গুগাবাবা: চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!

সত্যজিৎ রায়ের তাঁর খেরোর খাতায় ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোরের লেখা গুপি গাইন গল্পের একটি খসড়া তৈরি করেছিলেন ইংরাজিতে। পুরো গল্পটাই সেই গল্পের পুনর্লিখন। ঠাকুরদার গল্পটাকে সাজিয়েছিলেন নতুন করে। বলা বাহুল্য, সেটা ছিল গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবি তৈরির একটা প্রাথমিক খসড়া। সেই পুনর্লিখন অবলম্বনেই তৈরি করা হয়েছিল গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবির চিত্রনাট্য। গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবির এই পুনর্লিখিত গল্পটা কি লেখক সত্যজিতের আক্ষরিক অর্থেই এক নতুন কলমকারির নমুনা নয়? ভবিষ্যতে যখন সত্যজিৎ-রচনাবলি-র কাজ করা হবে, তখন এই পুরো লেখাটিকেই তাঁর অপ্রকাশিত লেখা বলে সংকলিত করা দরকার। সেই খসড়া গল্পটাকে আজ পড়ার পালা, সঙ্গে দেখা দরকার, পরে গুপি গাইনকে নিয়ে যে ছবি তৈরি হল, তার থেকে কোথায় কোথায় আলাদা ছিল সেই প্রথম লেখা গল্পের খসড়া। এই কিস্তির পাঠককে বিনীত অনুরোধ, আপনার বহু বহুবার দেখা গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবির দৃশ্যগুলি আপনি একটু মনে করতে করতে যাবেন, দরকারমতো আমি এই কথক-ঠাকুর মাঝে মাঝে সুতোর মতো ধরিয়ে দেবো কাহিনিসূত্র। তাহলেই বোঝা যাবে, কেমন ছিল সেই সত্যজিতের গল্প থেকে সত্যজিতের তৈরি ছবির গল্প।

সিনেমা যেমন শুরু হয় সেই বিখ্যাত দৃশ্য চাষের মাঠে জনৈক দ্বিজুখুড়ো চাষ করছে আর কাঁধে তানপুরা নিয়ে গুপি হেঁটে যেতে যেতে তাকে বলছে, ‘তুমি চাষা আমি ওস্তাদ খাসা’ দিয়ে, সেই গল্প কিন্তু তেমনভাবে শুরু হয়নি। সেখানে প্রথম দৃশ্যে ছিল কানু কাইন, মানে গোপীনাথ কাইনের বাবা কানু কাইনের মুদির দোকানের দৃশ্য দিয়ে। একজন ক্রেতা এসে অপেক্ষা করছে, দোকানে না কাছে কানু, না আছে তার ছেলে গুপী। এক রকম চিৎকার জুড়ে দেয় সেই ক্রেতা অপেক্ষা করতে করতে। ছুটে আসে কানু কাইন। সে বলে, আর বলবেন না আমি আমার অপদার্থ ছেলেটা কোথায় গেল দেখতে বেরিয়েছিলাম--- হয়ত তাকে দোকানে বসিয়ে কোথাও যাওয়ার ছিল তার। স্বাভাবিক প্রশ্ন, কেন কোথায় গেল তোমার ছেলে? বাবা বলে, আর বলবেন না, সে নিজেকে এক মস্ত গাইয়ে মনে করে। লোকের কথায় শুনি, সে কী, তার তো বিকট হেঁড়ে গলা। কানু জানায়, সে আর তাকে কে বলে বলুন, তার গলা হল ব্যাঙের মতো, আর সে কিনা নিজেকে কোকিলকণ্ঠ ভাবে! তারপরের দৃশ্য পাশের গ্রামের একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। সেখানে ত্রিশ টাকা খরচ করে গুপি একটা তানপুরা কেনে। তা কিনে সে গ্রামে ফেরে--- এখানে ছবির সেই বটতলার বাবুদের সঙ্গে গুপির কথাবার্তা আর তাদের গান-শোনানো আর তারপরে তাদের একজন বলে, ‘লুক আই হ্যাভ এ ওয়ান্ডারফুল আইডিয়া। দ্য কিং ইজ্ ভেরি ফন্ড অফ মিউজিক। আই থট ইউ সিং ইয়োর সং টু দ্য কিং। আই অ্যাম সিয়োর হি উইল রিওয়ার্ড ইউ হ্যান্ডসামলি।’ তারপরে সেই বুড়ো তাকে দেখিয়ে দেয় রাজাকে গান শোনাবার উপায়, অনেকটা ছবির মতো করেই। সেখান থেকে গুপি বাড়ি ফেরে, বাপের মুখোমুখি হয়, তার দ্বারা গান হবে না বাবা বলে। তবে সিনেমাতে যেমন গুপিকে বাড়ির হাজার কাজ করিয়ে মুফতে নিজের ভাঙা তানপুরা গছিয়ে দিয়েছিল ওস্তাদ গাইয়ে, প্রথম খসড়াতে তো তা ছিল না। ফলে বাড়ির তিরিশ টাকা খসিয়ে তানপুরা কেনার জন্য বাবা কানু ছেলেকে যারপরনাই ভর্ৎসনা করে। বাপের বকুনি খেয়ে গুপি গুটিগুটি পায়ে নিজেদের মুদির দোকানে যায় সেখানে অপেক্ষমান এক ক্রেতাকে এক সের সর্ষের তেল ওজন করে দেয়।  

তারপরে আবার ছবির মতোই। রাজা ঘুমোচ্ছেন এক মশারির ভেতর। লেখা ‘দ্য কিং ইজ্ ইনসাইড এ মশকিউটো কার্টেন অন দ্য রয়্যাল বেড। গুপি-জ্ হোয়ার্য় ভয়েস ওয়েকস হিম আপ।’ এরপর রাজা চিৎকার করে সিপাইকে ডাকে। কিন্তু রাজার কণ্ঠ সম্পর্কে একটি মন্তব্য লেখা ছিল সেখানে--- তা হল, ‘উই নোটিশ দ্যাট দ্য কিং হ্যাজ্ এ ভয়েস ইভেন হোয়ার্সের দ্যান গুপি’। এখানে প্রসঙ্গত একটা কথা বলে রাখা ভালো, এই গোটা খসড়াতেই ইংরাজিতে গুপি বানান সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘Goupi’!

আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব-২

রাজার সভায় গুপিকে আনার ঘটনা এখানে ছিল, তবে ছিল না সেখানে ওই স্তাবকদের দল--- যারা রাজার সব কথাতেই হ্যাঁ হ্যাঁ করে যাচ্ছিল। রাজা সেই তানপুরা ছুড়ে ভেঙে দেয় আর গুপিকে রাজ্য থেকে গাধার পিঠে তুলে বের করে দিতে হুকুম দেয়। গল্পে গুপির গাধা পৌঁছেছিল একটা গাজরের ক্ষেতে, সেখানে ক্ষেত থেকে একটা গাজর তুলে খেতে থাকে গুপি আর গাধাটাকে ফেরত পাঠায় আমলকি গ্রামে। হ্যাঁ, সেই গল্পেও আমলকিই ছিল গুপির গ্রামের নাম। এখান থেক সিনেমাতে যেমন গুপি যায় একেবারে জঙ্গলের ভেতর, সেই খসড়া গল্পে কিন্তু তা যায়নি সে। সে বিকেলবেলা পৌঁছেছিল আরেকটি গ্রামে। সেই গ্রামে গুপির যে খুব খিদে পেয়েছিল, তার একটা ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। সেই গ্রামের একটি মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়ায় সে। দেখতে পায় এক ধনী বাবুশ্রেণির লোক দোকান থেকে জিলিপি আর কচুরি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় কী ঘটে, সেটা সত্যজিতের লেখা থেকেই পড়া যাক---

আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব

Suddenly a kite swoops down from the sky and snatches a packet from the Babu’s hand with its beak and flies off.

আরও পড়ুন
ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি- অন্যভাবে পড়া

Goupi looks up and a wad of kachuris dropping from the packet land on his upturned face. Goupi grabs hold of them before they fall on the ground, then turns to see the Babu eyeing him curiously. For a moment Goupi doesn’t know what to do. Then he takes to his heels. The Babu, too fat to give chase, gives up, muttering invectives.

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সংলাপ-ভাবনা

Making a meal of the kachuris, Goupi has the strength to continue walking.     

গল্পের খসড়ার এই দৃশ্য বাদ গেছে ছবিতে। তারপরে জঙ্গলের দিকে যাওয়া আর ঢোলের ওপর জল-পড়ার শব্দ শুনে বাঘাকে দেখতে পাওয়ার দৃশ্যগুলি এক। তবে, সেখানে গুপি-বাঘার দেখা হওয়ার মুহূর্তটা আবার একেবারে অন্য রকম। ছবিতে দেখি যেমন বাঘা মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে হঠাৎ দেখতে পেল গুপিকে, সেই খসড়াতে তা তেমনটি ছিল না। সেখানে ছিল গুপি কিছু একটা দেখে ভয় পেয়ে যায়। আমরা দেখতে পাই একটি লম্বা সাপের মুখ এগিয়ে আসছে বাঘার দিকে। গুপি তো ভয়ে একেবারে কী করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ বাঘার ঘুম ভেঙে যায়, সে তাকায় সাপটার দিকে, আর সহজভাবে, একেবারে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে দেয় সেই সাপটাকে। কিন্তু তারপরে, হঠাৎ গুপিকে দেখে সে চমকে ওঠে। ভাবটা এমন, এই জঙ্গলে হাতের ওপর সাপ আসবে এটা তো স্বাভাবিক, কিন্তু এখানে জন-মানুষ এলো কোত্থেকে। কিংবা এইভাবেও ভাবা যেতে পারে, সেই বাঘা সাপকে তত ভয় পায় না, যত ভয় পায় মানুষকে! বাঘা লাফিয়ে উঠে হাতে নেয় তার ঢোলের শক্ত কাঠি। লাঠি হাতে নিয়ে বাঘা বলে, আর এক পা এগোলে তোমাকে তোমার বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো। গুপি বুঝতে পারে, নিজের সঙ্গে যেভাবে বেঁধে রেখেছে তার ঢোল, বাঘা খুব একটা এগোতে পারবে না। তাই সে-ই এগিয়ে গিয়ে মজা করে নিজের বাবার নাম বলে, ‘কানু কাইন’। বাঘা আরো রেগে যায়, বলে, ‘আর এক পা এগোলে তোমার নাম ভুলিয়ে দেবো।’ গুপি আবারো এক পা এগোয় আর চিৎকার করে নিজের নাম বলে, ‘গুপি গাইন’। গাইন শুনে বাঘা বুঝতে পারে, এ গাইয়ে।  

অতঃপর বাঘ আসে। বাঘ দেখে ওরা ভয় পায়। বাঘা ফিরে যায়। তারা মনের আনন্দে নাচ-গান করতে থাকে আর বিকট শব্দে বাঘা ঢোল পেটাতে থাকে। আর ঠিক এখানেই সেই সর্বজনপ্রিয় দৃশ্য--- ভূতের রাজার আগমন। সেই ভূতের রাজার আগমন দৃশ্য দিয়েই আজকের কিস্তি শেষ করা যাক। এই খসড়াতে দেখি, তাদের নাচগানের সঙ্গে তাদের চারপাশ আরো অন্ধকার হয়ে যায়। চারপাশে ঘুরতে থাকে আলোর বিন্দু। সেই বিন্দু থেকে ভূতের রাজা হয়ে ওঠার ব্যাপারটা এই খসড়া গল্পে কেমন ছিল, সেটা হুবহু উল্লেখ করা দরকার। কারণ, সত্যজিৎ-চর্চায় তার গুরুত্ব ঐতিহাসিক। সত্যজিৎ লিখছেন---

...suddenly Goupi and Bagha realize pairs of many lights approaching from the depths of the forest.

The lights approach and from themselves as pairs of eyes belonging to dark grotesque, two-legged forms with long, pointed ears and sharp, pointed teeth. But the teeth are formed in the broadest of grins, and somehow these demon-forms are not so terrifying.

ভূতের রাজা ছিল, ছিল ভূতের নাচও। তবে তখন লেখা ছিল, তাদের নাচ চলতে থাকবে এদের অদ্ভুতুড়ে গান আর ঢোলের তালে তালে। গল্পে লেখা ছিল নাচের ধরন, ‘সাম টার্ন ক্যাটহুইলস, সাম ফর্ম দেম সেলভস ইনটু পেয়ার্স অ্যান্ড ড্যান্স অলমোস্ট লাইক ওয়েস্টার্ন কাপলস, আদার্স হ্যাভ ফেদার্স হুইচ সাজেস্ট ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল প্যাটার্ন উইথ অর্নামেন্টস অন দেয়ার হ্যন্ডস অ্যান্ড লিম্বস।’ মানে সেখানে নানা ধরনের মানুষের নাচ ছিল না, ছিল পশ্চিমি আর পূর্বি নাচের ধরনের একটা ফিউশন! তা সেই ভূতের নাচের শেষে, ভেসে ওঠে ভূতের রাজার মুখ। তাঁকে গুপি বলে আপনার কি আমাদের গান-বাজনা ভালো লেগেছে? বাঘা বলে, ‘সত্যিই কি আপনার আমাদের গান-বাজনা ভালো লেগেছে।’ ভূতের রাজা তাদের বলেন, ‘ইয়েস, বাট মর্টালস ওন্ট। নট দ্য ওয়ে ইউ মেক মিউজিক।’ তার উত্তরে তাদের দুজনকেই যে তাদের গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, সেটা তারা জানায়।    

এরপরে সেই ভূতের রাজা সেই গল্পের খসড়াতে গুগাবাবা-কে তিনটি নয়--- চারটি বর দেন। একটি বর হল, মানুষের ভালো লাগবে এমন গান-বাজনা করার বর, তাদের গান-বাজনা শুনে লোকে থ হয়ে যাবে, নড়তে চড়তে পারবে না। দুই, ‘ইউ মে আস্ক ফর এনি ফুড এউ লাইক অ্যান্ড ইট উইল কাম টু ইউ’। তিন নম্বর, ‘ইউ মে আস্ক ফর এনি ক্লোদস ইউ লাইক অ্যান্ড ইউ উইল গেট দেম।’ আর চার নম্বর হল, ‘হিয়ার ইজ্ এ পেয়ার অফ স্লিপার্স ফর ইউ হুইচ উইল টেক ইউ এনি হোয়্যার ইউ ওয়ান্ট টু।’ মজার ব্যাপার হল, সত্যি বলতে কী বর তো চারখানাই। শুধু পরে চিত্রনাট্যে, ‘খাওয়া-পরার কোনো চিন্তা না থাকে’ বলে যে একটি বাংলা কথার শব্দবন্ধে তিনটি বরের ভেতর চারটে বর চেয়ে নেয় গুগাবাবা--- সেটা আমরা লক্ষ্যই করি না। একটা যা খুশি খাওয়ার বর, আরেকটা যা খুশি পোশাক পরার বর! বুদ্ধি বটে গুগাবাবা-র!

পরের রবিবার, গুগাবাবা-র তারপরের গল্পই চলতে থাকবে। শুনতে থাকা যাবে কেমন ছিল খসড়ার গল্প আর তা থেকে কেমন হল সিনেমার গল্প?    

Powered by Froala Editor