সপ্তম চরণ

ছায়াছবি-কথা – ১৪

আগের পর্বে

সিনেমার ভেতরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক-সহ সমস্ত কলাকুশলী। মমতা মূর্তি পরিচালিত ‘ফ্রায়েড রাইস, চিকেন স্যুপ অ্যান্ড আ প্রিমিয়ার শো’ সিনেমার মূল বিষয়ই ছিল এমন। আর এই পরিবেশেই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে মণিপুরী ছবিটির প্রেক্ষাপট। এসেছে তার অতীতের কথা, প্রশ্ন উঠেছে ভবিষ্যৎ নিয়েও। সেখানকার সেন্সরের ধাক্কায় আটকে গেছে বহু ছবি। তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক মৌলবাদ। সিনেমা তৈরির স্বাধীনতা বারবার হোঁচট খায় সেখানে। পুরনো সময়ের দিকে তাকালেও অনেক উদাহরণ দেখা যাবে। এসব কাটিয়ে ভবিষ্যতের দিকে কীভাবে এগোবে মণিপুরের চলচ্চিত্র, সেটাই ভাবার বিষয়।

একটা জংলা-সবুজ আবহাওয়া। রোদ্দুর যত তীব্র, সবজে-আঁধার ততই জমাট। নদীর কুলকুল শব্দে ভিজে থাকে অরণ্য। আরণ্যক ঝিঁঝিঁর সশব্দ তপস্যা ভেঙে শাব্দিক উড়ে বেড়ায় অদৃশ্য চঞ্চল ভ্রমর। পাইনের পত্রবৃন্ত বেয়ে ওঠে ময়ুরের কেকাধ্বনি। বৃক্ষের শরীর জুড়ে নীল-সাদা-সবুজ ছোপ রেখে গেছে সময়। স্পর্শযোগ্য টুপ-জলে নেচে ওঠে আকাশ-লহরী। বাঁশপাতা-ভাসা তল থেকে গভীরে চোখ ডোবালে, জলের কোলে লাল-সাদা ঘুমন্ত নুড়িপাথর। সেই নুড়ি-কুড়ানো জলে ছায়া পড়ে চিত্রকরের। প্রাকৃতিক নিসর্গের মাঝে রসদ খুঁজে ফেরেন তিনি।

অমিত দত্ত নির্মিত তথ্যচিত্র দ্য সেভেন্থ ওয়াক (২০১৪)। চিত্রনাট্য রচনায় শ্রী দত্ত ও ঐশ্বর্য শংকরনারায়ণন। এক চিত্রকর, তাঁর চারপাশ দেখা ও ছবি আঁকা-- এ ছবির বিষয় (অধিতথ্য থেকে আমরা জানতে পারি সেই চিত্রকর, চিত্রকর-অধ্যাপক পরমজিত সিং)। বিষয়-- ছবির আঙ্গিকটাও। যে রং-ছন্দ-গতি-শব্দে ছবিটা নির্মিত সেটাই মূলত ছবিটার সবকিছু। পরমজিতের জীবন বা তাঁর অঙ্কনপ্রণালী সম্পর্কিত কোনো আক্ষরিক তথ্য এ ছবিতে অনুপস্থিত। সে অর্থে বলা যেতে পারে এক চিত্রকরের চিত্রকলার প্রত্যক্ষ মানস-উপাদানের সঙ্গে তাঁর চিত্রপটকে মিলিয়ে দেখাই এ ছবির উপজীব্য। শ্রী দত্ত এ ছবি যখন করছেন তার আগে পর্যন্ত যে দু’জন চিত্রকর (‘জনগঢ় কলম’ চিত্রকর জনগঢ় সিং শ্যাম ও ‘পাহাড়ি’ চিত্রকর নয়নসুখ)-কে নিয়ে তিনি ছবি করেছিলেন, ঘটনাচক্রে তাঁরা কেউই আর জীবিত ছিলেন না তখন। সে দিক থেকে একজন জীবিত শিল্পীকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে তাঁর চিত্রকলা নিয়েই ছবি, এ তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতায় ছিল না (পরমজিতের বয়স তখন ৭৮)। পরে অবশ্য তিনি বিখ্যাত চিত্রকর রাম কুমার-কে নিয়ে লাল ভি উদাস হো সাক্তা হ্যায় (২০১৫) ছবিটা করেছিলেন।

 

ইতালিয় চিন্তক রিচ্চত্তি চানুদো চলচ্চিত্রকে সপ্তম শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। স্বভাবতই চিত্রকলার স্থান বেশ কিছু ধাপ অগ্রবর্তী। বিশ্বে চিত্রকর এবং/অথবা চিত্র(কলা) বিষয়ক ছবি অনেক হয়েছে। সে সব ক্ষেত্রেই মূল লক্ষ্যণীয় থেকেছে এক শিল্পকলাকে অন্য মাত্রার একটি শিল্পকলার মাধ্যমে কীভাবে দেখা যাবে, পড়া যাবে। প্রথম শিল্পমাধ্যমটির সঙ্গে ঠিক কেমন সম্পর্ক হবে দ্বিতীয় মাধ্যমটির, এ কাজে হাত দিয়ে কতটা স্বাধীন নান্দনিকতার প্রকাশ করতে পারবেন চলচ্চিত্র পরিচালক-- সেটাই হয়ে থাকে অন্যতম বিচার্য প্রশ্ন। সবচেয়ে সমস্যায় ফেলে স্থান-কালের প্রেক্ষিত। বর্তমানে আলোচ্য ক্ষেত্রে সম্ভবত সময়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয় স্থানের প্রশ্ন। নয়নসুখ (২০১০), জনগঢ় ফিল্ম এক (২০০৮)-এর পরিচালক শ্রী দত্ত চিত্রকর পরমজিতকে দেখান সেইসব স্থানের প্রেক্ষিতে যেমন স্থান পরমজিতের ক্যানভাসে আমরা দেখতে পাই। পরিচালক জানেন যে চিত্রকলার স্বাদ চলচ্চিত্র মাধ্যমে দেওয়া বা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি আবিষ্কারে মগ্ন হন এমন এক ক্যামেরাভঙ্গিমার, সম্পাদনাভাষার (বর্তমানে আলোচ্য ছবির সম্পাদনা করেছেন তিন্নি মিত্র) যেখানে তুলির টান আর ক্যামেরার চলন এসে মেশে অসম্ভব এক বিন্দুতে। হিমালয়ের পাহাড়ী ঘাসের ওপর দিয়ে, গাছের গুঁড়ির গা ঘেঁষে অর্কিডে দোলা লাগিয়ে ক্যামেরা ভেসে বেড়ায়। ক্যামেরাটা হঠাৎ ঘাড় বেঁকিয়ে সটান সরলরেখা বরাবর এগোতে থাকে। বিচিত্র কৌণিক শট লো অ্যাঙ্গল থেকে টপ অ্যাঙ্গল এবং প্যান একসঙ্গে করতে করতে কোমর মোচড়ানো নৃত্যভঙ্গিমায় আয়োজন করে প্রাগৈতিহাসিক স্থানের আধুনিকোত্তর পুনর্দর্শন। বিপুল প্রকৃতির অংশ হিসেবেই যেন “চিলেকোঠায় ব’সে” এঁকে চলেন শ্বেতশুভ্র প্রৌঢ় চিত্রকর। ক্যামেরা মাটির ফুল ছুঁয়ে দোতলার বারান্দায় চিত্রকরের কাছে এক মুহূর্তের জন্যও না থেমে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আকাশে চ’লে যায়, ঠিক যেভাবে সবেগে একটা ফুলকে শিকড়হীন করি আমরা। কখনও বা একই রেখার ওপর বারবার তুলির টানের মতো একই দৃষ্টিপথে ক্যামেরা পূর্বাপর বয়ে চলে, চন্দ্রাহত তুলির টানের মতো। গাছের গুঁড়ির ওপর দিয়ে চলা কোনও শটে কি গাছে চড়ার অভিজ্ঞতার ইঙ্গিতও থেকে যায়! আশ্রয়ের ইঙ্গিত ঈষৎ স্থূলভাবেই স্পষ্ট। ক্যামেরা কখনো একই পথের অনুবর্তী হয়ে পরেরবার আর একটু দীর্ঘ পথে যায়, একই রেখার ওপর তুলি বোলাতে গিয়ে যেভাবে রেখার দৈর্ঘ কমে-বেড়ে যায়, ঠিক সেভাবে। অনেক সময় ক্যামেরা বা চরিত্রের ক্রিয়া থামার আগেই বদলে যায় শট, বদলে যায় শব্দ; হঠাৎ থমকে যাওয়া তুলির আঁচড়ের মতো। সংযোগ আর বিচ্ছিন্নতার এক বিচিত্র খেলায় মাতে সম্পাদনাশৈলী।

আরও পড়ুন
ধর্মীয় মৌলবাদ এবং চলচ্চিত্র

 

পরমজিত সিং কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র (শিরোনামহীন)

আরও পড়ুন
দিনলিপি

 

বাহাত্তর মিনিট দৈর্ঘের এ ছবিতে না আছে কোনো সংলাপ, না আবহকণ্ঠ। ক্যানভাসের ওপর তেল রং লাগানোর রং-চামচ (স্প্যাচুলা)-এর শব্দ হোক বা চারকোল ঘ’ষে আঁকার আঁচড়ের শব্দ, এমন এক শব্দপট নির্মাণ করে যা সত্তাকে বোধের শক্তিতে ঘিরে ধরে গভীরভাবে। এই শব্দপট তার অন্তঃস্থলে প্রবিষ্ট হতে বাধ্য করে। এছাড়াও ঝিঁঝিঁর ডাক, জলের শব্দ, ঘড়ির কাঁটার শব্দ, ময়ূরের ডাক, পাখির কিচিরমিচির ইত্যাদি শব্দের পাশাপাশি জড়িয়ে যায় এক বীণার স্বর। মোহি বাহাউদ্দিন ডাগরের রুদ্র বীণা। বাস্তবোত্তর মনজগতে নিয়ে যায় সেই শব্দ। আমরা নিমজ্জিত হই সেই সুরতলে। সমান্তরাল দুটো আখ্যান চলতে থাকে যেনবা। একটা দৃশ্যে, অন্যটা শব্দে। “চোখ বন্ধ থাকলে কান যখন শুধুই ভেতরের শব্দ শোনে, তখন ভূমি নদী হয়ে ওঠে” কলকল শব্দে। পাথরও কি প্রাণময় হয়ে ওঠে তখন! শ্রী দত্তের অন্য অনেক ছবির মতোই বেশ কয়েকটি অধ্যায় আছে এ ছবিতেও। “আ টেল অফ টু স্টোনস (দু’টো পাথরের গল্প)” লিখে শুরু হয় যে প্রথম অধ্যায়, সে কিন্তু দু’টো পাথরের প্রচলিত কিংবদন্তির দিকে বেশি ঘেঁষে না। পাথর নাম্নী একটা ছবির সিরিজ আছে পরমজিতের। সেখানে পাথরেরা শূন্যে ভাসমান, হাল্কা শরীরে। শ্রী দত্তের ছবিতে সেই পাথরদের আমরা দেখি স্থিতিশীল অবস্থা থেকে ঐন্দ্রজালিক টানে হাওয়ায় ভেসে অন্যত্র স্থিত হতে। সে কি আধিবিদ্যক চিত্রপটে! অর্থাৎ নিরালম্ব বায়ুভূত পাথরের পূর্ব ও উত্তর অবস্থা দেখি আমরা। শুনি, কেমন শব্দে খানখান হয় তারা। দরজায় দাঁড়িয়ে রোজ দুধ দিয়ে যায় যে কিশোরী, ঠাকুমার হাতে বোনা রঙিন উলের জুতোর স্পর্শ পায়ে পেলে সে উড়ে যেতে পারে বহুদিনের চেনা পথে। সে জুতো পায়ে না থাকলে, মতি চঞ্চলা হলেও তাকে ঠায় ব’সে থাকতে হয় চিত্রকরের মডেলদের অঙ্গবিক্ষেপের ঢঙে। দৃশ্যান্তর হয় মিস্টিক রাইটিং প্যাডের আঙ্গিকে।

আরও পড়ুন
উৎসবে শ্রমজীবন

 

বিশিষ্ট লেখক অমৃত গঙ্গর অমিত দত্ত-র মতো ছবি তৈরীর ধরণকে তার প্রক্রিয়ামূলকতার দিক থেকে দেখে একে “প্রয়োগের চলচ্চিত্র” হিসেবে পড়ার প্রস্তাব করেন। এখানে ‘প্রয়োগ’ শব্দটি নিরীক্ষামূলকতার দিক থেকে আসছে। পরমজিতের চিত্রকলা নির্মাণের প্রক্রিয়াকে শ্রী দত্ত তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রয়োগপ্রক্রিয়ায় দেখেন।

আরও পড়ুন
সেক্সি খেলা

 

ঋতু বদলায়। পাহাড়ের মাথায় বরফের শিরস্ত্রাণ। চিত্রপটের শরীরে ওঠে হলুদের সমারোহ। ক্যালাইডোস্কোপের দৃষ্টিতে দেখে বিবর্ণ বস্তু রঙিন হয়ে ওঠে। সবুজ ঘাসের গায়ে নীল-সাদা রং লেগে যায়। হলুদ ঘাসে সোনালির আভা ধরে। সবুজের সমস্ত ছায়া মুছে গিয়ে সাদা-কালোর তীব্র বৈপরীত্যে (কনট্রাস্ট অর্থে) এসে মুক্ত হয়। কখনো একাধিক চিত্রপটের সুপারইম্পোজিশন বহুমাত্রিক বিচিত্র স্তর তৈরি করে। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের গোড়ায় ঘটাকাশ (ঘটের জলে আকাশের প্রতিচ্ছায়া), পটাকাশ (পটচিত্রে আকাশের প্রতিচ্ছবি) আর আকাশের মধ্যে সম্পর্কের যে বিতণ্ডামূলক প্রতীতি, তাই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে দ্য সেভেন্থ ওয়াক-এ। “কস্তুরী মৃগ নিজের গন্ধের উৎস খুঁজে ফেরে” নেশাতুরের মতো।

Powered by Froala Editor