স্বপ্নোন্মাদের মৃত্যু

ছায়াছবি-কথা - ৯

আগের পর্বে

২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘হানিল্যান্ড’ ২০২০ অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে প্রথমবার কোনো চলচ্চিত্রের কপালে উঠেছিল একইসঙ্গে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র ও ‘কাহিনিচিত্র’-এর মনোনয়ন। হানিল্যান্ডের পরিচালকও দু’জন তামারা কটেভস্কা এবং জুবোমির স্তেফানভ। দেড় ঘণ্টার এই চলচ্চিত্রের পিছনে লুকিয়ে ছিল ৪০০ ঘণ্টার শট। তিন বছর ধরে চলেছিল বাস্তবকে লেন্সবন্দি করার কাজ। 

যে ভারতীয় সমাজ রাষ্ট্রীয় এবং রাষ্ট্রিক আদর্শের আত্মিকরণ করে ভেতর থেকে হিংস্র হয়ে উঠেছে, সেই হিংসাত্মক সমাজটার ওপর তীব্র ঘৃণা উগরে দিচ্ছেন স্রষ্টা। গত কয়েক বছরে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক হিংসার সাধারণ ভিডিও, টেলিভিশন ফুটেজ, ফেসবুক ফুটেজ জুড়ে জুড়ে তিনি নির্মাণ করছেন হিংস্রতার আখ্যান। সানাল কুমার শশিধরণ ২০১৯ সালে বানিয়েছেন তাঁর চতুর্থ পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি-- ডেথ অফ ইনসেন। এ ছবিকে যে কেউ সৃষ্টি-প্রেম-স্বপ্নের বিরুদ্ধে হিংস্রতা বিষয়ক তথ্যচিত্রও বলতে পারেন। 

এক কথায় বলতে গেলে, এ ছবি-- এক চলচ্চিত্রীয় বিক্ষোভ। এ ছবির শুরুতেই ঈশ্বর এবং ভারতমাতার প্রতি প্রণাম নিবেদন করে শপথ নেওয়া হয় যে-- এই ছবি কোনো ঈশ্বর বা ধর্মকে আহত করবে না। এবং মনে করিয়ে দেওয়া হয়-- “স্বপ্ন দেখা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর”, আর তাই “এই ছবি কোনো স্বপ্ন উদ্রেক করতে চায়না।” এরপর বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত উপত্যকায় উন্মাদকে দেখা যায়। তারপর ক্যামেরা চলে আসে মন্দিরের গায়ের সেই সব শৈল্পিক রিলিফ অথবা ভাস্কর্যের ওপর যেগুলোর আধ-ভাঙা শরীরে লেগে আছে ঐতিহাসিক হিংস্র আঁচড়ের চিহ্ন। শব্দের মাধ্যমে আমরা পরিচায়িত হই সেইসব ধ্বংস-পর্বের সঙ্গে।

২০১৪ থেকে যে ফ্যাসিস্ত শক্তি ভারতের ক্ষমতায়, সেই শক্তির ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে কলেজে পড়াকালীন সময়ে যুক্ত থাকা শশিধরণের ছবি মুক্তি পেতে দেওয়া হয়নি, চলচ্চিত্র উৎসবে দেখতে চাওয়া হয়েছে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র, সহ্য করতে হয়েছে নানা ধরণের আক্রমণ। সে সমস্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া সম্মিলিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে মনে হয় এই ছবিতে। এক অর্থে এই ছবি শিল্পের স্বপ্নের বিরুদ্ধে হিংস্র প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বের এক আখ্যানও বটে।

 

আরও পড়ুন
মধুর রাজ্য

কাহিনির অংশের পেছনে পেছনে ভেসে আসতে থাকে আবহকণ্ঠ। সেই অপ্রত্যক্ষ স্বর গপ্পো বলার ঢঙে “অনেক অনেক দিন আগে” ব’লে শুরু ক’রেই বলে-- “মানে গতকাল।” অর্থাৎ স্বপ্নের আর স্বপ্ন-বিরোধী হিংসার যে এক নিরবচ্ছিন্ন ক্রম আছে তা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। আর ইতিহাসের হিংসাকে দেখতে গিয়ে যেভাবে গতকালের হিংসাকে (অথবা উল্টোটা) ভুলে যায় সভ্যতা, কিমবা বৈধ মনে করে বসে, সে ভাবনাঢঙের ইঙ্গিত শুরুতেই পাওয়া যায়। এরপর একের পর এক আসতে থাকে কেরালার ‘প্রেমের চুম্বন আন্দোলন’-এর ওপর পুলিশি জুলুমের ফুটেজ, জয়পুর সাহিত্য উৎসবে নির্দিষ্ট চিত্রকলার বিরুদ্ধে আক্রমণের ফুটেজ, কোচির সমুদ্রতটে বন্ধুদের ওপর আক্রমণের ফুটেজ, ‘ওয়ান পার্ট ওম্যান’ বই-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ফুটেজ, পদ্মাবত-এর সেটে পরিচালকের ওপর আক্রমণের ফুটেজ, গৌরী লঙ্কেশ সহ বিভিন্ন চিন্তাশীল মানুষদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ফুটেজ, রাজস্থানের দম্পতীকে উলঙ্গ ক’রে ঘোরানোর নির্মম-নীতিপুলিশির দৃশ্য (এই অংশটা পুনর্নির্মিত)।

 

আরও পড়ুন
ক্যামেরার মৃত্যু, ছবির জন্ম

হঠাৎ একটা শট মাটির উচ্চতা থেকে ঐন্দ্রজালিক কায়দায় গাছের ডালপালা ভেদ ক’রে লোহিতগাত্র স্বপ্নখ্যাপার গান-বাজনা দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে জঙ্গলের মাথায় উঠে যায়। টিলার ঘনসবুজ জঙ্গল রং বদলে লালবর্ণ হতে থাকে, ঠিক যেন ভয়ানক রাগী একটা কবিতা প্রত্যক্ষ করছি আমরা ‘নিরাপদ’ দূরত্বে বসে। “ডিম ফুটে বেরোনোর পর আর কেউ তাকে ডিম বলে না” যেহেতু, তাই স্বপ্ন সাকার করতে মানুষ যা করে তাকে তো আর স্বপ্ন বলা যায় না। তাই স্বপ্ন মোতাবেক ক’রে ফেলা কিছু, কর্তৃপক্ষের না-পসন্দ্‌ হলে শুরু হয় দুঃস্বপ্নের কালপর্ব। স্বপ্ন সংক্রামক। স্বপ্নের নিষিদ্ধ ইস্তেহার বিলি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অনাম্নী স্বপ্নখ্যাপা। উন্মত্ত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে স্বপ্ন শিকারে (ড্রিম হান্টিং) বেরোয় ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র। সে এক গণ-উন্মাদনা। ওদিকে কেরালার রাস্তায় সানি লিওনকে একটিবার দেখতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় যে গণ-উন্মাদনা, তাকে অবশ্য নির্মান করে নির্মম নিরাপত্তায় লালন করে কর্পোরেট-পুঁজি ও রাষ্ট্র। আবহকন্ঠ বলে, “পৃথিবীটা দু’টো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক দল স্বপ্ন দেখে আর এক দল স্বপ্ন দেখে না।”

 

আরও পড়ুন
নৈঃশব্দ্যের বৈধব্য

দুঃস্বপ্নের কালপর্বের মাঝেমাঝে আসতে থাকে স্বপ্ন-দেখার, স্বপ্নখ্যাপার মুহূর্তগুলো। অর্থাৎ এই যে অশান্ত সময় আর স্বপ্নের যাত্রাকে (জার্নি অর্থে) পাশাপাশি রেখে এক আখ্যান নির্মাণ, পাঠক ক্ষমা করুন, অন্য দু’টো ছবিকে পাশে রেখে প’ড়লে প্রাসঙ্গিকতা ঠাওর করতে সুবিধে হতে পারে। ১৯৭৪ সালে একটা ছবি তৈরি হচ্ছিল, যেখানে নীলকণ্ঠ বাগচী নামক একজন ‘ভাঙা বুদ্ধিজীবী’ এক যাত্রায় বেরিয়েছিলেন; যার পথে পথে ছড়ানো ছিল শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, অতি-বাম বৈপ্লবিক প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। এ সবকিছু সম্পর্কেই ঈষৎ বীতশ্রদ্ধ ‘চূড়ান্ত বিভ্রান্ত’ নীলকন্ঠ দেখছিলেন নিজে পুড়ছেন, ‘ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে’। শিকড়ের প্রতিস্পর্ধা দেখছিলেন দেশজ কৃষ্টিতে। আশার, নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসার কিছু যদি থাকে, তা দুর্গায় শুরু হয়ে ‘বঙ্গ’বালায় মা-এর রূপে অধিষ্ঠিত থাকতে দেখেছিলেন স্বপ্নালু নীলকণ্ঠ। নীলকণ্ঠও স্বপ্নখ্যাপা বলেই তাঁর মৃত্যু আসে রাষ্ট্রের বুলেট সেজে, সমাপতনের ছদ্মবেশে।

 

আরও পড়ুন
ঈব আল্ল ঊউ

এর এক দশক পর পুরুষম (পুরুষ) দিল্লি যাওয়ার জন্য মা আর প্রেমিকাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, হরির মৃত্যুসংবাদ তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ঘুরতে থাকে পথে পথে। এই পথের পাশে পাশেও চলতে থাকে ডাক্তারি-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, জেলেদের আন্দোলন, মেয়ে-শ্রমিকদের আন্দোলন, নাট্য আন্দোলন, পাথর শ্রমিকদের আন্দোলন, রেশন বিদ্রোহ। আর উল্টোদিকে রাষ্ট্রের পুলিশের তরফে অমানবিক, অকথ্য অত্যাচার। মৃত হরিও ছিল এক স্বপ্নখ্যাপা। হরি স্বপ্ন দেখত ‘পৃথিবীটা সাজাবার’। কারোও কাছে হরি পরিচিত ছিল তবলাবাদক হিসেবে, কারোও কাছে মৃদঙ্গমবাদক হিসেবে, কারোও কাছে সাচ্চা বিপ্লবী হিসেবে। এই একক স্বপ্নখ্যাপার মৃত্যু বহুর মিছিলে লীন হয়েছিল। এখানেও অসাধারণ সব মায়েরা ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন জাত-ধর্মের। সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের আখ্যানের পাশাপাশি এখানেও (বাম) রাজনৈতিক অনুশীলনকে, অ-রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানকে প্রশ্নে-সমালোচনায় ফালাফালা করা হয়। একটা সময়ের নাড়ির স্পন্দনকে পড়তে গেলে, এমন সব সমাজ-রাজনৈতিক শৈল্পিক ভাষ্য ধরা পড়ে, সময়ের জলজ্যান্ত দলিল হিসেবে। শুধু জলজ্যান্তই নয়, রক্তাক্তও হয়তো; যখন ঋত্বিক ঘটক বলেন-- “শিল্প মানে লড়াই”। 

 

আরও পড়ুন
৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন

আর তাঁর ছাত্র জন আব্রাহাম তাঁর দর্শকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চান-- “তোমরা কি চাও এই দমনপীড়নটা চলুক? তোমরা কি মুক্তি চাও না? তোমরা স্বাধীনতা চাও না? তোমাদের কি খাদ্যের প্রয়োজন নেই? তোমরা কি ভাগ্যের কাছে নতিস্বীকার করবে?” তাই তো মায়ের কাছে পৌঁছোতে চাওয়া ক্যামেরা সদাচঞ্চল, অস্থির। আর শতাব্দীর এ পাড়ের সানালের ছবি নির্মোহ উচ্চারণ করে-- “আজ স্বপ্নখ্যাপাদের অস্তিত্ব ভয়ানক বিপন্ন। চারদিকে তাই শ্মশানের নিরবতা। রাষ্ট্র সার্থক হয়েছে চিরতরে স্বপ্নকে নির্বাসিত করতে। প্রাচীন গুহাচিত্র আবিষ্কার করে ইতিহাসবেত্তারা একদিন বলবেন-- বহু যুগ আগে এখানে স্বপ্নের উদ্যান ছিল।” ভবিষ্যদ্রষ্টার কথা শুনেও আমরা ভাবিনি। ভাবা প্র্যাক্টিস করিনি। তাই তো স্বপ্নখ্যাপার উলঙ্গ নিঃসঙ্গ রক্তাক্ত লাশ প’ড়ে থাকে নির্জন সমুদ্রতটে। গত শতাব্দীর প্রতিরোধের আখ্যান এ শতাব্দীতে দক্ষিণপন্থী জলহাওয়ার ফুলেফেঁপে উঠেছে, গঙ্গার জলে ভেসে যাওয়া মৃত শ্বাপদের পচা দেহের মতো। সে শতাব্দীর বিভ্রান্তি, হতাশা আজ যন্ত্রনার গ্লানিতে-ক্লিন্নতায় অবশ। অতিমারীর বিচ্ছিন্ন-বাস্তবতার দিকে ধাবমান সময়ের এ ছবিতে মা আর চেয়ে থাকে না, পথ। 

 

‘স্বপ্নোন্মাদের মৃত্যু’ দর্শকদের সরাসরি আক্রমণ করে বসে। খুব বেশীক্ষণ নিজেদের বিবেকের দিকে ঠায় চেয়ে থাকতে হয় বলে অস্বস্তি উদ্রেক করে। হিংস্রতার পুনরাবৃত্তি বিপন্ন, অসাড় করে তোলে আমাদের ধমনি। স্বপ্নখ্যাপা তারাই, যাদের স্থানাঙ্ক নির্ণয় করতে না পারে রাষ্ট্র, না পুঁজি, না সমাজ। তাই তো “বিশ্বভরা প্রাণ”-এর বিস্ময়ে রবি ঠাকুরের বিশুপাগল পুলকিত হয়ে ওঠে শিশুর মতো-- যে শিশু দেয়ালায় হেসে ওঠে স্বপ্নখ্যাপার স্বপ্ন দেখে।

[উল্লেখিত অন্য দু’টি ছবির নাম-- যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭), আম্মা আরিয়ান (১৯৮৬)]

Powered by Froala Editor