পাঁচির পঞ্চকথা – ৮

পাঁচির পঞ্চকথা – ৮
আগের পর্বে

রাতে বাহ্যি পেলে ঘেনেবউ তাকে ডাকতে বলে রেখেছে পাঁচিকে। কিন্তু মায়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আর ডাকতে ইচ্ছে করে না পাঁচির। দরজা ঠেলে একাই বেরিয়ে যায় সে। শৌচকর্ম সেরে ফেরার পথেই ঘটে যায় বিপত্তি। মুখে চাদর চাপা দিয়ে কেউ চেপে ধরে তাকে। পাঁচি বুঝতে পারে কেউ কামনার থাবা বসিয়েছে। অনেক চেষ্টা করে চিৎকার করে উঠতে পালিয়ে যায় সর্বনাশকারী। তবে চরম সর্বনাশ করতে পারেনি সে। গোঙানি শুনে জঙ্গল  থেকে পাঁচিকে তোলে ঘেনেবউ। মুখে, হাতে, পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ। পাড়া, প্রতিবেশীকে বিষয়টা জানান দিলে চলে না। ঘেনেবউ অন্য গল্প ফাঁদে তাই। মেয়েকে নিয়ে যায় চৌধুরীদের পুকুরে। মা কালী বিসর্জন হয়েছে সেখানে। ওই জলে ডুব দিলে মুছে যাবে সব। তারপর...

পাঁচি বাড়ির কাছে আসতেই দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিল। তাদের দাওয়ায় হাসির আওয়াজ। একটু অবাকই যেন হয়েছিল। আসলে অভাব, দুঃখ, লড়াই ছাড়া কিছুই তাদের সঙ্গী নয়। উঠোনের সামনে আসতেই দেখে মা আর ভরসার মা দুজনে বসে কথা বলছে, আর তাকে আড় চোখে দেখে আবার হেসে ওঠে ভরসার মা। ঘেনেবউ কীরকম যেন একটু থতমত খেয়ে যায়। পাঁচি বিষয়টা বোঝার আগে ভরসার মা বলে ওঠে, “তালিই উঠি গো ঘেনেবউ। ঐ কতাই রইল।” ঘেনেবউ মুখ দিয়ে কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ে। ঘেনে বউ পাঁচিরে পেন্নাম করতে বলে ভরসার মাকে। পাঁচি পায়ে হাত দিতেই ভরসার মা বলে, “আশিব্বাদ করি পাঁচ ছাবালের মা হয়ে ওঠো। তবে গরিবির ঘরে কি আর খাবার আছে ঐ ভাত ছাড়া। ভাত খেয়ে মাস খানিকির মধ্যি চেহেরাটা ঠিক করি নাও দেখি। পাঁচ ছাবালের মা হয়ে ওঠো।” কথাটা পাঁচির কীরকম কানে লাগে। এর আগে তার কানে অনেক রকম কথা আসলেও একথাটা পৌঁছয়নি। ভরসার মা মুখের হাসিখানি নিয়ে চলে যায়। ব্যাপারখানা বুঝে ওঠার আগে পাঁচি দেখে মা দাওয়ায় কিরকম থম মেরে বসে আছে। মায়ের কাছটাতে গিয়ে পাঁচি মারে বলে- ‘কী ব্যাপার মা, ভরসার মা এত হাসতেছিল। এদিকে তুমি আমারে দেখার পর হাসি থামিয়ে গুম মেরে গেলে।’ কিছু সময় ঘেনেবউ চুপ থাকে; তারপর কালবৈশাখীর বিকেলে যেরকম ছোটো ছোটো কালো মেঘ জড়ো হয়ে আকাশময় হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় বিরাট বৃষ্টি। ঠিক সেরকম মায়ের মুখখানা হয়ে ওঠে পাঁচি খুব কাছ থেকে লক্ষ করে। মারে পাঁচি জাপটে ধরে। পাঁচির মা ছাড়া এযাবৎ কালে কোনো বন্ধু নেই। সেকথা সে স্পষ্ট জানে। মা কান্নাভরা গলায় বলে “তোরে বিদেয় করার ব্যবস্থা পাকা করে ফেললাম রে মুখপুড়ী— তোরে বিদেয় করার।” পাঁচি সাতপাঁচ ভেবে পায় না। মাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে থাকে। সময় গড়িয়ে যায় সময়ের হাত ধরে। দুজনের শরীর তবু একই জায়গায় স্থবির হয়ে থাকে। মা বলে, ‘ভরসার মায়ের বুনির ছেলের সঙ্গে তোর বে ঠিক করেছে তবে বেশি দূর যেতে হবে না। পাশের গাঁ ঈশ্বরীগাছায় থাকে।’ বিয়ে, পাশের গাঁ, কাহার আরা, ওদের ফাটাফুটো হলেও এই চালাখান, বিরাট ভক্ত সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। পাঁচি মারে জাপটে ধরা হাতগুলো আলগা করে দিয়ে, জলভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে— আমারে তাড়াস নি মা। আমি তোমারে, বিরাট, ভক্তরে ছেড়ে থাকতি পারব না। 

‘ওরে সেয়না মেয়ে ঘরে রাখা যে কত জ্বালা তা যদি বুঝতিস। আর একদিন না একদিন সকলরে সোয়ামীর ঘর যেতে হয়।’ সেয়না মেয়ের ঘরেথাকার জ্বালাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচির চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই সকালের স্মৃতিগুলো। “শেয়াল কুকুরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে সেখান থেকে তোরে মানে মানে পার করতে পারলে আমার নিশ্চিন্তি। ভক্ত আর বিরাট খুঁটে খেতে শিখে গেছে। আর বেশি দূর বই তো না। পাশের গাঁ। ছেলের ঘরে বেধবা মা ছাড়া আর এক ননদ আছে। তোর থেকে ছোট। বছর দুই আগে বাপটা মরে গেছে। নিজের মতো করে গুছিয়ে নিবি। ছোঁড়া জনের কাজ করে।” একমনে বলে যাচ্ছিল ঘেনেবউ। পাঁচির সব কথা গুলোই একরকম শোনাচ্ছিল। তার অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচয় হলেও এই ক্ষণটার জন্য তৈরি ছিল না। সে চলে গেলে ভাইদের কে দেখবে। কে খাওয়াবে নাওয়াবে, আর মা যার একমাত্র কাঁদার লোক বলতে সে নিজে। 

ঘেনে বউ তার মা। যে জীবনে কষ্ট ছাড়া কিছুর মুখ দেখেনি। পাঁচি বেশ বুঝতে পারে তার মায়ের মুখ যাই বলুক মনের ভেতরে উথাল পাতাল চলছে। আসলে মা তারে সোয়ামীর ঘরে পাঠিয়ে কান্নাভেজা রাতগুলোয় এইটুকু ভেবে শান্তি পাবে যে শেয়াল কুকুরের হাত থেকে তার মেয়েরে বাঁচানো গেল। সন্ধে নেমে আসে ঘেনে বউয়ের উঠোনে। দূর থেকে শাঁখের আওয়াজ আসে। ঘেনে বউ পাঁচিরে ঠেলা দিয়ে বলে - ‘ওঠ রে ছুঁড়ি কী করবি। গরিবের ঘরে জন্ম তারপর আবার মেয়েমানুষ।’

ঘরের ভিতরে দুই ভাই খুব আনন্দ করে দিদির বিয়ে শুনে। ওদের জামাইবাবু হবে। দিদির শ্বশুরবাড়ি যাবে। খাওয়া দাওয়া হবে। কিন্তু পাঁচির মুখে একটা কথাও সরে না। সে মায়ের চিন্তামুক্তির কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে দমকে বেরিয়ে আসা কান্নার মুখে বাঁধ দেয়। মায়ের জোরাজুরিতে দুগাল মুখে তোলে। তখন মা বলে- ‘কাল ওরা আসবে তোরে দেখতে।’ নিশ্চুপ হয়ে কথাগুলো পাঁচির কানে পৌঁছায়। ‘বাবু পঞ্চাশ টাকা দেবে বলেছে। আর বাবুর বউ গোটা তিনেক শাড়ি। তবে ছেলে সেরকম কিছু চায়নি, এই বাঁচোয়া। আমার কিছু জমানো আছে সেই দে তোর পিতলের কলসি, ছেলের এট্টা থালা কিনি দেব।’

বাতি নিভিয়ে যখন মা মেয়ে শুতে যাবে, হঠাৎ নাক টানার আওয়াজ পায়। ঘেনে বউ মুখ নামিয়ে দেখতে পায়, ভক্তটা কাঁদছে। ‘ঐ কী হয়েছে রে?’

ভক্ত কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে, ‘মা দিদিরে ছাড়া আমরা রাতির বেলা ঘুমোব কী করে। খেলব কার সাথে…’। কথা শেষ করার আগে ভক্তের গলা বুজে আসে। ঘেনেবউ, ভক্তরে জড়িয়ে ধরে বলতে যাবে ‘আমিতো আছি’। কিন্তু কথা আটকে যায়। পাঁচি নিজের মুখে হাত দিয়ে কেঁদে চলে। একদিনে তার মনে হয় তার দুই ভাই দূর দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছে। ভক্ত বিরাট আর পাঁচিরে হাত দে জাপটে ধরে কেঁদে চলে। শুধু এই দুখী তিনজনের থেকে বিরাট দূরে থাকে। তার চোখের ঘুম এই বাস্তবটাকে ছুঁতে দেয় না। তাদের কুঁড়ের ওপর রাতপেঁচা আওয়াজ করে উড়ে যায়। ভাঙা দরজার ভিতরের ব্যথা ভরা মনগুলো, চোখের জলের সঙ্গে রাত পেরোতে থাকে।

Powered by Froala Editor