গীতিকার সত্যজিতের দুটি গান

গুপি-বাঘা সিরিজের তিনটে ছবির জন্য লেখা সত্যজিতের গানের কথা তো আমাদের জানা। তবে গীতিকার সত্যজিতের কাজের শুরু ১৯৬৯-এ ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর অনেক আগে। ১৯৬০-এ তৈরি ‘দেবী’ ছবির সেই ‘এবার তোরে চিনেছি মা’ গানটিতে আর ১৯৬৭-র ব্যোমকেশ-কাহিনি থেকে তৈরি ‘চিড়িয়াখানা’-র জন্য লেখা পুরোনো বাংলা সিনেমার গান ‘ভালোবাসার তুমি কী জানো’ থেকে। তার দুই বছর পরে একেবারে পুরোপুরি মিউজিকাল ‘গু-গা-বা-বা’। লক্ষ করার মতো গুপির গান লেখা আগে সত্যজিৎ যে দুটি গান লিখেছেন, সেই দুটি গানের বাণীর মধ্যেই একটা অন্য স্টাইলাইজেশন বা ভাষাগত অন্য শৈলী আছে। ‘দেবী’-র গানটি তাঁকে লিখতে হচ্ছে একটি শ্যামাসংগীতের ভাষারূপ ব্যবহার করে আর ‘চিড়িয়াখানা’-র গানটি লিখতে হচ্ছে পুরোনো বাংলা সিনেমার গানের ভাষারূপ ব্যবহার করে। মজার ব্যাপার, এক অর্থে ব্রাহ্মসামাজিক সত্যজিৎকে লিখতে হল ছবির দরকারে শ্যামাসংগীত আর যে-ধরনের বাংলা ছবি তাঁর সেই-অর্থে না-পসন্দ, সেই চিত্ররূপে কেমন ধরনের গান হতে-পারত, সেই গান-ই লিখলেন সত্যজিৎ ‘চিড়িয়াখানা’-র জন্য। 

প্রথমে ‘দেবী’-র গানটি একবার পড়ে নেওয়া যাক। গানটির বাণী এই রকম--- ‘এবার তোরে চিনেছি মা/ ও তোর নামে কালী, মুখে কালি/ অন্তরে তোর নাই কালিমা/ এবার তোরে চিনেছি মা/ জীবনে মা তুই পাষাণী/ তাতেও আমি বেকুব মানি/ আমি মনে জানি প্রাণে জানি/ পাষাণের ওই কী মহিমা/ এবার তোরে চিনেছি মা/ নূতন রূপে নূতন বেশে/ শ্যামা মায়ে দ্যাখো এসে/ ও তোর দয়ার পরশ/ পেয়ে সরস/ দয়াময়ী গো/ আনন্দেরই নাই গো সীমা’। ছোটো গান। মানে শ্যামাসংগীতের দৈর্ঘ্যের গান। তবে এই ছবিতে একটি রামপ্রসাদের গান তো ছিল, সেই যে, মা মা বলে আর ডাকব না গানটি। সেটি ব্যবহার করা হলেও এই গানটি কেন নতুন করে লিখতে হল সত্যজিৎকে? গানের প্রথম অংশটি এমনিতে শ্যামামায়ের প্রতি ভক্তের কথা। শ্যামাসংগীতে যেমন মায়ের প্রতি অদ্ভুত এক আপাততুচ্ছার্থক ‘তুই’ সম্ভাষণ থাকে, তার ব্যবহার সেখানে যেমন মা-কে খুব ভালোবেসে প্রতিবাৎসল্যে তাকে যেন ‘কু-কথা’ বলেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর বড়ো আপন-করা ধরনটি, সেটাও ব্যবহৃত। তাই তো লেখেন ‘ও তোর নামে কালী মুখে কালি’--- নাম ও রূপের উল্লেখ করে পরের লাইনেই ‘অন্তরে তোর নাই কালিমা’। কী সুন্দর সেকেলে ধরনে কালিমা আর কালী-মা--- দুটো শব্দকেই একসঙ্গে ব্যবহার করলেন সত্যজিৎ তাঁর গানে। তবে গানটির আসল রহস্য অন্যত্র। গায়ক গাইছেন, শ্যামা মাকে চেনার কথা। তাই বলছেন, মা, তোমার নাম কালী, তোমার রূপ কৃষ্ণবর্ণ, কিন্তু তোমার অন্তরে কোনো কালিমা নেই। আর তিনি কীভাবে নতুন করে চিনছেন কালী মাকে? দেখছেন, মায়ের মূর্তি পাথরে তৈরি। বলছেন, ‘জীবনে মা তুই পাষাণী’, বাইরে মায়ের মূর্তি পাষাণে তৈরি দেখে ভক্ত ভাবেন মাকে পাষাণী। এখানে পাষাণী শব্দটিও দ্ব্যর্থক। পাষাণী মানে যেমন পাথরে তৈরি, তেমনই পাষাণী বলতে মা যেন ‘পাষাণ-হৃদয়’ বা কঠিন-হৃদয়ের অধিকারিণী। কিন্তু তা তো মা নন, ভক্ত জানেন, ‘পাষাণের ওই কী মহিমা’। ভক্ত জানেন, শ্যামা মায়ের ‘দয়ার পরশ’ কীভাবে ভক্তের ওপরে এসে পড়ে। সেই স্পর্শেই ভক্ত ধন্য হয়। তিনি কঠিনহৃদয় থেকে হয়ে ওঠেন ‘দয়াময়ী’। ফলে আবার বোঝা গেল, কীভাবে আসলে ভক্ত নতুন করে চেনে মাতৃমূর্তিকে। আর লক্ষণীয়, শ্যামার কোন প্রতিশব্দটি ব্যবহার করলেন গীতিকার সত্যজিৎ? বললেন, তাকে দয়াময়ী। আর ঠিক এই শব্দেই তো পৌঁছতে চাইছিলেন গীতিকার সত্যজিৎ তাঁর ছবির প্রয়োজনে। ‘নূতন রূপে নূতন বেশে, শ্যামা মায়ে দ্যাখ না এসে’। তিনি দয়াময়ী। আমাদের তো মনে পড়বেই যে, কালীর সমার্থক শব্দ যেমন দয়াময়ী তেমনই এই গল্পের মূল চরিত্রটির নামও তো দয়াময়ী। তাহলে এই শব্দটিকে ব্যবহার করার দরকার তাঁর ছিল। অতএব নতুন একটি গান লিখতেই হত তাঁকে। শুধু কি দয়াময়ী নাম ব্যবহার। লক্ষণীয় গানে তিনি অন্য দিক থেকেও বেশ দরকারি সূত্রে লিখলেন, ‘এবার তোরে চিনেছি মা’। কেবল তো ভক্তের গান এটি নয়। এটি তো দয়াময়ীর শ্বশুর কালীকিংকরেরও গান। তিনিও তো বলতেই পারেন ‘এবার তোরে চিনেছি মা।’ এতদিন যে পুত্রবধূকে কেবল পুত্রবধূরূপে দেখেছেন, স্বপ্নে দেখলেন তাঁর পুত্রবধূ সেই দয়াময়ী-ই তাঁর উপাস্য কালী-মা। এদিক থেকে ‘এবার তোরে চিনেছি মা’--- এই বিশেষ বাক্যবন্ধটি একটি সাধারণ বাক্যমাত্র থাকে না, এটি হয়ে ওঠে এই ছবির জন্য তৈরি একটি বিশেষ গানও। এই দুইটি অর্থই তো তাঁর দরকার ছিল গানের কথার ভেতর। তাই সত্যজিৎকে লিখতেই হত, শ্যামাসংগীতের ভাষা আর ভাব ধার করে একটি নতুন শ্যামাসংগীত। তবে আমরা লক্ষ করি, সাধারণভাবে গানের শেষে ভণিতা অংশে কবি নিজের নামটি বুনে দেন। এই গানে সেই ভণিতাটি অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিতিই চিনিয়ে দেয়, এটি আর যাই হোক প্রচলিত শ্যামাসংগীত নয়!   

ক্যাপশন: দেবী ছবিতে 'এবার তোরে চিনেছি মা' গানের দৃশ্য

 

এইবারে আসা যাক, ‘চিড়িয়াখানা’-র গানটিতে। সকলেরই মূল গল্পও পড়া আর ছবিটা তো দেখাই। তবু সূত্রের খাতিরে মনে করিয়ে দেওয়া--- এই ছবিতে গোয়েন্দা ব্যোমেকশের নতুন মক্কেল নিশানাথ সেন ব্যোমকেশের কাছে আসেন একটি সিনেমার গানের পরিচয়ের সন্ধানে। গানটির প্রথম লাইন ‘ভালোবাসার তুমি কী জানো’। আমাদের জন্য সেই গানটি পুরো নতুন করে বাঁধলেন সত্যজিৎ। মূল গল্পে তো আর সেই গানটির কথা ছিল না, ছিল কেবল অভিনেত্রী সুনয়নাকে খোঁজ করার কথা। সত্যজিৎ সেই সন্ধানে নতুন একটি মাত্রা যোগ করলেন গানের কথা বলে। এমনকি গানটির সন্ধানে বেরিয়ে ব্যোমকেশ একটি সিনেমা হলে গিয়ে পুরোনো সংগ্রহ থেকে ১৯৫৮ সালে যেন-তৈরি-হওয়া সেই সিনেমাটিও দেখলেন। দর্শকদেরও দেখানো হল। ছবির নাম ‘বিষবৃক্ষ’। এই একটি ছবিতেই ওই সুনয়না অভিনয় করেছিল কমলমণি চরিত্রে। উপন্যাসের ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ অবলম্বনে তৈরি করলেন সত্যজিৎ সেই দৃশ্য। যেন ওই দৃশ্যের চিত্ররূপেই ব্যবহার করা হয়েছিল এই গান। উপন্যাসে সূর্যমুখী তার ননদ কমলমণিকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠাল, তার মনে হচ্ছে অনুমানে, সংসারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসন্ন। বদলে যাচ্ছে সূর্যমুখীর স্বামী নগেন্দ্র। এরপরেই যেন সেই কমলমণি তার স্বামিগৃহে, স্বামী শ্রীশচন্দ্রের কাছে বলছে সূর্যমুখীর বাড়িতে যাওয়ার কথা। শ্রীশচন্দ্রের কাছে কথা সে পেড়েছে, কিন্তু শ্রীশ ভারি ব্যস্ত তার কাজ আর হিসেবপত্র নিয়ে। সেখানেই এই দৃশ্যের শুরু। ছবিতে শ্রীশচন্দ্র কমলমণিকে বলে, ‘এতো মহা মুশকিল। যেতে লিখেছে, তো এখন কাজকর্ম ফেলে যাই কী করে?’ বরের এই কথায় কমলমণি বলে, ‘আমি তাহলে খোকাকে নিয়ে যাই?’ স্ত্রীর এই কথায় একটু আশ্চর্য হয় শ্রীশ। সে বলে, ‘এই বলছ পরামর্শের দরকার, তা তুমি গিয়ে কোন কাজটা করবে শুনি?’ সত্যিই তো সেকালের রেওয়াজমতো, পারিবারিক পরামর্শ তো বাড়ির পুরুষ সদস্যই দেবে। সেদিক থেকে জামাই বিচক্ষণ শ্রীশচন্দ্রের মত জানাটাই দরকারি। কিন্তু কমলমণি স্বামীকে বলে, ‘ আহা এ তো আর টাকাপয়সার ব্যাপারে পরামর্শ নয়, এ হচ্ছে মনের ব্যাপার।’ বোঝা গেল, বিষয়আশয়-এর ব্যাপার হলে না হয়, পুরুষ সদস্যের কথার প্রশ্ন আসতে পারত--- কিন্তু সূর্যমুখী যে ডেকেছে মনের ব্যাপারে। তাই কমলমণির এই কথা। তাতেও শ্রীশচন্দ্রের বক্তব্য--- ‘ও মনের ব্যাপার? তা মনের ব্যাপারটা কি তুমি আমার চেয়ে বেশি বোঝো না কি?’ এই কথার উত্তরেই কমলমণির সুন্দর সহজ দাম্পত্যের উত্তর, ‘বুঝি বই কী?’ আর সে যে তা বেশি বোঝে, সেটা বোঝাতেই ওই গান ‘ভালোবাসার তুমি কী জানো’। 

আরও পড়ুন
বিশু-শিবু, ভিক্টর আর কেষ্টদা: সিনেমার অন্য মুখ

এখানেও আগে গানটি শুনে নেওয়া যাক, তারপরে তার কথার মজাতে যাওয়া যাবে। গানটি ছিল এই রকম---‘ভালোবাসার তুমি কী জানো?/ পায়ের ওপর পা-টি তুলে/ হিসেবের খাতা খুলে/ বসে রও আপন ভুলে/ 

আরও পড়ুন
গল্পমালার মানচিত্র

যত বলি ঢের হয়েছে, মানা না মানো?/ ওগো মশাই, ভালোবাসার তুমি কী জানো?/ দ্যাখোনি কি ফুলবাগানে/ গোলাপের কানে কানে/ অলি কয় কথা গানে/ শোনোনি কি?/ শোনোনি বকুলশাখে/ কুহু কুহু পিয়া ডাকে/ বলো সে খোঁজে কাকে/ কেন তার হল আজি উতলা প্রাণও/ ভালোবাসার তুমি কি জানো?’ 

আরও পড়ুন
একুশে ফেব্রুয়ারির সত্যজিৎ

ক্যাপশন: চিড়িয়াখানা ছবিতে 'ভালোবাসার তুমি কী জানো' গানের দৃশ্য।

 

আরও পড়ুন
শিশুসাহিত্যপাঠ আর রুকু-টিপু ও গোলাপীবাবুর গল্প

এক্কেবারে সেকেলে বাংলা ছবির গানের বাণী। যাঁদের কানে এর সুর মনে আছে, তাঁদের মনে পড়বে সেই সুর, সেই গান গাওয়ার ধরন, সেই গানের দৃশ্যায়নে সেট তৈরি, শট টেকিং, অভিনয়ের ধরন সবটাই সেকালের ছবির ধরনে। এও আরেক স্টাইলাইজড ভাষায় লেখা গান। কমলমণি তো ছবির চরিত্র হিসেবে, তবে একটি মেয়ের কণ্ঠস্বরে গান লেখা হল, ভালোবাসার তুমি কী জানো? তুমি তো সারাদিন ব্যস্ত হয়ে আছো নিজের কাজকর্ম নিয়ে, মুখ গুঁজে পড়ে আছো নিজের হিসেবপত্রের হাজার কাজ নিয়ে--- তুমি কাজের পুরুষ, তুমি আর ভালোবাসার কীই বা জানো? তোমাকে গানের কথক স্ত্রী কতভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে, ঢের হয়েছে কাজ তোমার, এবারে কাজ থেকে মাথা তোলো, তাকাও বাগানের দিকে। বাগানে গোলাপের কানে কানে অলি বা মৌমাছি কী বলছে কান পেতে শোনো, কান পেতে শোনো বকুলগাছের শাখায় কোকিল আপনমনে ডেকে চলেছে নিজের প্রিয়কে। তুমি কী জানো, কেন তার হৃদয় উতলা হল? তুমি কাজের মধ্যে ডুবে থাকা পুরুষ কি বোঝো বা শোনো সেই বিরহী কোকিলের গান? এই কথাটিকেই কী আশ্চর্য মুন্সিয়ানাতে একেবারে সেকালের ভাষায় গেঁথে দিলেন গীতিকার সত্যজিৎ। সত্যজিৎ নিজের সুর আর নিজের অলংকরণ সম্পর্কে বলেছিলেন, সুরের চলন আর অলংকরণের মেজাজ হবে লেখার বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত। কী আশ্চর্য! তাঁর এই প্রাথমিক গীতিকারসত্তাও কিন্তু ঠিক তেমনই এক সৃজন। এখানে নিজের ভাব নিজের ভাষাকে গোপন করে, আরেকটি ভাষায় আরেকটি ধরনে তিনি লিখলেন গান, তিনি দিলেন সুর। দেখা যাবে, গুগাবাবা-র গানও কিন্তু এইভাবেই কি ভাষায়, কি বলার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত গুপি চরিত্রটিরই গান। সত্যজিৎ তা লিখেছেন বটে, খাতায় কলমে তিনিই তো গীতিকার। কিন্তু এ এক নতুন গীতিকারসত্তা--- যিনি গানের কথা লেখেন ছবির চরিত্রের সংলাপ আর তার বিষয়ের দিকে মন রেখে। ঐতিহ্য থেকে তিনিও গ্রহণ করেন তাঁর গানের ভাষা আর বিষয়। কিন্তু এ ঐতিহ্যের স্বীকরণ এক নতুন ধরন। ভবিষ্যতে যখনই সত্যজিতের রচনাবলী তৈরি করা হবে, এই গানগুলির বাণীরূপ যেন সেখানে সংগৃহীত হয়। এটা মনে রাখা দরকার উত্তরকালের। 

Powered by Froala Editor