পাঁচির পঞ্চকথা – ৭

পাঁচির পঞ্চকথা – ৭
আগের পর্বে

দুর্গাপুজো পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সেই বোসেদের বাড়ির যাত্রা পাঁচিদের মন চনমনে রেখেছিল অনেক দিন। বিশেষ করে বোস গিন্নিদের সাজ। তারপর কালীপুজো। বোসেদের বাড়ির এই ঠাকুর বড় না হলেও, তাঁকে দেখে বেশ ভয় করে পাঁচির। এই দু’দিন ধরে পাঁচিদের পাত পড়ে বোসবাড়িতে। নিরামিষ খাওয়া-দাওয়া হলেও এলাহি ব্যাপার। অন্নকূটে ভোগ দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে পাঁচির। ভাইদের জল দিতে বলে ঘেনেবউ। সে এক অজানা তৃপ্তি। তবে বিসর্জনে কেঁদে ওঠে পাঁচির মন। দু’দিনের চেনা কাউকে মানুষ এভাবে ফেলে দেয় কী করে? মাকে প্রাণাম করতে দেখে পাঁচি। তবু ভাইদের হাত ছাড়ে না সে। চোখের জলেই বিদায় জানায় দেবীকে।


রাত কত ঠাহর করতে পারে না পাঁচি। পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এরকম রাত বিরেতে বাহ্যি পেলে ঘেনেবউ বলে রেখেছে তারে ডাকতে। সেইমতো পাঁচি ঠিক করে মাকে ডেকে তুলবে। কিন্তু হঠাৎ মোরগের আওয়াজ কানে আসতে মনে জোর পায়। উঠে বসে মারে ডাকতে যাবে; কিন্তু মায়ের মুখখানা দেখে ডাকতে মন চায় না। মুখের মধ্যে হাড়খাটুনির ছাপ রয়েছে। তাছাড়া রাতে বার দু’তিনেক বিরাট আর ভক্তের জন্য উঠতেই হয়। তারা ন্যাতা কাপড় থেকে সরে যায়। অনেকদিন বিছনা ভিজিয়ে ফেলে। সেই ভয়ে ঘেনেবউ ওদের জোর করে ডেকে নিয়ে পেচ্ছাব করিয়ে আনে। সাতপাঁচ ভাবতে গিয়ে আর পাঁচির পেট একেবারে শেষ মোচড় দিয়ে ওঠে। কোনমতে দরজার আগল খুলে মাঠ সারতে চলে যায়। না আলোর আবছা একটা উস্কানি আছে। তবে রাতই এখন। শীতের শেষে গরমের মাঝখানে বসন্তকাল এল কীভাবে। বেলেপুরের দিকে শীতের কামড় এখনও কমেনি। প্রকৃতির ডাকে রাত, আশপাশ সব গুলিয়ে যায় পাঁচির। মাঠের ধারে মা মেয়েতে রোজ ভোরের দিকে আসে। কিন্তু আজ আর নিয়মের আগে বেনিয়মে ডাক দেয় শরীর। মাঠ সেরে, মাঠের পাশে একটা ডোবা মতো আছে। মূলত সেই পুকুরে শৌচকর্ম ছাড়া আর বিশেষ কিছুই হয় না। আর কাহার পাড়ার অধিকাংশ মানুষই ওই পুকুরে শৌচকর্ম চালায়। তবে অনেকে বলে মাছ নাকি বড় বড় ওই পুকুরে। তবে কারোরই ইচ্ছা করে না খেতে। পুকুর থেকে পাঁচি যখন উঠে আসে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য; ঠিক তখনই হঠাৎ মাথার ওপর কে যেন চাদর ঢেকে দেয়। চোখের সামনে আচমকা অন্ধকার নেমে আসে পাঁচির। যত সে চাদরের ভেতর থেকে মুখ বার করতে চায়, ততই তার মুখখানা চেপে ধরে। দমবন্ধ হয়ে আসতে থাকে পাঁচির। এক হাতে মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে পাঁচির শরীর স্পর্শ করার স্পষ্ট ইঙ্গিত পায়। তারস্বরে চিৎকারে যখন আর কাজ হয় না, তখন হাত পা ছুঁড়তে থাকে তেরো বছরের পাঁচি। বেশ বুঝতে পারে তার ওপর কামনার থাবা বসিয়েছে কেউ। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখের থেকে হাতটা যখন আলগা করতে পারে, মরণপণ চিৎকার করে ওঠে। সর্বনাশকারী ভয় পেয়ে পাঁচিকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়ে, চাদরখানা নিয়ে পালিয়ে যায়। পাঁচি তার সর্বশক্তি দিয়ে শেষের মিনিট খানিকে কাহিল হয়ে পড়ে। তাই জঙ্গলে পড়ে গিয়ে, ফিরে দেখার শক্তি বা সাহস কোনোটাই তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না। ওই অবস্থায় কতক্ষণ পড়ে ছিল, সে নিজেও জানে না। শুধু গোঙানি ছাড়া কিছুই বেরোয়নি। চোখের সামনে কখন সকাল হয়েছে বুঝতে পারেনি। বুঝতে দেয়নি চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া জল। 

ঘেনেবউ কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি। শেষে গোঙানির আওয়াজে জঙ্গল থেকে তুলে আনে পাঁচিরে। শরীর তখন ছেড়ে দিয়েছে। পাশের ডোবা থেকে জল এনে চোখে মুখে দেয়। সারা শরীরে ইতস্তত হাত দিয়ে দেখে সর্বনাশের পরিমাণ কতটুকু। না, চরম সর্বনাশ করে যেতে পারেনি। মাকে কাছে পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরে চিৎকার করে ওঠে পাঁচি। ঘেনেবউ বুঝতে পারে তার পাঁচির ওপর দিয়ে কী গেছে। কোনোমতে কাঁধে মাথাখানা নিয়ে জাপটে বাড়িতে নিয়ে আসে। তখনও বিরাট আর ভক্ত ঘুমুচ্ছে। ভীত ঘেনেবউ বলে - “ও কিছু না। কেউ যেন জানতি না পারে। তালি তোর বে হবে না। তোরে আর ভাইদের নিয়ে ডুবে মোড়া ছাড়া আমার আর পথ থাকবে না।”

পাঁচি আর ঘেনেবউ দুজন দুজনকে ধরে কতক্ষণ বসেছিল, তা তারা জানে না। অন্যদিন ভাইদের তুলে দেয় পাঁচি। আজ আর ডাকেনি। শেষ বেলায় দুই ভাই, দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। মায়ের কথাগুলো আস্তে আস্তে কানে ঢুকতে থাকে পাঁচির। ভাইদের মুখদুটো দেখার পর বুঝতে পারে তাদের বাবা-হারা জীবনে, এই দুই মা মেয়েই ভরসা। নিজের শরীর, মনের কষ্টের ওপর প্রলেপ লাগানোর জোর পায়। এরমধ্যে বিরাট, ভক্ত উঠে পড়ে। দিদির ওরকম অবস্থা দেখে দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। খেনে বউ দুই ছেলের চোখের প্রশ্ন দেখে বলে- “দিদি সকালে পায়খানা করতে গে ভয় পেয়ে জঙ্গলে পড়ে গেসলো। হাত মুখ কেটি গেছে।” কিছু বাদে গঙ্গামাসির গলা পাওয়া যায়- “ওই ঘেনে, কিরে চ”

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৬

ঘেনেবউ বলে- “আর বোলো না, সকাল বেলায় পাঁচি পায়খানা করতে গিয়ে ভূতের ভয় পেয়ে। জঙ্গলে পড়ে গে, হাত পা কেটে কুটে বাড়ি এসছে।” সকাল বেলা ভূত কোথায় পেলে সে? - গঙ্গামাসি বলে ওঠে। 

আরে ভূত না ছাই। হয়তো পাখি টাখি ডেকেছে; সেই শুনে ভয়ে এই অবস্থা। 

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৫

তা তুই কি কাজে যাবি? 

না রে গঙ্গা আজ আর যাব না। গিন্নি মা যদি জিজ্ঞেস করে তো বলিস, কাল সকাল সকাল চলে যাব। 

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৪

ইদানিং সকালের ভাতটা পাঁচি করত। আজ আর তা করতে দেয় না ঘেনেবউ। বাইরে বিরাট আর ভক্ত বসে মুড়ি চেবাচ্ছিল। খেনে বউ ওঁদের চৌধুরীদের বাগানে পাঠিয়ে দেয়। পাঁচি না তোলা বিছানার ওপরে একটা বাকিশের খুট মুখে দিয়ে কাঁদতে থাকে। থেকে থেকে খেনে বউ দেখে আসে পাঁচিরে। ভাত নামিয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে বসে ঘেনেবউ। ‘ওঠ ছুড়ি, আমাদের মতো গরীব গুরবোরে অনেক কিছু সহ্য করে তাপ্পর পিথীবিতে থাকতি নয়। আজ যদি তোর সাড়ে সব্বনাশ হয়ে যেত তালি কী করতাম?’

পাঁচি আবারও মারে আঁকড়ে ধরে। ‘বাওটা মরে আমাদের জলে ফেলে দে চলে গেল। আর তুই আমায় ডাকবি তো’

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৩

‘আমি তো গিসলুম। সকাল হই গে’- অনেক কষ্টে কথাগুলো পাঁচি বার করে। ঘেনেবউও মেয়েরে কথা বলানোর জন্য এতক্ষণ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মেয়ের গলার স্বর পাওয়ার পর, আর তর সয় না- ‘মানুষডা কেডা বুঝতে প্যারিস?’ পাঁচি না বলে মাথা নাড়ে। আর একবার তার সামনে ভয়ংকর ঘটনা ফিরে আসে। কেঁপে উঠে মারে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। মা বলে ‘ভুলে যা, একদম ভুলে যা। চল মা মেয়েতে চৌধুরীদের পুকুরে ডুব দিয়ে আসি। মা কালী যে পুকুরে বিসর্জন হয়েছে, সেকানে সব দুয়ে মুছে যাবে।’

মায়ের সঙ্গে করে পাঁচির পুকুরের দিকে হাঁটতে থাকে। আগের মতো ততটা অগোছালো লাগে না। মা স্বাভাবিক করার জন্য কথা বলে যেতে থাকে। পাঁচির কীরকম যেন মনে হয় আকাশ বাতাস। গাছ পাখি সব যেন তাকে দেখছে। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাক্ষী তারা। যাওয়া আসার পথে যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, একথা সেকথা বলে ঘেনেবউ পাশ কাটায়। দুএকজন পাঁচির চুপচাপ থাকায় জিজ্ঞেস করলি বলে- ‘মাগি সকাল সকাল ছাই কিসির আওয়াজ ভূতের আওয়াজ মনে করে পড়ে মরেচে।’

কেউ কেউ আঁতকে ওঠে। তখন খেনে বউ তড়াক করে বলে ওঠে- ‘এদা পাঁচি যদি এরকম চুপ করে থাকিস, তবে ওঝা ডেকে, ঝেঁটিয়ে ভূত ভাগাতে হবে।’ ঘাটের ধারে কিছুক্ষণ বসে থাকে পাঁচি। তখন দুখান শাড়ি কেচে নেয় ঘেনেবউ। হঠাৎ পাঁচির দিকে তাকাতে দেখে- এক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে পাঁচি রয়েছে। জলে নামতে মুখ, কান, হাঁটুর বেশ কিছু জায়গা জ্বলে ওঠে। প্রথম ডুবটার পর থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একের পর এক ডুব দিতে থাকে। জ্ঞানশূন্য হয়ে ডুব চলতে থাকে। পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘেনেবউ দেখতে থাকে। পাঁচির প্রতিটা ডুবে সে অনুভব করে মন, দেহ তার গ্লানি, অপমান থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসছে। আর মনে মনে মা কালীকে ডাকে- মা, বাপ মরা মেয়েটারে মনে জোর দাও। না হলি আমার মরণ ছাড়া উপায় নেই।’ সারা পুকুরে পাঁচির অনবরত ডুবের তরঙ্গ পাঁচির কাছ থেকে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

Powered by Froala Editor