প্রোফেসর শঙ্কুর চিত্রনাট্য

ফেলুদার গল্প থেকে সত্যজিতের করা চিত্রনাট্য আর তা থেকে তৈরি হওয়া ছবির কথা কারই বা না-জানা। ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ ছবি আর দূরদর্শন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য সত্যজিৎ করেছিলেন। আক্ষেপ ছিল একটাই--- প্রোফেসর শঙ্কুর কোনো গল্পের চিত্রনাট্য কি সত্যজিৎ করেননি! তবে খবর হল, দূরদর্শন ধারাবাহিক ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’-এর জন্য ফেলুদার জন্য যেমন ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ গল্পের চিত্রনাট্য লেখেন ফেলুদার স্রষ্টা, তেমনই প্রোফেসর শঙ্কুর স্রষ্টাও ওই ধারাবাহিকের জন্যে লিখেছিলেন একটি চিত্রনাট্য। তবে, টিভির গল্পে বিদেশে শুটিংয়ের ঝামেলা এড়াবার কথা ভেবেই সম্ভবত, শঙ্কুর গল্প বলতেই যেমন বিদেশের পটভূমির কথা মনে পড়ে, সেই রকম কোনো গল্প বাছেননি তিনি। বেছেছিলেন এমনই গল্প যেখানে মোটের ওপর গিরিডির পটভূমিতেই সেরে নেওয়া যাবে শঙ্কুর শুটিংপর্ব। যদি এই পটভূমি গিরিডি থেকে অন্য করে নিয়েছিলেন অন্তত সেই চিত্রনাট্যে। সে কথায় পরে আসব। গল্পের নাম ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা’। সেই চিত্রনাট্যের সন্ধান পাওয়া গেল গত বছর পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত ‘থ্রি রেজ্’ বইটিতে। সম্ভবত বাইশ-তেইশ মিনিটের পর্বওয়ালা সেই টিভি ধারাবাহিকের তিনটি পর্বে তৈরি হবে সেই ছবি--- এমনই একটা ভাবনা সত্যজিতের ছিল। চিত্রনাট্যে তাই দেখা যাবে, ‘পার্ট ওয়ান-টু-থ্রি’ হিসেবে তিনটি অংশ। এই খসড়া চিত্রনাট্যে খুব যে পরীক্ষামূলকভাবে গল্পটিকে ভেঙেছেন সত্যজিৎ, তেমনটা হয়ত নয়। আবার উল্টো করে ভাবলে, সত্যজিতের গল্প লেখাটাই যে কতখানি চিত্রনাট্যের মতো, এটা যেন তারও একটা চিহ্ন! চিত্রনাট্যে গল্পকে না ভাঙলেও, হাজার হোক স্রষ্টার নিজের-লেখা শঙ্কুর চিত্রনাট্য বলে কথা! মানিকলমকারির বৃত্তান্তে তো তার গুরুত্ব থাকবেই।

গল্পটা যাদের পড়া, তাদের মনে আছে, গল্পের শুরুতে শঙ্কুর কাছে প্রথমে উপস্থিত হয় দয়ারাম বোস নামের এক নিতান্ত সাধারণ ভদ্রলোক। গিরিডির দিকেই ঝাঝার পোস্টাফিসের চাকুরিজীবী। গল্পে তিনি এসে তাঁর ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলেন, যদিও তার অসুখটা যে কী সেটা বোঝা যায় না। শঙ্কু তাকে বোঝান, তিনি তো আর ডাক্তার নন, তাই তার অবস্থা দেখে তার হাতে গোটা কুড়ি টাকা দিয়ে শঙ্কু নিজের পরিচিত এক ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলে তাকে সেদিনের মতো আসতে বলেন। পরের দিন দেখা যায়, সেই ডাক্তার নিজেই ওই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন শঙ্কুর গিরিডির বাড়িতে। চিত্রনাট্যে প্রথমদিনেই ডাক্তার আর দয়ারাম বোস একসঙ্গে হাজির শঙ্কুর কাছে--- এখানে আর শঙ্কুকে পাঠাতে হয়নি ওই ডাক্তারের কাছে। ডক্তার নিজেই তাঁর রোগীর অদ্ভুত অসুখের কথা জেনে, ব্যাপারটা কী বুঝতে না পেরে বোসকে নিয়ে এসেছে শঙ্কুর কাছে। চিত্রনাট্যে গল্পের ডাক্তার গুহ মজুমদার হয়ে গেছেন ডাক্তার বোস আর ওই দয়ারাম বোস হয়ে গেছেন মিস্টার মিত্র। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল, কাহিনির পটভূমি গিরিডি থেকে সরে এসেছে একেবারে কলকাতায়। মিত্তিরবাবুর বাড়ি ভবানীপুরে। সেখানেই আছে তাঁর সেই আশ্চর্য ছেলে! গল্পে তার নাম ছিল অমূল্যকুমার বোস আর চিত্রনাট্যে অমূল্য হয়ে গেছে অজয়কুমার মিত্র। অনুমান করা চলে, হিন্দিতে ওই গুহ মজুমদার, অমূল্য শব্দগুলি একটু অপরিচিত ঠেকতে পারে ভেবে তাদের মিত্র বা অজয় করে নিয়েছেন চিত্রনাট্যে সত্যজিৎ। গল্পে অমূল্যর বয়স ছিল চার, ছবিতে অজয়ের বয়স হয়েছে আট--- বোঝাই যায়, চার বছর বয়সের খুদে অভিনেতা নিয়ে কাজ করার চেয়ে সহজতর হবে ভেবেই হয়ত ‘খোকা’-র বয়স চার থেকে আট করেছেন তিনি। এই আশ্চর্য বাচ্চার অদ্ভুতভাবে সবজান্তা একটা মন! সে ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান তো জানেই, জানে তার সামনে থাকা মানুষটির চোখের চশমার পাওয়ার কত তাও। গল্পের মতোই শঙ্কুও সেই বাচ্চাকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। তবে, গল্পে ছিল সেই বাচ্চার মা বলেছিল, ‘আপনি ওকে নিয়ে যেতে চান তো নিয়ে যান, কিন্তু দয়া করে ঠিক যেমনটি ছিল, তেমনটি করে ফেরত দিয়ে যাবেন। চার বছরের ছেলের চার বছরের বুদ্ধিই ভালো।… আমরা ওর কথা বুঝিই না! ছেলে যেন আর আমাদের ছেলেই নেই। এতে মনে বড়ো কষ্ট পাই ডাক্তারবাবু।’ চিত্রনাট্যে এই কথাটা অবশ্য শঙ্কুকে বললেন খোকার বাবা--- আর সেখানে সেই মা চরিত্রটি বাদ গিয়েছে।

খসড়া চিত্রনাট্যের একটি পাতা

 

গল্পে ছিল শঙ্কুর প্রতিবেশী অবিনাশবাবুই প্রথমদিন শঙ্কুর কাছে খোকাকে দেখে তার খবর সাতকাহন করে বেড়ালেন যত্রতত্র--- তারপরে সেই খবর পৌঁছে গেল সংবাদপত্রের দফতরেও। চিত্রনাট্যে অবশ্য প্রথম ফোনটা সংবাদপত্রের দফতর থেকেই। শঙ্কুকে ফোন করে সংবাদপত্রের অফিস থেকে। শঙ্কু কিছু না বললেও, খবর বেরিয়ে গেল ঠিকই। পটভূমি কলকাতা বলেই, এখানে শঙ্কুর কাছে পেপার থেকে ফোন আসে আর শঙ্কুও খোকার খবর কাগজে বেরিয়ে যায় বলে, পুলিশে তার নিরাপত্তা চেয়ে ফোনই করে। চিত্রনাট্যে সংবাদপত্রে খোকার খবর পড়ে অবিনাশবাবু হাজির হলেন শঙ্কুর কাছে। এছাড়া, কাহিনিতে যে অংশটি খুব সামান্য ছিল, সেটা ছবিতে দেখানোর খতিরে বেশ বড়ো হয়ে উঠল। তা হল, খোকাকে নিয়ে এক ইম্প্রেসারিয়োর উদ্যোগ। চিত্রনাট্যে সে সটান হানা দিল খোকার বাবার কাছে, টাকার প্রলোভন দেখিয়ে খোকাকে নিয়ে সে ফেঁদে বসল এক শো! একজন ম্যাজিশিয়ানের আশ্চর্য খেলা দেখানোর সঙ্গী হয়ে উঠল এই খোকা। কিন্তু সেখানে একদিন হঠাৎ নাটকীয়ভাবে কোনো কথা বলা থামিয়ে দিল খোকা। পরে শঙ্কু যখন তাকে জিগেশ করল, ‘হোয়াই ডিড ইউ নট অ্যানসার?’ এর উত্তরে জানাল সে, ‘আই অ্যাম নট এ ক্লাউন ইন এ সার্কাস।’ শঙ্কু তাকে বলে, ‘ওয়েল আই থিঙ্ক ইউ ডিড দ্য রাইট থিং।’ এরপরে আরো একটি ঘটনা চিত্রনাট্যে ঘটে, সেটিও ছিল না গল্পে।

আরও পড়ুন
মানিক এক অন্য লেখক

দেখা যায়, অন্য এক ভদ্রলোক--- নাম জগদীশ ব্যানার্জি হাজির হলেন শঙ্কুর কাছে। তিনি শঙ্কুর কাছে এসেছেন তাঁর ছেলের এক সমস্যা নিয়ে। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে তাঁর ছেলের। তিনি দেখেছেন এই খোকার আশ্চর্য শো--- আর তার থেকে মনে হয়েছে, এই খোকার মধ্যে আছে কোনো দিব্যশক্তি--- সেই দিব্যশক্তি দিয়ে কি সে পারে না তাঁর ছেলের আরোগ্য ঘটাতে! শঙ্কু তাকে ফিরিয়ে দেন এই বলে যে, এই ছেলেটির মধ্যে কোনো দিব্যশক্তি নেই। অর্থাৎ, কাহিনি থেকে চিত্রনাট্যে বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা যুক্ত করলেন চিত্রনাট্যকার। শেষটি অবশ্য একই রকম গল্পের মতোই।

আরও পড়ুন
গুগাবাবা চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!

একটি রাত্রে হঠাৎই শঙ্কুর গবেষণাগারে পৌঁছে শঙ্কুর তৈরি বেশ কিছু শক্তিশালী ওষুধের মিশ্রণ নিজেই তৈরি করে খেয়ে ফেলল ছেলেটি। সে এক সাংঘাতিক শ্বাসরুদ্ধকারী ক্লাইম্যাক্স। প্রায় জোর করে ছেলেটি শঙ্কুর নিষেধাজ্ঞা না মেনেই মিশিয়ে চলেছে একের পর এক রাসায়নিক। আর কী অদ্ভুত, সেই সব মিশ্রণই কাজ করল খোকার উপর--- প্রথমে একেবারে ঝিমিয়ে পড়ে ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়ে এল। গল্পে ছিল বাপ-মার কাছে ছেলেটির ফিরে যাওয়ার ঘটনা--- ছবিতে সে শুধু শেষে বলল, ‘হোয়্যার ইজ্ মাই মাদার? আই ওয়ান্ট টু গো টু মাই মাদার।’ সেখানেই ছবির শেষ। আক্ষেপ থেকেই গেল, কেন যে শেষমেশ তৈরি হল না এই শঙ্কুর কাহিনি?    

আরও পড়ুন
গুগাবাবা: চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!

          ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা’ গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। তার চার বছর পর সত্যজিৎ লিখলেন ‘সোনার কেল্লা’। সে তো আরেক বিস্ময় বালকের কাহিনি। সেখানেও কিন্তু বদলে যাওয়া বালক আর তাকে ঘিরে তার বাপ-মায়ের উৎকণ্ঠা হয়ে উঠবে কাহিনির বিষয়। সেখানেও কিন্তু গল্পে মুকুলের স্বাভাবিকতায় ফেরার বাক্যটি গল্পে ছিল ‘মুকুল সামনের বাগানে দিব্যি ফূর্তিতে খেলে বেড়াচ্ছে। কারণ সে জানে আজই সে কলকাতা রওয়ানা হবে। সোনার কেল্লা দেখার পর আর রাজস্থানে থাকার ইচ্ছে নেই।’ ছবিতে মুকুলের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার সংলাপ ছিল, তার বাড়ি ফেরার ইচ্ছে। এখানে তার বছর চারেক আগেও ওই বিস্ময় বালকের স্বাভাবিক হওয়ার ইচ্ছেসূচক বাক্যটি হল, তার মায়ের কাছে ফেরার ইচ্ছে। কোনো ভাবে কি তাহলে গভীরে মিলে আছে, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা’ গল্পের খোকা আর ‘সোনার কেল্লা’-র মুকুল!

আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব-২

Powered by Froala Editor