঁর স্বামী চিত্রনাট্যকার। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রূপসজ্জার পর আলো জ্বেলে তেপায়ায় ক্যামেরা রেখে শুরু হয় শুটিং। কিন্তু যাহ! ‘বিদ্যুৎ বিভ্রাট’! “তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে, একই লাইন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতেও”-- অন্ধকার থেকে ভেসে আসে।

 

যে শহরে এই শুটিং চলছে সেখানকার রাস্তাঘাটে থেকেথেকেই ভারতীয় সেনার উদ্ধত রাইফেলের গতায়াত দেখা যায়। সেটা বিষয় নয়, তেমন। বিষয়-- চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের ইতিহাস আর বর্তমান অবস্থা অর্থাৎ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। মণিপুরের চলচ্চিত্র। ইম্ফলউডের ছবিকে ‘মূল ভূখণ্ডের’ চলচ্চিত্রবাসীরা ‘আঞ্চলিক’ (রিজিওনাল) চলচ্চিত্র নামে চিনি। (একমাত্র বলিউডের হিন্দিভাষী ছবি-- ‘জাতীয়’ চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়।) মমতা মুর্তী পরিচালিত তথ্যচিত্র ফ্রায়েড ফিশ, চিকেন স্যুপ অ্যান্ড আ প্রিমিয়ার শো (২০১২)-তে আমরা একটা কাহিনীচিত্রের জন্ম আর তার পরিণতি প্রত্যক্ষ করতে থাকি। সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে মণিপুরী চলচ্চিত্রের ইতিহাস-ভূগোলের সঙ্গে। তারও পাশাপাশি চলতে থাকে সাধারণ মণিপুরবাসীর জ্বলন্ত সমস্যা অর্থাৎ তাঁদের ওপর ভারতীয় সেনাবাহিনীকৃত ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনের’ অত্যাচার আর তার বিরুদ্ধে মণিপুরীদের প্রতিরোধের দৃশ্যখণ্ড।

 

শুটিং শেষ। ডাবিং শেষ। সম্পাদনা শেষ। পোস্টার ছাপানো, প্রচার ইত্যাদির কাজও শুরু হয়ে গেছে। মুক্তির অপেক্ষায়-- একুশ শতকের কুন্তি। এবার দর্শকের কাছে যাওয়ার আগে শুধু ‘সোয়া ঘণ্টার পথ’-- সেন্সর বোর্ড। সেন্সরের জন্য লাগবে তিরিশ হাজার টাকা। ভারতীয় সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের অফিস পাশের রাজ্য অসমের গুয়াহাটিতে। কিন্তু তারও আগে ছাড়পত্র পেতে হবে ‘ফিল্ম ফোরাম’-এর কাছ থেকে। তারা যাচাই ক’রে দেখবে ছবিটা ‘যথেষ্ট মণিপুরী’ কিনা। সে পথেই গিয়ে ঠোক্কর খান কুন্তি। প্রাথমিকভাবে এই ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল সাধারণ মণিপুরবাসীর মানসভূমে বলিউডের উপনিবেশ পত্তন থেকে বাঁচতে। নিয়ম হয়েছিল-- অভিনেত্রীদের পোষাক ‘যথেষ্ট মণিপুরী’ হতে হবে (শাড়ি, নকল চোখের পাতা, সিঁদুর, খাটো স্কার্ট, কুর্তা-পায়জামা নিষিদ্ধ), গানের দৃশ্যের মধ্যে পোশাকের বদল ঘটিয়ে ‘বলিউডের নকল’ করা চলবে না, ‘বিজাতীয়’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা যাবে না, স্তন বিভাজিকা বেশি দেখানো যাবে না, চরিত্রদের নাম ‘যথেষ্ট মণিপুরী’ হতে হবে, ‘যৌন সুড়সুড়ি’ থাকবে না ইত্যাদি। কিন্তু তখন কে আর জানত যে, নান্দনিক পরিসরে নিয়মতন্ত্র এমন ‘সৃষ্টি’ছাড়া হয়ে দাঁড়াবে! এমনকি এসব অমান্যের ফল প্রাণের দাম পর্যন্ত হতে পারে! পুঁজিকে স্বাগত জানানো হবে অথচ পুঁজির সাংস্কৃতিক পুঁজ গায়ে লাগবে না, এমন আবার হয় নাকি!

 

১৯৪৮/’৪৯ নাগাদ মণিপুরে মাইনু পেমচা ছবি তৈরী প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক এবং মণিপুর-আদৌ-ভারতের-অংশ-হবে-কিনা রাজনৈতিক বিতর্কে সে ছবির কাজ সম্পূর্ণ করাই যায়নি। অতঃপর ১৯৭২ সালে অরিবাম শ্যাম শর্মা পরিচালিত মাতামগি মণিপুর (আজকের মণিপুর)-কেই প্রথম মণিপুরী চলচ্চিত্র হিসেবে মানা হয়। (সে বছরই মণিপুর অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পায়।) বর্তমানে মণিপুরের চলচ্চিত্র শিল্প সম্পূর্ণ ডিজিটাল-প্রযুক্তি-নির্ভর। এই ডিজিটাল সময়ে কুন্তি ছবিতে ব্যবহার হল ‘বাবা’ শব্দ, উঠল আমিষ ‘চিকেন স্যুপ’-এর প্রসঙ্গ, গানের দৃশ্যে স্থান ও অভিনেত্রীর পোষাক বদলাল ফ্লাশব্যাকের দাবিতে। তাই আপত্তি-- ‘বাবা’ বিজাতীয় শব্দ, “চিকেন স্যুপ হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতির পরিপন্থী”। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় গোঁড়ামির কাছে শিল্পের যুক্তির হার নিশ্চিত জেনেও পরিচালক বলেন-- “গৌড়ীয় ধর্ম প্রবেশের পর থেকেই আমরা আমাদের মৈতেয়ী সংস্কৃতির শিকড় ভুলে কৃষ্ণয় মেতেছি। মৈতেয়ীরা শিকার করত, তারা মাংসাশীই ছিল।” যে জটিল রাজনৈতিক বিন্যাসে মণিপুরের চলচ্চিত্র এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে, সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে ভারতীয় সেনা যখন কোনও বিপ্লবীকে কী সাধারণ মানুষকে গুলি ক’রে মারে, সেই ছবি তুলতে দিতে কিন্তু ধর্ম-রাষ্ট্রের কোনো বাধা থাকে না।

চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহগুলো অধিকাংশই বন্ধ। খারতুম শহরে যে ক’টা টিকে আছে সেখানে বলিউড আর হলিউডের ছবিই শুধু চলে। যারা একটা সময়ে অনেক কষ্ট ক’রে বিদেশে গিয়ে চলচ্চিত্র বানাবার কৃতকৌশল শিখে এসে ছবি বানাতে শুরু করেছিল; তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয়, নয় কেউ পালায়, নয়ত বা কেউ চলচ্চিত্রের পথ ছাড়তে বাধ্য হয়। তাদের সবাইই এখন প্রৌঢ়। কিন্তু স্বপ্ন যে মরতে মরতেও মরে না! নিজের দেশে ফিরে তারা এখন আবার তাদের ফিল্ম ক্লাবকে ফিরে পেতে চায়। চায় দর্শকরা ভালো ছবি দেখুক। ঢাল-তলোয়ারহীন সিনেমাক্ষ্যাপারা ছবি তোলার অভিনয় ক’রেই সুখ পায়।

 

১৯৮৯-এর সেনা অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ থেকে সরকারি মদতে যে ঐস্লামিক মৌলবাদ শুরু হয়েছিল, তাতেই হঠাৎ মৃত্যু হয়েছিল চলচ্চিত্রের। এখনকার প্রজন্ম অমিতাভ বচ্চনের নাম জানে, সালমান খানের নাম শুনলে চকচকে লাজুক চোখে হেসে ওঠে; কিন্তু নিজের দেশের চলচ্চিত্র বলে কিছু জানেই না। চার প্রৌঢ় সিনেমাক্ষ্যাপা ল্যাপটপ, প্রোজেক্টর বগলে করে ছবি দেখানোর কাজ শুরু করতে চায়। তারা বেছে নেয় চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস (১৯৩৬)। কিছু মানুষ সাড়াও দেন। কিন্তু বড় পর্দা ছাড়া সিনেমা দেখার আসল রস পাওয়াই তো দুষ্কর। তাই ইব্রাহিম শদাদ, মানর আল হিলো, সুলেমান মহম্মদ ইব্রাহিম, আলতায়ব মাহদি-রা লেগে পড়েন পুরনো রেভল্যুশন সিনেমাকে (সিনেমা হলের নাম) ছবি দেখানোর উপযুক্ত করে তুলতে। ছবি দেখানোর বিশাল পর্দা ধুলোময়লায় ঢাকা। ধুলোয় ঢাকা চিত্র-প্রক্ষেপণ-যন্ত্র। তাই মই, ঝাড়ু, চুন, বালতি কাঁধে নিজেরাই শুরু করেন রূপোলি-পর্দার গায়ে জমা ধুলো ঝেড়ে নতুন করে রং করতে। তারপর পোস্টার ছাপিয়ে, দেওয়ালে সাঁটিয়ে, হলের পাশের ফুটবল-খেলা-ছেলেদের নেমন্তন্ন করতে থাকেন বিনি পয়সায় ছবি দেখতে আসার জন্য। তাঁরা এবার দেখাবেন তারান্তিনোর শোধনবাদী ওয়েস্টার্ন জ্যাঙ্গো আনচেইনড (২০১২), যেহেতু স্থানীয় বাসিন্দারা অ্যাকশন ফিল্ম দেখতে পছন্দ করে বলে জানান। রাষ্ট্রিক সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে অন্য আর এক সমস্যা, যে সমস্যা এত প্রকট আগে ছিল না। আগে মহল্লায় একটা মাত্র মসজিদ ছিল যেখান থেকে আজানের সুর ভেসে আসত। এখন প্রেক্ষাগৃহের ছাদে উঠে তারা দেখেন, সেই ছোট্ট এলাকার মধ্যেই মাথা তুলেছে আরও খান পাঁচেক মসজিদ। ফলতঃ আজানের সময়ে পাশের মানুষের কথা শুনতে পাওয়ার জো-টুকুও থাকে না। উদ্বোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে বারবার থমকাতে হয় আজানের অত্যাচারে। বাধ্য হয়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মুকাভিনয় করে চলতে হয়, যতক্ষণ না…। এই অংশগুলো খুব সুন্দরভাবে ধরেন টকিং অবাউট ট্রিজ (২০১৯) তথ্যচিত্রের পরিচালক সুহায়ব গাসমেলবারি। যেমন দেখি ছবি প্রদর্শনীর বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অতি-সক্রিয়তার অংশগুলো। পাশাপাশি মাঝেমাঝে আসে ‘সুদানের ফিল্ম গ্রুপ’-এর এই প্রৌঢ় সদস্যদের বানানো ছবির ছত্রাকাক্রান্ত দৃশ্যাখণ্ড।

 

কিন্তু এমন ছবির নামে গাছের প্রসঙ্গ এল কীভাবে? প্রেক্ষাগৃহের প্রবেশপথে গাছ পুঁততে দেখা যায় তাঁদের। ছবির শিরোনাম ধার নেওয়া হয় জর্মন নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেশট-এর কবিতা “দোজ হু ওয়্যার বর্ন লেটার” থেকে। এই কবিতায় ব্রেশট বলেন-- এটা কেমন সময় যখন গাছ নিয়ে কথা বলাও অপরাধ, যেহেতু গাছ শত বিভীষিকার মধ্যেও নৈঃশব্দের ইঙ্গিত নিয়ে আসে! আসলে হিন্দুত্ববাদী ভারত হোক বা ঐস্লামিক সুদান-- নৈঃশব্দ ভাঙার চেষ্টাতেই এ’ধরণের ছবি নিত্য রত থাকছে। ‘দেওয়ালে-বসা-প্রজাপতির’ দৃষ্টিতে তাদের ক্যামেরা দেখে, আর আমরা অভিজ্ঞতা করি ধর্মোন্মাদ বর্তমান।

Powered by Froala Editor