নৈঃশব্দ্যের বৈধব্য

ছায়াছবি-কথা - ৩

আগের পর্বে

ঈব আল্ল ঊউ। প্রতীক বৎসের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের হিন্দি চলচ্চিত্র। সিনেমার প্রেক্ষাপট একেবারেই বাস্তবভিত্তিক। কয়েকবছর আগে দিল্লি হঠাৎ করেই ভরে উঠেছিল হনুমান, বাঁদরে। আর এই বাঁদর তাড়াতেই মহিন্দর নামের এক ব্যক্তিকে কাজে লাগানো হয়। ভুলবশত একটি হনুমানকে মেরে ফেলে মহিন্দর। তারপর গণপ্রহারে তাঁর মৃত্যু। অন্যদিকে আরেক প্রধান চরিত্র আঞ্জানাকে বাঁদরের বহুরূপী সেজে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বন্দি হতে হয় খাঁচায়। ছবিতে অ্যাবসার্ড রিয়ালিজমকেই ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। চেয়েছেন প্রতীকসর্বস্ব রাজনীতিকে সরাসরি প্রত্যাঘাত করতে।

শিক্ষানবিশ নার্স আসিয়া, অসুস্থ বৃদ্ধা শাশুড়ি আর ১১ বছরের মেয়েকে নিয়ে কাশ্মীরের একটা পাহাড়ি গ্রামে থাকে। সাত বছর আগে আসিয়ার স্বামীকে ভারতীয় সেনা তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে বিভিন্ন সামরিক, প্রশাসনিক দপ্তরে ঘুরে বেড়িয়ে; অনেক টাকা খরচ করেও স্বামীর কোনও খোঁজ না পাওয়ায় আসিয়া স্থানীয় করণাধ্যক্ষের (রেজিস্ট্রার) কাছে যায় স্বামীর মৃত্যুর শংসাপত্র চাইতে।
“কাশ্মীরের ‘অর্ধ বিধবাদের’ অনেক সত্য ঘটনা অবলম্বনে”, ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার আন্তর্জাতিক বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকের সামনে আসে প্রবীন মোর্চালে লিখিত ও পরিচালিত তৃতীয় ছবি উইডো অফ সায়লেন্স (৮৫ মিনিট, হিন্দি মিশ্রিত উর্দু)।

প্রথম শট থেকেই সরাসরি কাশ্মীরের উপত্যকার (মেয়েদের) আত্মাকে ছুঁয়ে থাকে এই ছবি। চেয়ারে বসে থাকা এক অশীতিপর বৃদ্ধাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়, আলগাভাবে, আমরা দেখি। জানলায় রাখা টবে দেওয়া হয় অল্প জল। তারপর অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে স্থানীয় এক ভাড়া জিপ গাড়িতে বেরিয়ে পড়ে আসিয়া। ভূস্বর্গের নিসর্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে জিপ এগোয়। রসিক ড্রাইভার ব’কে চলেন-- “নৈশব্দে মানুষ ভাবার অবকাশ পায়। এখানে কেউ নৈশব্দ চায় না। না এ-পক্ষ, না ও-পক্ষ। রোজ সশব্দ এখানে বন্দুক।” প্রত্যেকদিনের মতো মিলিটারি চেকপোস্ট আসে। সন্দিগ্ধ রাইফেল পরিচয়পত্র শোঁকে নাগরিকের।
তফাতে দাঁড়িয়ে থাকে ক্যামেরা। দুয়েকটি ক্ষেত্র বাদ দিয়ে সাধারণত সামান্য নড়াচড়া করে শুধু তখনই যখন উত্তর কাশ্মীরের রুক্ষ পাহাড়, শরতের উপত্যকা আর পাকদণ্ডীর সোনালি গাছপালা পাশে রেখে ছুটে চলে জিপ। সানাল জর্জের করা শব্দ-পরিকল্পনায় দৃশ্যানুগ (ডায়জেটিক) শব্দ কানে রেখে আমরা পৌঁছোই পুলওয়ামা শহরে, রেজিস্ট্রারের অফিসে।

অফিস-বারান্দায় শিশু-কাঁখে হাপিত্যেশি মেয়েদেরই ভিড় শুধু। মঙ্গল আর বুধবার শুধুমাত্র এইসমস্ত ‘অর্ধ বিধবা’-দেরই দেখা করার দিন। সরকার বাহাদুর বৃহস্পতিবারকেও এই তালিকাভুক্ত করবেন শিগগিরিই। আসিয়াদের ১/৩ একর জমি তাঁর বন্ধুর কাছে বেচে দেওয়ার আবদার করেন রেজিস্ট্রার। তিনি নিজে নিয়ে থাকেন মাত্র ২০%। (তখনও ৩৭০ ধারা বিলোপ হয়নি কিন্তু!) এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা বেকার চাষি স্বামীর মৃত্যুর নিশ্চিত সরকারি শংসাপত্র পেয়ে নতুন জীবন শুরুর সম্ভাবনাপূর্ণ “সুন্দরী, শিক্ষিতা” আসিয়ার থেকে এটুকুই আপাতত চান রেজিস্ট্রার।


 

আরও পড়ুন
ঈব আল্ল ঊউ

রেজিস্ট্রারের চরিত্রে অজয় চৌরে, যিনি আবার এই ছবিসহ প্রবীণের সব ছবিরই মূল সহকারী পরিচালকও বটে। চৌরে বা আসিয়ার চরিত্র বাদ দিয়ে এ ছবির অন্যান্য অভিনেতারা কেউই পেশাদার নন। এ ছবির মূল শক্তির জায়গা এর আখ্যান এবং আখ্যান নির্মাণের সহজতা আর সামান্যতা (মিনিমালিজম)। প্রতীকী শটের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত ড্রাইভার (অভিনেতা-- বিলাল আহমেদ, বাস্তব পেশায় বাস-ড্রাইভার) কিমবা রেজিস্ট্রারের মুখে দার্শনিক-কবি অথবা উত্তর-সম্পাদকীয়সুলভ সংলাপ, ছবিটাকে ঈষৎ প্রচারমূলক করে তোলে। ঐস্লামিক প্রথা নিয়ে এক যাত্রিণীর সংলাপও নাটকীয় বিভ্রমের পর্দার বুনোটকে আগলা ক’রে দেয় কোথাও। মার খায় ‘শৈল্পিক’ সুক্ষতা। একইভাবে, যে উপত্যকার ঘরে ঘরে ‘অর্ধ বিধবা’-দের বসবাস, সেখানে আসিয়ার মেয়েকে তার স্কুলের সহপাঠিদের দ্বারা তার বাবার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে যথেচ্ছ বিরক্ত করাকে সস্তা ভিক্টিমহুডের চেনা ছক বলেই মনে হয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিচালকের বিষয়ীতার অতিউপস্থিতি আর ক্যামেরাকে অদৃশ্য ক’রে রাখার সিদ্ধন্তের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে যায়।

এখানকার মানুষেরা বাঁচে, রাষ্ট্রীয় অবিশ্বাসের বাতাবরণের বাইরে, স্বাভাবিক পারস্পরিকতায়। এখানে সরল বিশ্বাসে সাইকেল কেনা যায় সম্পূর্ণ  ধারে, বিনি পয়সায় চ’ড়ে ফেলা যায় গাড়ি, অন্যের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় গাড়ির সিট। ‘সব জেনেও’, আসিয়ার পাণিগ্রহণে প্রস্তুত হয় আরও এক সাধারণ পুরুষ। “কাশ্মীরের ইসলাম মেয়েদের বৈধব্যের ৪ বছর পেরোলে পুনর্বিবাহ জায়েজ মানে আজকাল”। আসিয়া আতান্তরে থাকে। স্বামী ফিরবেই-- বিশ্বাস তার। যদিও গত ৩০ বছরে এমন একটাও ফিরে আসার ইতিহাস সে জানেনা। তার সহকর্মীর স্বামীও ফেরেনি। মেয়েটার স্কুলের মাইনে বাকি পড়তে শুরু করেছে। মেয়েটা জানে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার পর ইস্তক ঠাকুমার কথা বন্ধ। তাও সে স্বগতোক্তির মতো জিগ্যেস ক’রে চলে-- “আমার বাবা কি খারাপ লোক ছিল?” মাকে বলে, “সরকার কোথায় থাকে আমায় বলো, আমি তাকেই জিগ্যেস করব।” মহাকর্ষের টানে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর পাশে ব’সে সে বাবার ছবি ছিঁড়ে ফেলে আর ছেঁড়া চার টুকরো বাবাকে জোড়া দেয়। এ মেয়েকে কি আমরা ‘অর্ধ কন্যা’ বিশেষণ দেব? পরিচয়হীনতার বিশেষণ হয়!

আরও পড়ুন
৪ মাস ৩ সপ্তাহ ২ দিন

ওদিকে অফিসের দেওয়ালে গান্ধী-নেহরুর ছবি টাঙিয়ে রাখা তিন কন্যার পিতা-- রেজিস্ট্রার আসিয়ার সঙ্গে শুতে চায় এবার। আসিয়ার কর্মক্ষেত্র-- ট্রমা সেন্টারে গভীর রাতে চ’লে গিয়ে তার গায়ে হাত দেয় সে। প্রতিক্রিয়ায় মেলে সপাট চড়।
উত্তেজিত হয়ে ওঠেনা ক্যামেরা। ভালো করে। আরও ভালো হত যদি সরকারী ধর্ষকামী পিতৃতন্ত্রের রূপটা এমন সরলরৈখিক চিত্রায়নের উত্তেজনার দ্বারা তাড়িত না হতেন পরিচালক। নির্ভয়া-যৌনহত্যা ঘটনা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শরিক, থিয়েটার-কর্মী শিল্পী মারওয়াহা অভিনয় করেছেন আসিয়ার চরিত্রে। তিনি জানেন চোয়াল ঠিক কতটা শক্ত রাখতে হয়। কাশ্মীরের মেয়েদের ‘অর্ধ পরিচিতির’ নিঃশব্দ বারোমাস্যা বোনার দায়িত্ব শিল্পীর। মনের ঝড় দ্রাসের নিরিবিলি উপত্যকায় (ওখানেই শুটিং হয়েছিল) সংযত গতিতেই থাকে, অ্যান্থনি জোসেফের সম্পাদনায়, গতানুগতিক সম্পাদনারীতি মেনেই।

জিপের সহযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করেন নিচু স্বরে। তাঁরা খেদ প্রকাশ করেন, “কৃষি আর লাভজনক নয়”। তাঁরা বলেন, “কেউ কাউকে মারে না। সরাসরি স্বর্গে পাঠানোর এক পদ্ধতিমাত্র”। তাঁরা প্রশ্ন করেন, “বুলেট ট্রেন থেক বুলেট বেরোবে কিনা”। জিপের রেডিও জানান দিতে থাকে উরি, কুপওয়ারার নাশকতার কথকতা। রাষ্ট্রীয় বেতার তরঙ্গে ভর করে শবের সংখ্যা ভেসে বেড়ায় এক উপত্যকা থেকে অন্য উপত্যকায়। চেকপোস্ট বাড়তে থাকে। সুসজ্জিত কার্গিল যুদ্ধ সৌধ দাঁড়িয়ে থাকে সদম্ভে। যদিও এখানে মোবাইলে নেটওয়র্ক মেলা ভয়ানক দুষ্কর। ওদিকে দেহ রাখেন আসিয়ার শোকার্ত শাশুড়ি। শোকার্ত কৌম মাত্র তিনটে শটে লুটিয়ে থাকে উপত্যকায়।

 

ইরানের মানুষ মহম্মদ রেজা জাঁহাপনা এই ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফার। এই উপত্যকাকে দেখতে দেখতে ১৯৬০ পরবর্তী ইরানের কিছু চলচ্চিত্রের (পূর্ণ-বাণিজ্যিক এবং ভয়ানক অন্তর্ঘাতমূলক ছবি বাদ দিয়ে) কথা হয়ত মনে প’ড়েও যেতে পারে। তার কারণ শুধু এই নয় যে, উপত্যকার যে অলি-গলি-পাকস্থলীকে উইডো অফ সায়লেন্সে আমরা দেখি তার সঙ্গে ইরানের উপত্যকার দৃশ্যগত সাদৃশ্য অথবা এক অর্থে কাব্যিক বাস্তববাদী আঙ্গিকে মেদহীন সহজতায় প্রান্তের উপাখ্যান নির্মাণের সাদৃশ্য। পরিচালকের ওপর সে দেশের চলচ্চিত্র ও অন্যতম চলচ্চিত্রকারের প্রভাব আরেকটা এর বিশেষ কারণ। (সে গুরুভক্তির আলোচনা অন্য লেখায় করা যাবে।) হায়দার (২০১৪)-এর মতো মূলধারার বাণিজ্যিক কাহিনিচিত্রের কথা বাদ রাখলে মোটামুটি গত দশক থেকে হারুদ (২০১০), হাফ উইডো (২০১৭), হামিদ (২০১৯)-এর মতো কিছু ভারতীয় কাহিনিচিত্রে উপত্যকার কান্নার শব্দ, ১৯৮৯ পরবর্তী উপত্যকার আজাদির আকাক্ষার কথা আমরা শুনতে পাইনি, তা নয়। তবে সে সবই মূলত মেলোড্রামার ছন্দে। উইডো অফ সায়লেন্সে ডাল লেক নেই, বরফকুঁচি নেই, নেই মিলিটারি-জিহাদি-জাতীয়(বিচ্ছিন্ন)তাবাদের ছদ্ম-রাজনৈতিকতা। এ ছবির রাজনীতি আঁকা থাকে ক্লোজ আপ শট দিয়ে উচ্চকিত রাজনৈতিক সাধারণীকরণ না করার বোধে। এই ছবিতে কাশ্মীর, ক্যালেন্ডার আর্টের ছবির মতো শুধুই দৃশ্যসুখ দেওয়ার দৃশ্যপট হয়ে না থেকে, ছবিটার এমন ছন্দ-লয় নির্মাণে ছবিটাকে বাধ্য করে। বলা যায়, আখ্যানের রচনাকার এই উপত্যকা। এখানে উপত্যকাকে অন্দরমহল থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়, এর দূরবর্তী-পর্যবেক্ষকসুলভ এবং অ-ঈক্ষণকামী (নন-ভয়ারিস্টিক) দৃষ্টিধরণের জন্য। কাশ্মীরীদের উদ্ধারকর্তা হয়ে উঠতে চায় না এই ছবি। পড়ে থাকা নৈশব্দই পাহাড়া দেয় অর্ধ-বৈধব্যের উপত্যকা। তাই তো এঁদের বেঁচে থাকতে হয় জীবন্মৃত হিসেবে, অথবা একমাত্র ম’রেই প্রমাণ করতে হয় যে এঁরা বেঁচে ছিলেন।

Powered by Froala Editor