‘ড্রাকুলা স্যারে’রা আগেই এসেছিলেন অনীশ, সত্যজিতের গল্পে

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৬

আগের পর্বে

বিদেহী প্রেতদের চেনাতে বিভিন্ন ক্যাটাগরি ছিল বাংলায়। ভুলো, নিশি, জুজু, অ্যাউলা ইত্যাদি। নিশির যথেষ্টি দুর্নাম ছিল বাংলার সংস্কৃতিতে। রাতে পর পর তিনবার না ডাকলে তাই সাড়া দিতেন না কেউ। ‘স্বপনবুড়ো’ অখিল নিয়োগী নিশিদের নিয়েই লিখেছিলেন এক কিংবদন্তি আখ্যান ‘নিশির ডাক’। ভাইপোর প্রতি মৃত পিসির টান, এক মায়ায় পরতে আচ্ছন্ন করে পাঠকদের। লীলা মজুমদারের লেখা এবং ভৌতিক-সংকলনও উল্লেখযোগ্য ও যথেষ্ট ভয়ের। অন্যদিকে রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক বিমল করের সেন্স অফ হিউমর আলাদা আমেজ এনে দিয়েছিল ভৌতিক গল্পে। এমনকি ভূতকে দিয়ে রিকশাও টানিয়েছেন তিনি গল্পে।

রক্তপায়ী শিক্ষককে নিয়ে সদ্য-হওয়া বাংলা ছবিটি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে আর সেটা স্বাভাবিকও ছিল। বলবার কথা যেটা, এই থিম আমাদের সংস্কৃতিতে তত নতুন নয় – বাংলা সাহিত্য তাই বলছে। দুটো উপন্যাস আমরা পেশ করছি - ‘পিশাচের রাত’ এবং ‘আমি পিশাচ’। দুটোরই লেখক হচ্ছেন অনীশ দেব – রোমাঞ্চ গল্পের ‘ব্লু আইড বয়’ হিসেবে যিনি উত্থিত হন ছয় দশকে। 

অনীশ দেব

 

পুরোনো শুকতারার শারদ সংখ্যায় বেরিয়েছিল ‘পিশাচের রাত’ – যেখানে পিশাচের ভূমিকা নিয়েছেন কোচিং-এর স্যার হরিহরবাবু, প্রকাশ পাবে একদা জনৈক আদিবাসীর প্রস্তাবে হাতে উল্কি কেটে এই ‘সত্তা’টি তিনি নিজের রক্তমাংসে লালন করে আসছেন। ছোট্ট শহরের ভিখিরি, পথচারী এবং কোচিং-এ পড়তে আসা  ছাত্র-ছাত্রী – ভিকটিম হিসেবে ছাড় পায় না কেউই।  

‘বাবু, সব মুশকিল আসান করে দেয় এই উল্কি’, তাঁকে বলেছিল আদিবাসী লোকটা। ‘ওর কথায় রাজি হয়ে গেলাম’, চিকু-প্রিয়াংকাদের কাছে কবুল করছেন স্যার। পাঞ্জাবি খুলে দেখালেন, হাতের উল্কিতে একটা পশু আঁকা যে শিকার-ধরতে ঝাঁপানোর ভঙ্গিতে স্থির। ...সেই থেকে চনমন করে শরীর, চাঁদনি রাতে শুরু হয় জ্বর-জ্বর ভাব। ‘মাঝে মাঝে মনে হয় এই নোংরা জীবনটা শেষ করে দিই, আবার ভাবি – আমার তো দোষ নেই এতে। ...আমাকে ভুল বুঝিস না তোরা। এই অসুখটা আমার নিয়তি... হয়তও তোদেরও!’ 

 

রাত যখন নিশুতি, চাঁদ যখন গোল, হরিহরস্যার হয়ে যান ক্ষুধার্ত নেকড়ে, অবমানুষ – বিলেতে যাকে বলে ‘ওয়ারউলফ।’ সেই অবমানুষই চুষে খায় গরম রক্ত, না খেলে তার তেষ্টা মেটে না, জ্বর কমে না। স্যারের সহসা-বদলে-যাওয়ার সাক্ষী থাকে চিকু প্রিয়াংকা দুজনেই। টেনশন যখন তুঙ্গে, আগে থেকে প্ল্যান ক’রে রোহন আর ছোটকু ঢুকেছে শটগান নিয়ে, গুলি চলেছে ‘স্যার’কে নিশানা ক’রে... আদুড় হয় আরো ভয়াল সত্য – পিশাচের মৃত্যু হলেও পিশাচ রয়ে গেছে। 

স্যারের স্ত্রী যখন শব আঁকড়ে কাঁদেন - রোহনরা তাঁকে বলতে যায়, ‘কাকিমা কাঁদবেন না, স্যারের আত্মা এবার শান্তি পাবে’।  ...‘কিন্তু আমিও যে উল্কি করেছিলাম! আমার শান্তির কী হবে?’ মুখ তুলে হেসে ওঠেন ‘কাকিমা’।

‘ওর সাথে আমার যে রক্তের সম্পর্ক!... ও শিকার করে আসত আর আমি ওর শরীর থেকে রক্ত চুষে খেতাম।’  হাসি আর ফোঁপানির ফাঁকে ফাঁকে কথাগুলো চলছে – রোহনরা শুনছে ভয়ে কাঠ হয়ে - ‘এখন কী হবে? আমি একা-একা বাঁচব কী করে?’  

শেষটা উল্লেখ করব না। - মরবিড ফিনিশিং, অপ্রত্যাশিত অর্জন।  

এই একই মিথ আবার ফিরিয়ে আনেন অনীশ ‘আমি পিশাচ’ নামের তুলকালাম উপন্যাসে। এখানে অঙ্কের স্যার স্যাটাস্যাট বাবু টিকটিকির মতোই দেওয়ালে তরতরিয়ে ওঠেন চার হাতে পায়ে ভর রেখে – চশমা খুলতে দেখা যায় তাঁর চোখের মণি বদলে গেছে সবুজ রঙে। সুশ্রী, লাজুক ছাত্রের প্রতি স্যারের অতিরিক্ত টান, বাড়িতে ডেকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেওয়ার কী যে আগ্রহ -!

 

খেয়াল করুন - শিক্ষকের সাইকি এখানে গূঢ় ও যৌন; ‘ভ্যাম্পারিজম’ আদতে এক পিডোফিল ও হোমোইরোটিক অভিব্যক্তি। ...বয়স্কের সঙ্গে কিশোর–সম্পর্কের গ্রন্থিগুলো ওতপ্রোত পেঁচিয়ে, জড়িয়ে, ফেঁপে-ফুলে আতঙ্ক-গল্পের নোংরা রূপকে ধরা দিয়েছে।

‘আমি পিশাচ’ – এই আত্মনেপদী বাক্য দিয়েই শুরু হয়েছিল উপন্যাস, বাতাসে মিশে-থাকা ফিসফিসে কন্ঠ বলে গেছিল-  ‘যেমন গীতায় লেখা আছে, আত্মাকে অগ্নি দগ্ধ করে না, জল তাকে সিক্ত করে না, শস্ত্র ছেদন করতে পারে না!’ ...সে-ও তেমনই অনশ্বর, অক্ষয়, নিরালম্ব... শুধু মাঝে মাঝে দরকার হয় একটা জ্যান্ত শরীর, নিজের ঠাণ্ডা সত্তাটার জন্য একটু ‘উষ্ণতা’! রক্তমাংসের কুঠুরিতে বাসা বাঁধা এবং অন্যের রক্ত চুষবার তৃপ্তি– এই তার চাই। 

এই সূচনা-মনোলগের পরেই আসল কাহিনি নৈর্ব্যক্তিক কথনে শুরু হয়ে যায়। বেশ বুঝতে পারছি পিশাচ ভর করেছে অঙ্ক-স্যার সনাতনকে (যার নাম পালটে ছাত্ররা রেখেছিল স্যাটাস্যাট – যেহেতু অঙ্ক তত দ্রুতই তিনি কষে ফেলতেন ব্ল্যাকবোর্ডে)। রক্তের ফিনকি-ফোয়ারা উপচে পড়ে, স্যারের তেষ্টার বলি হয় কিশোর ছাত্র...  এই ঘটমান-বর্তমানের সাক্ষী থাকেন স্কুলের বাংলা স্যার, বিড়বিড়িয়ে তিনি প্রলাপ বকে যান যার মূল কথা হল ‘একে ঠেকাতে হবে’... যিনি ছাত্রদের বাঁচাতে চাইছেন ম্যানিয়াক-পিশাচের থেকে। - হরর ফিকশন এবার একটি দ্বৈরথের নাটক হয়ে ওঠে, প্লট-ছক হল অশুভের বিরুদ্ধে শুভের চির-পুরাতন রেজিস্ট্যান্স। 

এখানে যা লেখা হল তার চেয়ে অনেক গুণে জোরালো, ভয়াল, বিষাক্ত চমক অপেক্ষা করছে মূল আখ্যানে। ‘পিশাচের রাত’-এ যেমন দেখেছি, একের বদলে জোড়া-পিশাচ টুইস্ট এতেও রয়েছে –আরো নিপুণ অভিঘাতের সঙ্গে। ঝুটমুট স্পয়লার দেওয়ার মানে হয় না কাজেই এখানেই থেমে যাচ্ছি।বাকিটা পাঠকের অনুসন্ধিৎসা ও বোঝাপড়ার জন্য। 

কিশোর-কাহিনিকে অনেকগুণে প্রাপ্তমনস্ক করেছেন অনীশ – এনেছেন চাবুক ভাষা ও দুরন্ত সাসপেন্স; এই ক্রেডিট তাঁর নিজস্ব। - কিন্তু তাঁকেই পায়োনিয়র বলা যাচ্ছে না, কেননা শিক্ষক-ছাত্রের রক্তাক্ত-সম্পর্ক পাচ্ছি আরো পূর্বের একটি গল্পে – যার লেখক ছিলেন সত্যজিৎ রায়।

‘শিবু ও রাক্ষসের কথা’ মনে পড়ছে? নবাগত জনার্দন স্যারকে আমরা চিনতে পারি আদিম নরখাদক ‘পিরিণ্ডি’ জাতির বংশধর - মনস্টার হিসেবে। ছাগলছানা দেখে তাঁর জিভে আসে জল, ছাত্র শিবনাথের ক্ষতের রক্ত দেখে জ্বলজ্বল ক’রে ওঠে চোখ। পাগলা ফটিকদার আশ্চর্য বুদ্ধি শিবুকে বাঁচিয়ে দেয় অঙ্ক-স্যারের বিপজ্জনক ‘তেষ্টা’ থেকে।   

একটা কথা ভেবে এখন হাসি পাচ্ছে আর ফশকে-গেল-যাঃ এই বোধ জাগছে - এই কিস্তিটা যদি দু’ মাস পিছিয়ে ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে বের করা যেত! 

Powered by Froala Editor