দিনলিপি

ছায়াছবি-কথা – ১২

আগের পর্বে

লিক্সিন ফানের ‘লাস্ট ট্রেন হোম’ এবং মার্চেলো গোমেজ-এর ‘ওয়েটিং ফর দ্য কার্নিভাল’; দুটি তথ্যচিত্রেই উঠে এসেছে বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকদের কথা। প্রথমটি চিনের কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে। দ্বিতীয়টি তৈরি ব্রাজিলের ডেনিম কারখানার উপর। দুটি তথ্যচিত্রেই উঠে এসেছে এক উৎসবের প্রতীক্ষার কথা। সারা বছরের সমস্ত পরিশ্রমের মধ্যে একবার জীবনে ফেরার আহ্বান। কিন্তু সেই ফেরাও যেন মধুর নয়। সারা বছরের ক্লান্তি এবং জীবনের অভাব ঘিরে রাখে উৎসবের দিনগুলিকেও। শ্রমিকদের কথায় উঠে আসে সেইসব হতাশা। এমনকি তাঁদের শব্দচয়ন পৌঁছে যায় পুঁজিবাদ পর্যন্তও। একই অর্থনৈতিক পরিবেশ মিলিয়ে দেয় পৃথিবীর দুই প্রান্তের মানুষের জীবন।

নব্য-উদারনৈতিক সময়ের একটা নব্য-উদারনৈতিক শহরে দুজন পুরুষমানুষ। একজন পঞ্চাশের কোটায়, একজন বিশের। জ্যেষ্ঠজনকে লিজার শ্রেণীভুক্ত হিসেবে বৈভব-পরিসরে অবসরযাপনে দেখা যায়। আর কনিষ্ঠজনকে দেখা যায় তার দৈনন্দিনতার শ্রমে। দু’জনের পাশে আর কোনো চরিত্রকে দেখা যায় না। দুজনেই একা। দুজনেই নামহীন। 

তাইওয়ানের চলচ্চিত্র পরিচালক সাই মিং লিয়াং (জন্ম মালয়েশিয়ায়)-এর নবতম ছবি - ডেজ (২০২০)। অনায়াসে মন্থর চলচ্চিত্র (স্লো সিনেমা) গোষ্ঠীভুক্ত করা যায় এই ছবিকে। কিন্তু তাতে কিছুই বোঝা যাবে না, লিয়াঙের চলচ্চিত্রীয়-কালিকতার ধারণাকে না বুঝলে। চিত্রনাট্যহীন ছবি তৈীগর ইতিহাসের বয়সও যথেষ্ট হয়েছে। লিয়াং ছবি তৈরি থেকে হঠাৎ অবসর ঘোষণার পর এসে শুধু চিত্রনাট্যহীন হয়েই না থেমে, ধারণাহীন (কনসেপ্ট অর্থে) ছবি করার দিকে এগোলেন। আদৌ ছবি হবে নাকি কোনো ইন্সটলেশন আর্ট, তাও শুরুতে জানা ছিল না। অভিনেতা লী কাং-শেং (এ ছবির জ্যেষ্ঠজন) সেই ১৯৮৯ সালে লিয়াঙের সঙ্গে পরিচয়ের পর ১৯৯২ থেকে তাঁর এগারোটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবির পাশাপাশি ছোটো-মাঝারি সমস্ত ছবিতে অভিনয় করছেন তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে। ডেজ ছবিতে যুক্ত হলেন আনং, যিনি জন্মসূত্রে লাওসের মানুষ। ২০১৪ সাল থেকে এ ছবির জন্য ছবি তোলা শুরু হয়। বলা ভালো, সে সময়ে তোলা ছবি এ ছবির ভ্রূণ হিসেবে কাজ করেছে।

ছবির শুরুর দিকে জ্যেষ্ঠজনকে এক ঘনসবুজ চোখজোড়ানো মায়াবী পাহাড়ি টিলায় উঠোনের গাছপালার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজের ঘাড়ে অল্প চাপ দিতে দেখা যায়, স্পন্ডলাইটিস-জাতীয় অসুখে যেমনটা করা হয়ে থাকে, তেমনভাবে। এর আগে ১৯৯৭-তে লিয়াঙের ছবি দ্য রিভার-এও লী-এর বাঁ কাঁধের সমস্যা ও তজ্জনিত চিকিৎসা ইত্যাদি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র প্রাকৃতিক-নিসর্গের এমন শট লিয়াঙের অন্য ছবিগুলোতে অনুপস্থিত। তাঁর ফেস (২০০৯) ছবিতে প্রাকৃতিক-নিসর্গদৃশ্য থাকলেও, তা মনুষ্য উপস্থিতিহীন নয়। তাঁর অন্যান্য ছবির মতো বৃষ্টির মোটিফ, সামান্য হলেও, ডেজ-এও বর্তমান, প্রথম শটে। ডেজ-এর আগের ছবি স্ট্রে ডগজ (২০১৩) শেষ হয়েছিল সাত মিনিটের শট দিয়ে, আর ডেজ শুরু হয় সাড়ে চার মিনিট লম্বা শট দিয়ে। 

 

আরও পড়ুন
উৎসবে শ্রমজীবন

ওদিকে অল্পবয়সীকে দেখা যায় পুজোআচ্চা শেষ করে রান্নার তোড়জোড় করতে। উনুনে আগুন তৈরি করে আঁচ ধরতে দিয়ে তারপর সবজি ধোয়ার পালা। তারপর কাটাকুটি, তারপর রান্না চাপানো। এই সমস্তকিছু একেবারে বাস্তব দৈর্ঘ্যের সময় নিয়ে হ’তে দেখা যায়। খুব কাছে গিয়ে না দেখে একটা মোটামুটি দূরত্ব থেকে সটান দেখা হয় সবকিছুকে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময় নিয়ে দেখা হতে থাকে। ছবির সময়-দৈর্ঘ্য আর বাস্তব সময়-দৈর্ঘ্য মিলে একটা কালিক-অভিজ্ঞতা হয় শুধু। চলচ্চিত্রের ভাষায় বাস্তবকে এভাবে অভিজ্ঞতা করার নাম দেওয়া যাক-- কালিক বাস্তববাদ বা ড্যুরেশনাল রিয়লিজম। বাস্তবতার এই নিরেট কালিকতা, চলচ্চিত্রীয় সময়-অভিজ্ঞতাকে এক আশ্চর্য অযৌক্তিকতায় (অ্যাবসার্ড অর্থে) নিয়ে যায়। সময় এখানে স্থান নির্মাণ করে। তাইই হয়তো তাঁর বাঙ্ময় ‘কাট’ স্থানের সীমাবদ্ধ সম্ভাবনাকে অসীমের দিকে নিয়ে যেতে চায়। স্থানাঙ্ক বদল করে দর্শক-মনে বসত গাড়ে স্থান। ভেবে দেখি-- লিয়াং কিছু নিরেট সময়খন্ডকে পাশাপাশি রেখে, ‘জাম্প-কাটের আধুনিকতা’-র অপর পাড়ে সিঁড়িভাঙা মানচিত্র গড়েন দর্শক-মনে।

এ ছবিতে সংলাপ আসে বিরতির মতো করে। সংলাপহীনতাই (নাকি নৈঃশব্দ?) যেন এ ছবির মূল কথন। দৃশ্যানুগ শব্দ ছাড়া বাইরে থেকে নাটকীয়তা আরোপের জন্য কোনো চলচ্চিত্রীয় শব্দ প্রযুক্ত হয় না এ ছবিতে। (অথচ সাঙ্গীতিক শব্দ এ ছবিকে কিভাবে শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করে তার কথায় পরে আসছি।) লিয়াঙের ছবিগুলো পুর্বাপর দেখলে বোঝা যায়-- সংলাপের, সঙ্গীতের (নাচ ও গান) পরিমিতি থেকে শুরু করে ঘটনার পরিমিতি হয়ে চরিত্রের পরিমিতিতে তিনি একের পর এক আভরণ খুলতে খুলতে এসে পৌঁছোচ্ছেন, যেন ন্যূনবাদীতার লক্ষ্যে নিষ্ক্রান্ত কোনো ধীমান পরিব্রাজক। আলোচ্য ছবিতে যেভাবে দৈনন্দিনের কাজকর্মগুলোকে দেখা হয়, তা কিছুটা মেলে পর্যবেক্ষণমূলক তথ্যচিত্রের ধরণের সঙ্গে। এ ছবির ছবি তোলা শুরু হয়েছিল তথ্যচিত্রের মতো ক’রেই, শুধু একটা সময়ের অন্তর্গতভাবে অভিনেতা লী কাং-শেং (তখন অসুস্থ ছিলেন)-এর চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে ধরে রাখতে। তারপর থাইল্যান্ডস্থিত আনং-এর মতো না-অভিনেতাকে ভিডিও-চ্যাটের সময়ে রন্ধনরত অবস্থায় দেখতে পাওয়া এবং তাকে দিয়ে এক অবাস্তব মানের বাস্তবোচিত (না)অভিনয় করানো এবং এই ছবির জন্ম। ১২৭ মিনিট লম্বা এই ছবিতে মোট শটের সংখ্যা ৫০-এরও কম। মোটের ওপর ‘একটা শটে একটা দৃশ্য’ পদ্ধতিতে ছবিটা নির্মিত। শুধু তিনটে দৃশ্যের (আক্যুপাংচার, রাস্তা, হোটেল) ক্ষেত্রে একাধিক শট ব্যবহার হয় এবং সেখানে কিছু হাতে নেওয়া শটের ব্যবহারও হয়, এমনকি আক্যুপাংচারের দৃশ্য তোলার সময়ে চারপাশের বাস্তব শব্দকে সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়। বাকী সমস্ত ছবিটা স্থির (ট্যাবলো) শটে তোলা, অভিনেতা-পরিচালক-চিত্রগ্রাহকসহ মোট ছ’জনের দল নিয়ে। 

আরও পড়ুন
সেক্সি খেলা

 

ছবির শুরু থেকেই বোঝা যায় যে দু’টো মানুষ দু’টো ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন অবস্থানে আছে। তাদের দেখা হয় তখন যখন একটা হোটেলের ঘরে আনং আসে অসুস্থ লীকে সারা গায়ে মাসাজ করে দিতে। হোটেলের এই দৃশ্যটাই ছবির দীর্ঘতম দৃশ্য। মাসাজ পৌঁছোয় মৈথুন পর্যন্ত। (আবার দ্য রিভার স্মর্তব্য।) স্নানের পর পারিশ্রমিকের পাশাপাশি আনং-কে একটা সুরযন্ত্রের খেলনা বাক্স উপহার দেয় লী। এই খেলনা বাক্স থেকে চার্লি চ্যাপলিন নির্মিত ও অভিনিত ১৯৫২ সালের ছবি লাইমলাইট-এর সঙ্গীত বাজে। প্রসঙ্গত বলা যাক, সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব স্বয়ং চ্যাপলিন নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। লাইমলাইটে আমরা দেখি একজন বয়স্ক, একদা-বিখ্যাত হাস্যকৌতুকাভিনেতা একটি আত্মহননকামী যুবতীকে চিকিৎসা ও শুশ্রূষার যুগপৎ সাহচর্যে নতুন জীবন দিচ্ছেন। পরে জানা যায় মেয়েটি নৃত্যপটীয়সী। কিন্তু প্রথমত সে বাঁচতে চায় না আর দ্বিতীয়ত শরীরে বিষের প্রভাবে সে প্রায় চলৎশক্তিহীন। প্রৌঢ় ক্যালভেরো দায়িত্ব নেন যুবতী টেরির আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার। সে পথে চলতে গিয়ে তিনি নিজেও ফিরে পান হারানো আত্মবিশ্বাস। দর্শকের ফিরিয়ে-নেওয়া-মুখ আবার থিয়েটরমুখী হয়। এই ছবিতে চ্যাপলিন নিয়েছিলেন আর এক বিখ্যাততম তারকা বাস্টার কিটঁ-কে। কিটঁ তখন বৈবাহিক সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে জেরবার। ছবির কাজ প্রায় করতেই পারছেন না। এদিকে, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর তৈরীর পর থেকেই তাঁর ‘কম্যুনিস্টসুলভ’ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে চ্যাপলিনকে যথেষ্ট ঝড়ের মুখে পড়তে হয়েছিল। পারিবারিক সমস্যা ছাড়াও মঁসিয়ে ভের্দু তৈরীর পর তাঁর বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিকতার’ অভিযোগ কয়েক গুণ বাড়ায়, ভাঁটা পড়ছিল তাঁর খ্যাতিতে। তাইই হয়ত সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা তাঁকে করতে হয়েছিল এমন ছবি দিয়ে যেখানে সেরে ওঠার, সারিয়ে তোলার আখ্যানই একমাত্র তাঁর (এবং কিটঁর) নিজের বেঁচে ওঠার ইস্তাহার হতে পারত।

আরও পড়ুন
নেড়ি কুত্তা

 

এমন আখ্যানের সঙ্গীত-- দ্য টেরি থিম-কেই ডেজ-এর জন্য বেছে নেন সাই মিং-লিয়াং। (এই সঙ্গীত তাঁর আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্লিপ আলোন (২০০৬)-এর একটা চৈনিক সংস্করণের শেষেও ব্যবহৃত হয়েছিল।) একটা চূড়ান্ত ব্যস্ত মেট্রোপলিটন শহরে দু’জন একা মানুষ। সকালের ব্যস্ত রাস্তাতেও যখন লীকে হাঁটতে দেখা যায় তখনও শুধু তাকেই, তার মুখকেই একমাত্র দেখানোর চেষ্টা করা হয়, ক্যামেরা কাঁধে তাকে অনুসরণ করতে করতে। রাস্তার ভিড় একটা আবদ্ধ পরিসরের (ক্র্যাম্পড স্পেস) দ্যোতনা নিয়ে আসে। এমনকি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করেন যখন লী তখনও তাকে দেখা যায় একটা ডাচ শটে, বেমানান কৌণিকতার অস্থিতিশীলতায়। (এমন শট লিয়াঙের আর কোনো ছবিতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।) খেয়াল করার কথা হল এই, যে আধুনিকতম শহরের মধ্যে ঘোরাফেরা করেও এ ছবিতে মোবাল কি ল্যাপটপ কি অন্য কোনও ‘ফাস্ট-স্মার্ট-গ্যাজেটের’ উপস্থিতি যেমন নেই, তেমনই কারুর সঙ্গে কথা (শেয়ার বা কম্যুনিকেট অর্থে) বলেনা এই চরিত্রেরা। তারা কি প্রকৃত অর্থে কথা বলতে ভুলে গেছে, নাকি কখনো বলেই দেখেনি? তারা কি স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছে যোগাযোগের চারপাশ থেকে? অথচ স্বাতন্ত্র নির্মানের কোন চেষ্টাও নেই। তাদের দেখে আপাতভাবে হতাশ ব’লেও মনে হয়না একেবারেই। তাদের একাকীত্ব নিয়ে কাউকে অভিযোগ জানাচ্ছে না তারা। আসলে চলচ্চিত্র থেকে অর্থ-নির্মাণের এই খেলার বাইরে থাকতে চেয়েছেন লিয়াং। কিন্তু অসুখ থেকে সেরে উঠতেই হবে যে! লাইমলাইটে বয়োজ্যেষ্ঠ যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বের বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায়, যে নৈতিকতার আবহে; ডেজ-এর ২০২০-র এশিয়ায় সে দায়িত্ব বর্তায় কনিষ্ঠের কাঁধে, অর্থের বিনিময়ে। আর তাই হয়ত পরিচর্যা থেকে উপশম হয়ে আনন্দে (প্লেজার)-র বারান্দায় পৌঁছে যান লিয়াং। কনিষ্ঠটি দেয় রতিসুখ, আর জ্যেষ্ঠ দেন সঙ্গীতরস-- আনন্দের দুই সর্বনাম। ‘আরোগ্য’ লাভার্থে স্পর্শানুভূতির দিনলিপি অভিজ্ঞতা করি আমরা। (লিয়াঙের বেশীরভাগ ছবিতে সম হোক বা বিষম, যৌনক্রিয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে এসেইছে।) কিন্তু সবশেষে আনং রাস্তার ধারের বেঞ্চে চ্যাপলিনের সঙ্গীত চালিয়ে বসে থাকলেও সে শব্দ চাপা পড়ে যায় সশব্দ যানবাহনের চলাচলে। আরোগ্যের সাধ থাকলেও, সাধ্য কি আছে এই সামাজিক-দূরত্বকালের?

আরও পড়ুন
নয়নসুখ

Powered by Froala Editor