চারুলতার খেরোর খাতা-২

মানিকলমকারি - ২১

আগের পর্বে

রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে ১৯৬১ সালে ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে সিনেমা করার কথা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। তার জন্য চরিত্র বাছাইও করে ফেলেছিলেন। ভূপতি চরিত্রে যেমন ভেবেছিলেন কালী ব্যানার্জিকে, চারুলতা চরিত্রে তেমন শর্মিলা ঠাকুরকে। অবশ্য প্রথমে নাম রেখেছিলেন চারুবালা। অমল চরিত্রে অবশ্য প্রথম থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম দেখা যায়। একই খেরোর খাতায় আছে আরও নানা সিনেমার পরিকল্পনার কথা। তার মধ্যে আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে’, কমলকুমার মজুমদারের ‘তাহাদের কথা’-র নাম। এছাড়াও আছে ‘দেবী’ ও ‘মহানগর’-এর পরিকল্পনা। আছে প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ বইয়ের ক্যালিগ্রাফি। এমনকি ঘরে-বাইরে উপন্যাসের ক্যালিগ্রাফিও দেখা যায় একই খাতায়। তবে কি তখনই ‘ঘরে-বাইরে’ নিয়েও সিনেমা বানানোর কথা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ রায়?

সত্যজিৎ রায়ের হাতে-লেখা চারুলতা-র খেরোর খাতাটি ছিল ভারি অদ্ভুত। গত কিস্তিতে দেখতে পেয়েছি ওই খাতাতে তাঁর কত রকম ভাবনা একত্র হয়ে সাজানো ছিল। তাঁর নানা ভাবনার এক আশ্চর্য সন্নিবেশ সেই খাতা জুড়ে ছড়ানো। কোথাও প্রবন্ধের খসড়া, কোথাও পরবর্তী ছবির ভাবনা, কোথাও নতুন নতুন ক্যালিগ্রাফির আঁকিবুকি আর সেই খাতাই সাক্ষী, রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ বুঝি-বা চেয়েছিলেন ‘নষ্টনীড়’ ছবিটি করতে। তখনো ‘চারুলতা’ নামকরণের কথা ভাবেননি তিনি। মজার ব্যাপার হল এই খাতার প্রতিটি পাতা যদি মন দিয়ে পড়া যায়, তাহলেই আবিষ্কৃত হবে একটি মানুষের কাজ-করার পদ্ধতির এক চমৎকার রূপরেখা। কীভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্পটিকে তিনি চিত্রনাট্যে তৈরি করে তুললেন, তার এক নীরব-ভাষ্য যেন এই খাতাটি। তিনি কী ভাবছেন, কীভাবে ভাবছেন, তার একটা পথ আঁকা আছে এই খসড়া খাতার পাতায় পাতায়। 

ভাবতে পারা যায় না, ‘নষ্টনীড়’ গল্পটা থেকে চিত্রনাট্য বানাবার আগে চার-চারবার কাহিনিটি লিখেছেন সত্যজিৎ। এই চারটি খসড়া থেকেই ক্রমশ তৈরি হয়ে উঠবে তাঁর চূড়ান্ত-চিত্রনাট্য। গল্পটাই লিখছেন তিনি, পরপর চারবার। সেই অর্থে এখানে কোনো সংলাপ নেই, নেই চিত্রনাট্যে যেভাবে দৃশ্য-বিবরণ থাকে, তার চিহ্নমাত্র। এই চারবার লেখার মধ্যে, লক্ষ করে দেখব, প্রথমবার যখন লিখছেন, তখন তাঁর পাশে আছে রবীন্দ্রনাথের গল্পটি। তারপরে তিনি সেই গল্পটিকে সাজালেন ছবির মতো করে। তৃতীয় বার মোট ন-টি সিকোয়েন্সে সংক্ষেপে ঢেলে সাজালেন গল্পটিকে আর চতুর্থবার ওই ন-টি সিকোয়েন্সকেই আরো বিস্তারিত করলেন, সেই গল্পের ধাঁচেই। এই চারটি গল্পলেখার ধরন-ধারণের প্রথম খসড়াটি পড়ে-দেখা এই হপ্তায়। 

সত্যজিৎ রায়ের এই প্রথম খসড়াটি গুরুত্বপূর্ণ তিন দিক থেকে। প্রথমত, একটি গল্প থেকে কীভাবে সত্যজিৎ বানিয়ে তোলেন তাঁর চিত্রনাট্যের গড়ন, এই লেখা যেন, তাঁর নিজের কাছে, তাঁরই এক কর্মশালা। দ্বিতীয়ত, ‘চারুলতা’ ছবির মুক্তির পর ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তিনি যখন অরূপ রুদ্রের প্রবন্ধের উত্তরে ‘নষ্টনীড়’ গল্প আর ‘চারুলতা’র চিত্রনাট্য নিয়ে তুলনামূলক প্রবন্ধ লিখবেন এই খসড়া যেন তারই নেপথ্য-ভূমি। তৃতীয়ত, রবীন্দ্র-গল্পের মূল-কাঠামোকে ছবির প্রয়োজনে সত্যজিৎ পুরো বদলে ফেলেছিলেন বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের মনে রাখতে অনুরোধ করি এই বিশেষ পর্বটি। কারণ এখান থেকেই বোঝা যাবে, পুরো গল্পটিকে বদল করার আগে কী অপরিসীম যত্নে তাকে আগে নিজের কাছে সাজিয়ে নেন একজন দক্ষ চিত্রনাট্যকার। পূর্বজের প্রতি কতখানি সশ্রদ্ধ হলে এই পথটি পেরিয়ে নিজের প্রকল্পে পা রাখেন উত্তরসূরি, এ যেন তারও এক মহান শিক্ষা।   

ভারতী- পত্রিকার পাতায় ১৯০১-তে 'নষ্টনীড়' কাহিনির শেষ কিস্তি।

 

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা

এই খেরোর খাতার প্রথম খসড়ায় দেখা যাবে, নিশ্চয়ই সত্যজিৎ রায়ের পাশে ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ বইটি। কীভাবে শুরু হচ্ছে সেই গল্পসূত্র, লক্ষণীয়: ‘ভূপতি-চারু। ভূপতি শ্যালক উমাপদর সঙ্গে ইংরিজি কাগজ চালায়। চারুর boredom--- ভূপতির realization--- ‘তোমার একজন সঙ্গী চাই’ উমাপদর স্ত্রী মন্দাকিনী এসে চারুদের বাড়ি থাকে।’ এরপরের অংশের শুরুতেই লেখা ‘অমল- চারু’। তারপরে ‘অমল থার্ড ইয়ারে পড়ে। চরুর লেখাপড়ার শখ--- অমল মাস্টারি করে। চারু-অমলের companionship। মন্দা গৃহকর্ম নিয়ে থাকে--- সে অমলের উপর অপ্রসন্ন। বাগান করার plan। বাগানে চারু-অমল। মন্দা--- ‘তোরা কী করছিস?’--- ‘আমড়া খুঁজছি।’’ এর পাশে একদিকে আড় করে লেখা, ‘অমল ভূপতির ইংরিজি প্রুফ সংশোধনের কাজে সাহায্য করত।’ আমরা বলেছি, এই লেখাটি তৈরি করার সময় অবশ্যই চিত্রনাট্যকার সত্যজিতের হাতের পাশে ছিল ‘গল্পগুচ্ছ’-ভুক্ত ‘নষ্টনীড়’-এর পাঠ। সেই গল্পের মনোযোগী পাঠকরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমার এ অনুমানের কারণটি বুঝে গিয়েছেন। যাঁদের হয়ত ততটা মনে নেই, তাঁদের জন্য সেই গল্পের সূত্রকথাটি ধরিয়ে দিই। রবীন্দ্রনাথের গল্প শুরু হচ্ছে, ভূপতির ইংরাজি কাগজ ‘বাহির করিতে হইল’ এই কথা বলে, তারপরে রয়েছে ‘তাঁহার উকিল শ্যালক উমাপতি’ ভূপতিকে বলল একটি কাগজ প্রকাশ করতে। বস্তুত সেই কথাতেই ‘শ্যালককে সহকারী করিয়া নিতান্ত অল্পবয়সেই ভূপতি সম্পাদকের গদিতে আরোহণ করিল।’ গল্পে ঠিক তার পরের প্রসঙ্গটি হল, ‘ধনীগৃহে চারুলতার কোনো কর্ম ছিল না।…. কাগজের আবরণ ভেদ করিয়া স্বামীকে অধিকার করা তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়াছিল।’ এর ঠিক পরের প্রসঙ্গটি কাহিনিতে ছিল এই রকম: যুবতী স্ত্রীর প্রতি ভূপতির এই উপেক্ষা লক্ষ করে তার কোনো নিকটাত্মীয়া তাকে ভর্ৎসনা করলে ভূপতির মনে হয় ‘তাই তো, চারুর একজন কেউ সঙ্গিনী থাকা উচিত, ও বেচারার কিছুই করিবার নেই।’ ইত্যাদি। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের গল্পের ঘটনা-গতি আর সত্যজিতের এই প্রথম খসড়া-র গতি আর ভাষা  হুবহু এক। এরপরে এমনকি গল্পের পাঠকের মনে থাকবে, অমল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘অমল থার্ড ইয়ারে পড়িতেছিল’, গল্পকার ওই বাড়ির মধ্যেই বাগান বানাবার পরিকল্পনার কথা, এমনকি চারুর ভ্রাতৃবধূ মন্দাকিনীর বলা, ‘এত বেলায় বাগানে তোরা কী করছিস?’ আর তার উত্তরে চারুর মুখে বলা ‘পাকা আমড়া খুঁজছি’--- এই সবটাই একেবারে মূল গল্প থেকে উঠিয়ে নিয়ে, তাকে আরেকবার লিখছেন সত্যজিৎ, তাঁর খেরোর খাতায়। দেখা যাবে, ঠিক এইভাবে পুরো গল্পটাকেই আরেকবার নিজের মতো প্লট-অনুসারে একটার পর একটা ঘটনা পরম্পরায় বসানোর কাজটি সত্যজিৎ করলেন পুরো চিত্রনাট্য প্রস্তুতির প্রথম পর্বে।

এমনকি মূল গল্পে যেমন অমলের ভূপতির বাড়ি ছেড়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রসঙ্গ ছিল আর তার চিঠির জন্য চারুর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা ছিল এমনকি স্বামী ভূপতিকে লুকিয়ে চারুর-পাঠানো টেলিগ্রামের উত্তরটি ভূপতির হাতে-পড়ার কাহিনিটি ছিল, এই প্রথম খসড়াতে সেই কাহিনিসূত্রটিই লিখেছিলেন সত্যজিৎ। তিনি লিখছেন: ‘বিলেতের চিঠি। চারুর উদ্বেগ। টেলিগ্রাফের কথা ভূপতি জানতে পারল চারু টেলিগ্রাম করেছে। ভূপতির realization…. Crisis’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এই ঘটনার পর ভূপতি চারুর মন সম্পর্কে অনুমান করে সে চারুর জন্য যে লেখাগুলি লিখেছিল সেগুলি পুড়িয়ে ফেলে। সত্যজিৎও সেখানেই তাঁর গল্পসূত্র শেষ করে লিখলেন, ‘ভূপতি-চারু crisis। ভূপতি তার লেখা পুড়িয়ে ফেলে। চারুর উপর ভূপতির Sympathy। ভূপতি দূরে সরে যায়।’ এইভাবেই প্রথম খসড়ায় ‘নষ্টনীড়’-এর গল্পসূত্র শেষ করেছিলেন সত্যজিৎ। ভারি আশ্চর্যের বিষয় হল, এখানে একটি কাহিনির পুনর্লিখন। সত্যজিৎ আক্ষরিক অর্থেই একদিকে মূল বইয়ের টেক্সটটিকে রেখে, সেটির ভাষা ও ঘটনাপ্রসঙ্গ হুবহু ব্যবহার করে নিজের মতো করে ‘নষ্টনীড়’-এর মতো বেশ আকারে-বড়ো গল্পটিকে মাত্র পাঁচটি পাতার মধ্যে সাজিয়ে নিলেন। নিশ্চিতভাবে বলা দরকার, সত্যজিতের পাশে রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্পটি ছিলই-ছিল। যেমন, আরেকটি জায়গাতে সত্যজিৎ লিখছেন, ‘চারু: এসো আমরা কাগজ বের করি--- হাতে লেখা কাগজ--- আমরাই লেখক--- আমরাই পাঠক।’ তার পাশে একটি বন্ধনীর মধ্যে দুটি শব্দ লেখা: ‘চারুপাঠ’ আর ‘অমলা’। মূল গল্পের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে দেখি, চারু বলে, ‘ঠাকুরপো, এসো আমরা একটা মাসিক কাগজ বের করি। কী বলো।’ তারপরে সে জানায়, ‘আমাদের এ কাগজে কোনো খরচ নেই। ছাপা হবে না তো। হাতের অক্ষরে লিখব। তাতে তোমার আমার ছাড়া আর কারও লেখা বেরোবে না, কাউকে পড়তে দেওয়া হবে না। কেবল দু-কপি করে বের হবে। একটি তোমার জন্যে, একটি আমার জন্যে।’ রবীন্দ্রনাথের লেখা চারুলতার সংলাপ ‘তাতে তোমার আমার ছাড়া আর কারও লেখা বেরোবে না, কাউকে পড়তে দেওয়া হবে না’ বাক্যটিই সত্যজিতের লেখাতে হল, ‘আমরাই লেখক--- আমরাই পাঠক’। এবার কথা, ওই ‘চারুপাঠ’ আর ‘অমলা’ শব্দ দুটি কেন বন্ধনীর মধ্যে লিখলেন হঠাৎ সত্যজিৎ? মূল গল্পে ওই হাতে লেখা পত্রিকার নাম কী হবে, সেই আলোচনায়, ঠাকুরপো অমল, তার প্রিয় বৌঠানের নামটির সঙ্গে ধ্বনিসাদৃশ্যে বলে, ‘কাগজের নাম দেওয়া যাক চারুপাঠ’ আর বৌঠান তার প্রিয় দেবর অমলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বলে, ‘না, এর নাম অমলা’। ছবিতে এই প্রসঙ্গটি আসেনি। কিন্তু এই বন্ধনীভুক্ত শব্দাবলি বসানোর একের পর এক সূত্র ধরে স্পষ্ট সত্যজিৎ প্রথমে রবীন্দ্রনাথের গল্পটিকে পাশে রেখে তাকে সাজালেন। তারপরে দ্বিতীয় খসড়াতে তাকে সাজালেন নিজের ছবির যুক্তিতে।

আরও পড়ুন
দুই বালকের গল্প

নষ্টনীড় অবলম্বনে সত্যজিতের লেখা প্রথম খসড়া।

 

সেই দ্বিতীয় কিস্তির কথা আসছে আগামী রবিবার। শুধু এখন এটুকু বলে রাখা যাক, সেই দ্বিতীয় খসড়ার যেখানে শুরু, তার মাথায় দুদিকে কিছু অদ্ভুত কথা লেখেন সত্যজিৎ। পাতার ডানদিকে লেখেন, ‘গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত’ আর পাতার বাঁদিকে লেখা ‘বাড়ি - নীড়’। ওই ‘বাড়ি’ শব্দে একটি তির চিহ্নিত করে ‘বাড়ি’-র সঙ্গে যুক্ত করেন একটি শব্দ ‘ছাত’, তার পাশে আবার একটি বন্ধনীতে লেখেন, ‘রান্নার ধোঁয়া কোথা দিয়ে বেরোয়? আশেপাশে অন্যান্য বাড়ি - normal’। ‘গ্রীষ্ম-বর্ষা’ লেখার কারণটি অনুমান করা যায়, এই সময়চক্র ধরেই তো এগোবে ‘চারুলতা’ ছবির চিত্রনাট্য। ‘নষ্টনীড়’ শব্দের ‘নীড়’ শব্দের সঙ্গে যুক্ত করে ‘বাড়ি’ লিখেছেন, তাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ওই বন্ধনীভুক্ত বাক্যটি কেন লিখলেন তিনি, সে রহস্য এখনো বুঝতে পারিনি। ‘মানিকলমকারি’-র পাঠক একটু সাহায্য করবেন?

আরও পড়ুন
নিষ্ঠুর গল্পের অভিনব শিল্পরূপ

Powered by Froala Editor