তারিণীখুড়োর তামাম-জীবন ১

প্রফেসর শঙ্কু চরিত্রটি সত্যজিৎ তৈরি করেন ১৯৬১ সালে। ১৯৬৫ সালে তৈরি হল ফেলুদা। তার বহু পরে, ছোটোদের পত্রিকা ‘আনন্দমেলা’-র একটি সাধারণ সংখ্যায় প্রকাশিত হল ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’। সত্যজিতের তৈরি তৃতীয় চরিত্র তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-বলা শুরু হল এই গল্প থেকে, প্রকাশকাল ১৯৮২। এ এক নতুন ধরনের চরিত্র। এই চরিত্রটি গল্প বলেন। পাঁচজন খুদে গল্পখোর তারিণীখুড়োর শ্রোতা। এই পাঁচ শ্রোতা হল, ভুলু, চটপটি, সুনন্দ, ন্যাপলা আর আমি। এই ‘আমি’-র নাম হল পল্টু। প্রফেসর শঙ্কুর গল্পে যেমন গল্প ‘পড়ি’ আমরা স্বয়ং প্রফেসর শঙ্কুর লেখা ডায়ারি থেকে, ফেলুদার গল্প যেমন ‘লেখে’ তোপসে, তেমনই এখানে ওই গল্প-শুনিয়ে অন্যতম খুদেই যেন আমাদের শোনাচ্ছে গল্প। গল্পের ভেতরে দুজন ‘আমি’। একজন ‘আমি’ হল সেই খুদেদের একজন--- যার সামনে গল্প হাজির করেন তারিণীখুড়ো আর খুড়োর বলা সেই গল্পের ভেতরে ‘আমি’ বলতে তো অবশ্যই তারিণীখুড়ো নিজেই।

তারিণীখুড়ো গল্প বলেন, তিনি তাঁর সারা জীবনের আশ্চর্য সব ঘটনা শোনান এই খুদেদের কাছে। সারা জীবন বিচিত্র রকম পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি, সেই কাজের সূত্র ধরেই তাঁর জীবনে ঘটেছে একের পর এক ঘটনা। তাঁর ভাষায় তিনি নাকি দেশের ‘তেত্রিশটি শহরে ছাপ্পান্ন রকম’ কাজ করেছেন। শঙ্কুর ঘটনাগুলি যেমন মোটের ওপর পৃথিবীজোড়া আর ফেলুদা যেমন সাধারণত দেশেরই বিভিন্ন বিখ্যাত শহরে জড়িয়ে পড়ে ঘটনার সঙ্গে, তেমনই তারিণীখুড়োর ঘটনাগুলি ঘটে দেশের নানা স্বল্প-জানা শহরে। তার মানে, এই সিরিজের গল্পমালাতে যে বিষয়গুলি যুক্ত হল, তা হল, প্রথমত, এখানে একটি আড্ডাতে শোনানো হচ্ছে গল্প। দ্বিতীয়ত, দেশের নানা স্বল্পজ্ঞাত শহর এর পটভূমি। কখনো ডুমনিগড়, কখনো ধুমলগড়, কখনো পুনে বা কখনো মার্তণ্ডপুর বা মান্দোর এস্টেট। এমনকি, তাঁর গল্পে স্থাননাম শুনে গল্পের শ্রোতা যদি ফোড়ন কাটে সেই জায়গাটি ‘ম্যাপে আছে?’ তাহলে, তিনি শুনিয়ে দেন, ‘তোর কি ধারণা ম্যাপে যা আছে তার বাইরে আর কিছু নেই? ম্যাপ তৈরি করে কারা? মানুষে তো?’ তারপরেই বুঝিয়ে দেন, ম্যাপে যে শহরের নাম নেই, তিনি সেই শহরের নামও নাকি জানান বিভিন্ন অ্যাটলাস কোম্পানিকে। তারা তাঁকে চিঠি লিখে বলে, ‘আগামী সংস্করণে শুধরে নেবে’। এই সব নতুন নতুন জায়গার হদিশ পাওয়ার গল্পও তাই তারিণীখুড়োর গল্প। তৃতীয়ত, এই সিরিজের গল্প গল্প-বলিয়ের নানা রকম পেশার সঙ্গে জড়ানো। বিচিত্র সব পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারিণীখুড়ো। কখনো তিনি কোনো নেটিভ এস্টেটের রাজার ম্যানেজার বা সেক্রেটারি, কখনো নির্বাক যুগের অভিনেতার সেক্রেটারি আবার কখনো তিনি সিনেমার প্রোডাকশনের কাজে যুক্ত, কখনো জাদুকরের চ্যালা আবার কখনো তিনি গণৎকার। আবার কোথাও দেখা যায়, বেশ এলাচের ব্যবসা করেছেন আবার কখনো নিজেই স্বাধীনভাবে স্থানীয় খবরের কাগজে লেখালেখি করছেন আবার নিজেই গল্পলেখার পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ ধনী ব্যবসায়ীর কাছে গল্প-শোনানোটাই তাঁর পেশা। একবার সিনেমাতে অভিনয় করলেও, তারিণীখুড়োর কাছে সিনেমাতে অভিনয়ের নাকি অনেক অফার থাকলেও তিনি কখনো সিনেমাতে অ্যাক্টিং করতে চাননি একটি বিশেষ কারণে। কারণটি হল, তাঁর কথাতেই, ‘আসলে ফিল্মের হিরো হবার শখ আমার ছিল না। আমি চেয়েইলাম আমার গোটা জীবনটাই হবে একটা সিনেমার গপপো। একটা খাঁটি নির্ভেজাল অ্যাডভেঞ্চার। অথবা বলতে পারিস একটা সিরিজ্ অফ অ্যাডভেঞ্চার্স। রং মেখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব, ডিরেক্টরমশাই ডুগডুগি বাজাবেন আর আমি নাচব--- এ শর্মা সে-শর্মা নয়।’   

এখন এই গল্প-বলিয়ে মানুষের সন্ধান সত্যজিৎ পেয়েছিলেন তাঁদের বাড়িতেই। একদিকে ছিলেন তাঁর কাকা সুবিমল রায় আরেকদিকে ছিলেন প্রভাতরঞ্জন রায়। এমনকি, সত্যজিৎরা যখন উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতায় চলে এলেন, তখনো উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় নিয়মিত আসা আর সকলের খবর রাখা আর নানা রকম গল্প শোনাতে-পারা এই কাকাদের কথা সত্যজিৎ নিজেই বলেছিলেন ‘যখন ছোটো ছিলাম’-এর পাতায়। সেই সব ছিন্নসুতোর খেই আমরা এই ধারাবাহিকের আগের নানা পর্বে বুনেছি। সেটা থেকেই বোঝা যাবে এই চরিত্রের আরো অনেক অনেক ছিন্নসূত্র। দেখেছি, ওই উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতায় হেঁটে আসা খুড়োদের গল্পেই এই তারিণীখুড়োর গল্পের একটা ধারাবাহিক বৃত্তান্ত গাঁথা। তারিণীখুড়োর যাত্রা ছিল বেনেটোলা থেকে বালিগঞ্জ। অবশ্য একটি গল্পে বেনেটোলা টু টালিগঞ্জ-ও লিখেছেন গল্পকার।

আনন্দমেলার পাতায় তারিণীখুড়োর প্রথম গল্পের অলংকরণ। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

 

আরও পড়ুন
গীতিকার সত্যজিতের দুটি গান

সত্যজিতের তৈরি এই চরিত্রটি ব্রাহ্মণসম্তান। পুরো নাম তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি গল্পশ্রোতা ‘আমি’ বা পল্টুর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তাসূত্রে যুক্ত নন। গল্পকথক ‘আমি’ বা পল্টু জানায়, ‘খুড়ো আসলে আমাদের কেউ হন না, তবে খুব ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি ইনি মাঝে মাঝে আসেন আমাদের বাড়িতে। আমার জন্মের আগে বাবারা যখন ঢাকায় ছিলেন তখন তারিণীখুড়ো ছিলেন আমাদের পড়শি। তাই খুড়ো। বাবারও খুড়ো, আমাদেরও খুড়ো।’ এই এক নতুন ধরনের আন্তরিক সম্পর্কের গল্প বলা শুরু করলেন সত্যজিৎ। পারিবারিক সূত্রে সেই অর্থে কেউ-না, কিন্তু এক সুন্দর সম্পর্কের কাহিনি। লক্ষণীয়, তারিণীখুড়ো পূর্ববঙ্গীয়--- তিনি ঢাকার বাঙাল। তিনি গল্প বলার জন্য হাতে রাখেন দুধ আর চিনিছাড়া এক কাপ চা। তারিণীখুড়োর গল্পের সঙ্গে এক কাপ চায়ের উপস্থিতি একেবারে অবশ্য উল্লেখনীয়। এই তারিণীখুড়োর গল্পমালা প্রকাশিত হতে শুরু করে জানুয়ারি ১৯৮২-তে, গল্পের নাম ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’ আর সেই গল্পমালার শেষদিকের গল্পগুলি সত্যজিৎ লিখছেন ১৯৮৮ সাল নাগাদ। তার মানে মাত্র বছর ছয়েক। এর মধ্যেই গোটা পনেরো গল্প লেখা হয়েছে এই গল্পমালায়।

আরও পড়ুন
বিশু-শিবু, ভিক্টর আর কেষ্টদা: সিনেমার অন্য মুখ

গল্পের সূত্র ধরে এগোলে দেখা যাবে, কোনো হিসেবমাফিক তাঁর জন্ম ১৯১৬ আর কোনো কোনো গল্প থেকে তা ১৯১৮-১৯১৯ সালের ভেতর। হিসেবটা কেমন? ধরা যাক, ‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’ গল্পে শোনা যায়, সেই গল্পের মূল ঘটনার সময়ে তারিণীখুড়োর বয়স ছিল তিরিশ। গল্পেই বলা হয়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আর পরের গল্প ‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’ গল্পে জানা গেল তখন তাঁর বয়স চৌষট্টি। এই গল্পটি লেখা হচ্ছে ১৯৮২-র মার্চ-এপ্রিল নাগাদ। তাহলে, সেই হিসেবে তারিণীখুড়োর জন্মসাল ১৯১৮। আবার ‘শেঠ গঙ্গারামের ধনদৌলত’ গল্পে হিসেব কষে দেখি তাঁর জন্ম ১৯১৬-তে। কারণ, সেখানে তিনি বলেন, তিনি তখন ছিলেন আজমিরে আর সেটা ১৯৪৪ সাল আর তখন তাঁর বয়স আটাশ। আরো একটা হিসেব আছে ‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ গল্পে। সেখানে তিনি বললেন, ‘আমার তখন তেইশ বছর বয়স, তবে একটা তেকোনা ফ্রেঞ্চকাট গোছের দাড়ি রেখেছিলাম বলে মনে হত তেত্রিশ। বেয়াল্লিশ সালের কথা বলছি।’ তার মানে আবার এই হিসেব অনুসারে তাঁর জন্মসাল ১৯১৯। এই ১৯১৮-১৯-এর অঙ্কটা আবার মিলবে ‘খেলোয়াড় তারিণীখুড়ো’ গল্পে। ১৯৮৫ সালে লেখা সেই গল্পে শোনা গেল, ‘এই পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে কোনো খেলাই বাদ দেয়নি এই শর্মা’। তার মানে, আবার তাঁর জন্মসাল হল ১৯১৮। তার মানে, তারিণীখুড়োর ঠিকঠাক জন্মসালটি কোনো গল্পে পাওয়া যাবে না--- মোটামুটি ধরে নিতে হবে ওই ১৯১৬ থেকে ১৯১৯-এর মধ্যে তাঁর জন্ম। আর তাঁর গল্পমালার ঘটনাকাল মোটের ওপর স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা তার অব্যববহিত পরবর্তী। শুধু ‘জুটি’ গল্পটিকে রাখতে হবে সত্তরের দশকে। যদিও যাঁরা গল্পটা পড়েছেন, তাঁরা জানেন এই গল্পের আসল অংশটি যুক্ত হয়ে আছে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে--- সেই ত্রিশের দশকের আগে। কারণ, এখানে গল্পের একটি অংশ নির্বাক ছবির যুগ আরেকটি অংশ সাম্প্রতিক। নির্বাক যুগের বিখ্যাত জুটি বিশু-শিবুর গল্পের একজন বিশু পরেও বেশ ডাকসাইটে অভিনেতা হল, নাম করল রতনলাল রক্ষিত নামে। হারিয়ে গেল শরৎ কুণ্ডু ওরফে শিবু। বৃদ্ধ বয়সে নির্বাক কমিক ছবির জুটির ওই বিশুর শিবুকে খুঁজে নেওয়ার গল্পই তো এই ‘জুটি’। তাই বলছিলাম, এই কাহিনির একটা অংশ যদি স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে থাকে তো আরেকটা অংশ ছড়িয়ে রয়েছে একেবারে সাতের দশকে। দেখুন পাঠক, মজার কাণ্ড! তারিণীখুড়োর গল্পের মুখড়া গড়তেই আজকের কিস্তি শেষ। এরপরের কিস্তিতে না হয়, বসা যাবে, তারিণীখুড়োর গল্পের ভূতদের নিয়ে।

আরও পড়ুন
গল্পমালার মানচিত্র

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
একুশে ফেব্রুয়ারির সত্যজিৎ