পাঁচির পঞ্চকথা - ৯

পাঁচির পঞ্চকথা - ৯

আগের পর্বে

বাড়ির কাছে আসতেই টের পেয়েছিল পাঁচি। ভরসার মা আর ঘেনেবউ কিছু নিয়ে কথা বলছে। হাসি-ঠাট্টা করছে। পাঁচি এসে পড়ায় খানিকটা থতমত খেয়ে গেল মা। ভরসার মা চলে যেতে ঘেনেবউ জানায়, পাঁচিকে বিদায়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছে সে। ঘেনেবউয়ের কথা নিজের ঘাড় থেকে দায়িত্ব সরিয়ে ফেলার মতো শোনায়। তবে পাঁচি জানে শেয়াল কুকুরের হাত থেকে বাচানোর জন্যই এমন সিদ্ধান্ত তার। দিদির বিয়ে শুনে আনন্দে ভাসে দুই ভাই। কিন্তু আলো নেভার পরই জল চলে আসে ভক্তের চোখে। মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে পাঁচিও। মনে হয় ভাইরা যেন এবার থেকে দূর দেশের বাসিন্দা। তারপর...


দ্বিতীয় কথা

আজ মাস ঘুরতে গেল পাঁচির জীবন ঈশ্বরীগাছায় বয়ে চলেছে। বিয়ের পরের বেশ কয়েকদিন মনের ওপর থেকে বোঝাখানা নামাতে পারেনি পাঁচি। এমন অনেক রাত গিয়েছে, যখন দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। শুধু যে দুচোখের পাতা এক হয়নি তা নয়, চোখের জল কোনো বাঁধ মানেনি। তার স্বামী মানে হেবোল অনেকবার তার মনের আশ মিটিয়ে নিয়ে যখন উল্টোপিঠ করে শুয়ে থেকেছে, ফিরে তাকিয়ে তাকে কাঁদতে দেখে তার মাথার ওপর হাত বুলিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েকবার। পাঁচির বিছানায় থাকা পুরুষখানারে বড় আপন মনে হয়েছে পাঁচির। আরও কষ্টের কারণ বিয়ের নিয়মমাফিক দুবার গিয়েছিল মায়ের কাছে। ফিরে আসার সময় বুকের ভেতর উথাল পাতাল চলেছে। গ্রামের শেষ অবধি এগিয়ে দিতে এসেছে ঘেনে বউ, বিরাট, ভক্ত। এমনকি বাড়ির পাশের মানুষগুলোকেও তখন বড় কাছের মনে হয়েছে পাঁচির। বিয়ের পরে যখন পাঁচি প্রথমবার পাড়াটা ছেড়ে চলে আসছিল। সেদিন কাহারদের ঢল নেমেছিল পাড়া জুড়ে। সেদিন ওদের ভাঙা চালাটা শুধু তার গণ্ডি মনে হয়নি। পাঁচির বরং বাড়ির উঠোনটা সাড়া পাড়াৎ সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। তবে হেবোলের সঙ্গে কাটানোর রাতগুলোতে পাঁচির আদরের থেকেও অধিক কি একটা পাওয়ার দাপাদাপি সহ্য করতে হয়েছে। তবে একথা যে কারোর সঙ্গে আলোচনার নয়, সে বুদ্ধি পাঁচির আছে। 

সারাদিন কমবেশি কাজের মধ্যে থাকে পাঁচি। তখন ফেলে আসা তার কাছে এসে ধরা দেয় না। সেই রাত নামে; জীবনের গতি যখন একটু শ্লথ হয়, তখনই ঈশ্বরীগাছার কাহার পাড়ার ঘেরাটোপ ছেড়ে পাড়ি দেয় বেলেপুরের অন্ধকার ঘরখানায়। সেখানে একখানা টেমির আলোর চারিদিকে তিনটে প্রাণীর চলাচল তাকে বড় ভাবায়। 

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৮

শাউরি মা মানুষটা ভালো নয়। তবে ছোট ননদটা সবসময় তারে খেলার জন্য ডাকে। দুতিনদিন খেলার সাধও হয়েছিল পাঁচির। নতুন বউ বলে এখনও কাঠ গোটো করতে যায় না পাঁচি। হেবোল সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ে মাঠে কাজ করতে। দুপুরের দিকে ভাত নিয়ে যায় শাউরি মা। মাস না ঘুরতেই কাল পাঁচির শাউরি একটু গলা তুলেছিল পাঁচির ওপর। কারণ আর কিছুই নয়; ননদটার সঙ্গে উঠোনে ঘুঁটি খেলছিল। আসলে ননদ মানে গঙ্গা মায়ের সঙ্গে না গিয়ে তার সঙ্গে খেলায় মেতে থাকে। কাল নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। যখন ‘এই মাগী’ বলে গঙ্গার চুলের মুঠি ধরে দুঘা দিল শাউরি মা, মনে হল তার মা বছর খানিক আগে বাপখাগি বলে তারে যেমন চুলের মুঠি ধরে ঘুরিয়ে দিত ঠিক তেমনই। পাঁচিও ভাবছিল তার ওপরেও চড়াও হতে পারে শাউরি মা। না, তা করেনি তবে দু কথা শুনিয়েছে। ‘এই ছুঁড়ি তোরেও যদি দেখেছি এই মাগীর সঙ্গে খেলে দেলে সময় কাটাতে তাহলে ভুলি যাব যে তুমি আমার ছাবালের বউ।’

পাঁচি বোঝে সে এক বিধবার জীবনের হাড়খাটুনির সাক্ষী। তাই তার শাউরির কথাগুলো মন থেকে বুঝতে পেরেছে। তবে ওই যে ননদ তার লজ্জা নেই। আবারও সন্ধেবেলায় তারে বলে ‘কিরে কথা কইছিস না যে। কাল আবার মা বের হোলি আমরা খেলবো বলো।’

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৭

রাতে যখন হেবোলের পাশে শুয়েছিল পাঁচি, তখন হেবোলের ভালোবাসা, বাসনা বা কামনার হাতখানা পাঁচির শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পাঁচিরে একটু অন্যমনস্ক দেখে বলে ওঠে ‘মা’র সাথি তোমার আজ ঝগড়া হয়েছে?’

‘ওমা না। ঝগড়া হতি যাবে কেন?’
‘না শুনলুম, আজ মা নাকি কাঠ কুড়িয়ে ফিরে এসে তোমার সঙ্গে চেঁচামেচি করছিল।’
‘আমার সঙ্গে না তো। করছিল গঙ্গার সঙ্গে। তোমারে এ কথা কেডা বলল?’
‘না ঘাটে চান করতি গিয়ে শুনছিলুম’

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৬

পাঁচির মনটা বলে ওঠে, ও কীরকম। এ কথারে দশকথা করে হেবোলের কানে কেডা তুলল। তাছাড়া সংসারে কত কী হয়। ঘেনেবউ বলে পাঠিয়েছে তারে, সব কথা মন থেকে মাখতি নেই। কিন্তু চিরাচরিত সমাজের একটা নিয়ম আছে। ‘যার বিয়ে তার খোঁজ নেই, পাড়া পড়শির ঘুম নেই।’

বিয়ে হয়ে আসার দিন থেকে হেবোলের শরীর পাঁচির শরীরে মিশেছে প্রতি রাতের অন্ধকার যেমন আরেক অন্ধকারে মেশে। ঠিক তেমনই হেবোলও তার মা বোনরে গিয়ে একই ঘরে ঘুমাত। পাঁচি আসার পর থেকে এখন দাওয়ায় ঘুমায় মা মেয়ে আর পাঁচি ও হেবোল ঘরের খোলের ভেত্র। সকালে পাঁচির শাউরি ভাত রান্না করছিল। প্রতিদিন ভাত রান্না করে শুকনো কাঠ গোটো করতে যায়। তারপর ফিরে এসে ছেলের জন্যি ভাত দিতে যায়। আজ হেবোল সেই কাজের জন্যি বাড়ির থেকে বের হল। অমনি শাউরি মা পাশের বাড়ির নেত্য কাকিমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে তার সঙ্গে তার বউয়ের কী কথা হয়েছে, তার মেয়ের সঙ্গে কী হয়েছে তার ছেলেরে জানানোর কী আছে। 

আরও পড়ুন
পাঁচির পঞ্চকথা – ৫

পাঁচি স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তাদের রাতের কথাগুলোও তার শাউরি মা শুনেছে। মানে রাতের সকল কথাই। হেবোলের পাঁচির সঙ্গে ঘটে চলা সবই শাউরি মার কানে আসে। নেত্য বউয়ের বাড়ি থেকে যখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শাউরি বাড়ি ফেরে তখন পাঁচি দাওয়ায় বসে একপ্রকার কাঁপছিল। ননদটা দূরে বসে কাঠ ভাঙছিল। আসলে ও কাজ করছিল না। কাজ করার ভান করছিল। শাউরি মা নিজেরে স্থির রাখতে না পেরে কাঠ কুড়োতে বেরিয়ে যায়। ননদ, যারে এখন পারুল বলেই ডাকে পাঁচি। মা বেরোতেই সে পাঁচির কাছে এসে বলে, ‘এবার বুঝোসতো, রাতের কতা, কম্ম এট্টু আস্তে।’ বলেই ফিক করে হেসে ওঠে। পাঁচি লজ্জায় ওরে মারতে হাত তোলে। আর ঘেমে ওঠা মুখখানা দুহাত দিয়ে চাপা দেয়।

Powered by Froala Editor