পাঁচির পঞ্চকথা – ৫

পাঁচির পঞ্চকথা – ৫

আগের পর্বে

পেটে ব্যথা থেকে পাঁচি ভেবেছিল সাধারণ শরীর খারাপ। মাকে বলতে আড়ালে ডেকে প্রথম কথা বলেছিল ঘেনেবউ। আশ্চর্য লেগেছিল পাঁচির। রাত্রে যখন দুই ভাই ঘুমাচ্ছে মা তখন ছেঁড়া কাপড় দিয়েছিল পাঁচিকে। বলেছিল ভাই ছাড়া আর কোনো ছেলেকেই বিশ্বাস না করতে। তারপর থেকেই মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা পাল্টে গিয়েছিল পাঁচির। তাই সুযোগ নিয়েই মায়ের কাছে কথাটা বলে বসেছিল সে। পুজোয় বোসেদের বাড়িতে যাত্রা দেখতে যাওয়ার কথা। তবে মা খানিক চুপ করে কেঁদে ফেলেছিল। পাঁচি বুঝেছিল বাপের কথা মনে পড়ছে তার। পাঁচির চোখেও ভেসে উঠেছিল ছেলেবেলার কেত্তন, যাত্রা-পাগল বাবার স্মৃতি।

(১)

সকাল থেকে ভক্ত, বিরাট আর পাঁচির ছটফটানি আর ধরে না। শুধু তাই নয়, ওরা চারজন ছাড়াও আরও অনেকে যাবে যাত্রা শুনতে। চারু কাকা, নলে দাদু, শ্যামা পিসে সব মানে পনেরো কুড়ি জন। চারু কাকার বাবা বাবুদের পালকি বইত। তাই বোস বাবুদের বাড়ির সঙ্গে জানাশোনা আছে। তাই এবার তিনভাই একসঙ্গে যাত্রা দেখা হবে। সারাদিন তাই নিয়ে করো জল্পনা কল্পনা। কেউ বলছে, ‘এই এত্তো বড়ো তরবারি পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দেবে।’ কেউ বলছে- ‘তির ছোঁড়াছুড়ি হবে।’ সেই শুনে পাঁচির সমবয়সী ফুলি দূরে বসবে বলে ঠিক করেছে। সারাদিন ধরে পুজো চলছে বাবুদের বাড়ি। আর সেই ঢাকের আওয়াজ এসে বুকের ভিতর বেজে উঠছে। পাঁচি, ফুলি, ভক্ত, বিরাট বাকিদের বুকে। 

মা বাবুদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন পাঁচিদের খুশি আর ধরে না। পাড়ার খুড়োদের মাঠ থেকে ফিরে আসা দেখতে দেখতে রাতের যাত্রার আলো ওদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কল্পনার মধ্যে শুনতে পায় সেই যাত্রার নানারকম বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। লক্ষ্মীপুজোর চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে কাহার পাড়ার আশেপাশে। সেই আলোর পথ ধরে, মাঠের আল দিয়ে ঢাকের বাদ্যি, ইতিউতি সানাই, ঢোল, কাঁসরের আওয়াজকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় কাহার পাড়ার গোনা কুড়ি মানুষ। একজীবন, অর্থাভাব, একবসন, এক খাদ্যাভাসের বেড়া টপকে গোটাকয় চোখ আলোর রোশনাই পেতে এগিয়ে চলে। বোসেদের বাড়ির সিংহদুয়ার আলো বেরিয়ে আসছে। ভিতর থেকে আসা আলো জোরালো। রাস্তা বাঁক নিতেই বুকের ভেতরটায় ধুকপুকুনি বেড়ে যায়। এবার শীত শীত ভাবটাও পুজোর আগে পড়লেও, সামনের জাঁকজমক যেন হাত পা আরও ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে পাঁচির। বিরাট আর ভক্তের হাতটা আরও কষে ধরে চেনা খাঁচার বাইরে হঠাৎ বেরিয়ে আসা পাখি যেমন দিকশূন্য হয়ে ওঠে ঠিক তেমনই। বাঁহাতে টান পড়তে আলোর রোশনাই থেকে চোখ চলে যায় বাঁহাতে বোসেদের শিবমন্দিরে। সঙ্গের বড়রা সবাই একে একে পেনাম ঠুকছে। পাঁচি দুই ভাইয়ের হাত ছাড়ে না। মনে মনে শিবঠাকুরকে পেন্নাম করে। মা মন্দিরের চাতাল ছুঁয়ে তিনজনের মাথায় দেয়। আশীর্বাদের মানে জানে না পাঁচি; তবে মাথায় হাতটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো বুজে যায়। 

মানুষে মানুষে বোসেদের উঠোনখানা ভর্তি। বাইরে মোটা গোঁফওলা লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিল। তারা জিজ্ঞেস করল - ‘কোন পাড়া?’

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৪

নলে জ্যাঠা হাতজোড় করে বলল – ‘কাহার পাড়া’

‘ওদিকে যাও’

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা - ৩

তা বেশ খানিক পিছনে বটে। তবে ওদের পরেও আরও কিছু মানুষ আছে। পাঁচি কোনোমতে দুইভাইকে বসিয়ে দিয়ে নিজে বসার সময় জ্ঞান শূন্য হয়ে এক বুড়োর কোলে বসে পড়ে। ভুল বুঝতে পেরে সামনে এগিয়ে বসে। সামনে মানুষের মাথা আর মাথা। এর আগে সে এত মানুষ একসঙ্গে কখনও দেখেনি। সব মাথা ছাড়িয়ে একটা বড়ো দাবা। তার ওপর এক কাপড় খাটানো। চার কোণায় বাঁশ দিয়ে উঁচু করা রয়েছে। বাঁশগুলো কাপড় দিয়ে মোড়া। আর চারধারে মোটা মোটা আলো জ্বলছে। এইসব দেখার পর হঠাৎ একটা হাত গায়ে এসে পড়ে। ঘুরে তাকাতেই দেখে - মায়ের হাত। অবাক চোখে মায়ের দিকে টাকায় পাঁচি। ভাই দুটোরে খেয়াল করে। 

দুই ভাই তখন অন্য জগত দেখছে। মা তাদের তিনটেকে সামনে দিয়ে পেছনে বসেছে। যেন দমকা হাওয়ার সামনে এক দেওয়ালের মতো। 

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ২

‘ওমা ওডারে কী বলে’ - আলোর দিকে তাকিয়ে বলে। 

‘হ্যাজাগ আলো’

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা

বলতেই, প্যাঁ প্যাঁ করে বাজনা শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢোল, ঝনঝন করে আরেকটা কি বেজে ওঠে। সবাই যেন নড়ে চড়ে বসে। তারপর আলোর মাঝখানে, রাজা রানি সৈন্য সামন্তদের আসা যাওয়া। যাত্রার বিষয় বা গল্পের গভীরতার থেকে পাঁচির কাছে বেশি করে ধরা পড়ে চারিদিকে সাজো সাজো জৌলুস। মঞ্চের ওপর ঘটা বিষয়টা যখন তার চোখে একপ্রকার ধাতস্থ হয়ে গিয়েছে; ঠিক তখনই চোখ মা দুগ্গার দিকে। জ্বলজ্বল করছে। মোটা হ্যাজাগ আলো ছাড়াও বিরাট বিরাট দুখানা প্রদীপ জ্বলছে। সেখান থেকে চোখ যায় বোসেদের বাড়িতে। ‘বাপরে কও বড় বাড়ি!’ যেমন ঠাকুরের দালান, তেমনি বাড়িখানা। শুরুর থেকে শেষ অবধি দেখতে দেখতে চোখ আটকায় বাবুদের দোতলার বারান্দায়। কত রংবেরঙের আলো ঝুলছে ওপর থেকে। আর তার নিচে বসে আছে আলো করে বাবুদের গিন্নিরা। কি তাদের সাজ! কীরকম কপালের টিপ একেকবারে মাঠের ওপার থেকে ওঠা সকালের সুয্যির মতো। নাকে নোলক দুলছে। সামনের রাখা কাঠের বেড়ার ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে হাতের চুড়ি। সব্বাই ‘যেন দুগ্গা দালানের পতিমের মতো’, পাঁচির মনে আসতে মায়ের দিক থেকে মনটা হাজার ভিড়ে একা হয়ে পড়ে। মোচড় দিয়ে ওঠে ভিতরটা। মা-টার গায়ে সাদা রং ছাড়া যেন রংই নেই। বিরাটটা ঘুমে ঢুলছে। ভক্তটা মায়ের কোলে শুয়ে পড়েছে। ঘেনেবউয়ের পাঁচির দিকে নজর যায়। পাঁচির চোখটা তখন ছলছল করছে। বুকটা মায়ের জন্য ফেটে যাচ্ছে। কালবৈশাখীর বাজ পড়ার মতো। মাথা নেড়ে সামনের পানে চায় পাঁচি। ‘বাপটা বেঁচে থাকলেও, কিছুটা ভালো হত।’ ডুকরে কেঁদে ওঠে পাঁচির শরীর। চারিদিকে হঠাৎ হাততালি হইহই পাঁচিরে ফিরিয়ে আনে বোসেদের উঠোনের ভিড়ে।

Powered by Froala Editor