মানিক এক অন্য লেখক

লেখক তো বটেই, সত্যজিতের কলমকারির সন্ধান যাঁরা করবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, সত্যজিৎ রায় এক চমৎকার পত্রলেখকও বটে। সেই কোন ছোটোবেলায় শুরু হয়েছিল তাঁর চিঠি লেখা। মাকে তিনি লিখেছিলেন চিঠি। মাকে লিখেছিলেন, ‘মা, আমি রোজ বেড়াতে যাই। বুলাকাকা চকোলেট দিয়েছে। আজ Cracker আনবে। চুমু নাও। মানিক’। সত্যজিতের জীবনীকার পার্থ বসু, সেই চিঠির সন্ধান দিয়ে জানিয়েছিলেন, এটাই সত্যজিতের লেখা ‘প্রথম পত্ররচনা’। কুলদারঞ্জন রায়ের কন্যা মাধুরীলতা বা সত্যজিতের বুলুপিসির কাছে তখন ছিলেন ছোটো সত্যজিৎ। পিসির কাছ থেকে মাকে লেখা এই চিঠি। সত্যজিৎ নিজেও তাঁর সেই ছোট্টবেলায় লেখা একটি চিঠির নমুনা দিয়েছিলেন আত্মকথার সঙ্গের ছবিতে। চিঠিটি লেখা বারোই ডিসেম্বর ১৯২৮--- মানে সত্যজিতের তখন বয়স বছর সাতেক। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয় ‘নিনিদিকে’। অর্থাৎ, পরবর্তী কালে প্রখ্যাত শিশু- কিশোর সাহিত্যিক তথা গোয়েন্দা গণ্ডালুর স্রষ্টা আর ‘সন্দেশ’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হিসেবে সর্বজনমান্য নলিনী দাশকে। চিঠিটি লিখছেন সত্যজিৎ ভবানীপুরের বকুলবাগান রোডের বাড়ি থেকে। মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন শুধুই কিছু তথ্য। এই চিঠিতে লিখলেন, ভালো লাগা আর না-লাগার কথা। বললেন, ‘আমরা এখানে পরশু এসে পৌঁছেছি। এখানে এসে আমার একটুও মজা লাগছে না।’ প্রসঙ্গটি একটু বুঝে নিতে হবে। ‘যখন ছোটো ছিলাম’-এ সত্যজিতের বঙ্গের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে শুনিয়েছিলেন হাজারিবাগে মেজোপিসি পুণ্যলতা চক্রবর্তীদের বাড়িতে সুন্দর সময় কাটানোর কথা। সেখানেই ছিল মেজোপিসিমার মেয়ে রুবি আর নিনি--- এখানেই ছিলেন সত্যজিতের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়ো ‘বাপ-মা-হারা’ রুবি-নিনির ‘খুড়তুতো ভাই বোন কল্যাণ আর লতু’-র কথা। সত্যজিতের লেখা ওই চিঠিতে রয়েছে ‘ডলিদিদি আর কল্ল্যাণদাদাকে বোলো যে আমি আজকে ওদের চিঠি লিখতে পারলাম না।’ এই ডলিদিদি-ই ছিলেন অমিতা রায়--- লতিকা বা লতুর বোন। আর সত্যজিতের ছোটোবেলার বানানে লেখা ‘কল্ল্যাণ’ অবশ্যই ওই কল্যাণ। সত্যজিতের লেখা চিঠিগুলি এখনো নিশ্চয়ই রয়ে গিয়েছে পারিবারিক বৃত্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে--- সেগুলি সংগ্রহ করে রাখা আশু কর্তব্য।

এই সংগ্রহের কাজটি অনেকটা করেছেন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়। সত্যজিতে জীবনী লেখার উপকরণ হিসেবে এই চিঠিগুলির গুরুত্ব অনেকখানি। সন্দীপ রায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করেছেন ‘ইতি মানিক’ শীর্ষক পত্রাবলি। লেখাটির উপশিরোনাম ‘ঠাকুমাকে লেখা বাবার চিঠি’। উপশিরোনাম দেখলেই মন চঞ্চল হয়ে উঠবে তা পড়ার জন্য। সে এক অন্য সত্যজিৎ--- শান্তিনিকেতন কলাভবনের দিনগুলির নানা ঘটনা নানা প্রসঙ্গ চকিতরেখায় ধরা পড়ে আছে সেই চিঠিগুলিতে। অনেক রকম মানুষের কথা, অনেক রকম মনে হওয়ার কথা। সবে সত্যজিৎ পৌঁছেছেন শান্তিনিকেতনে কলাভবনে পড়ার জন্য। সেখান থেকে মা-কে চিঠি লিখছে ছেলে। ২৩ জুলাই ১৯৪০-এর চিঠিতে হস্টেলে বাসকারী ছাত্র সত্যজিৎ লিখছেন, ‘আমার রুমমেটের তারেই তোয়ালে শুকোতে দিয়ে দিই, পায়জামা গেঞ্জি বাইরে দিই। এখানে ধুতি শুকোতে দেবার ভয়ানক অসুবিধা। আজকাল আমি লম্বা পায়জামা পরেই ঘুরে বেড়াই--- এখানে সকলেই।’ শান্তিনিকেতনের জীবনের খুঁটিনাটি ধরা পড়ছে। কলকাতায় তৈরি পায়জামা এখানে ব্যবহার করার অসুবিধা সম্পর্কে লিখছেন তিনি, ‘তবে পায়জামাগুলো আর দু ইঞ্চি ছোটো করিয়ে নিতে পারলে ভালো হয়--- তা না হলে, পায়জামার তলায় বড্ড ধুলো লেগে যায়।’ তারপরে শান্তিনিকেতনে থাকার ব্যাপারে মাকে জানালেন, ‘এখানে একটানা বেশিদিন থাকা অসম্ভব। সারাক্ষণ আর কাঁহাতক ছবি আঁকা যায়?’ সবে এসেছেন বলেই বুঝি এ-ও মনে হচ্ছে তরুণ সত্যজিতের--- ‘এখানকার প্রায় সব ছেলেদের সঙ্গে চেনা হয়ে গেছে। বন্ধুত্ব করবার মতো একজনও নেই।’ তারপরে কী কী ধরনের কাজ করছেন তখন, তার বিস্তারিত বিবরণ--- সকলের জন্য যে-কাজ সাতদিনের মধ্যে করার জন্য দেওয়া হয়, তা কলাভবনের নতুন ছাত্র সত্যজিৎ তিন ঘণ্টায় করে দিয়েছেন বলে মাকে জানাচ্ছেন। বেশ মজার ব্যাপার হল, মাকে ছেলে জানাচ্ছে, তার খাওয়াদাওয়া নিয়ে বিশেষ অসুবিধা যে হচ্ছে না সেই খবর--- মা স্বভাবতই সেই বিষয়েই সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হবেন। এই খাদ্যতালিকার বর্ণনা সত্যজিতের ভাষায় এই রকম--- ‘এখানের খাওয়া এক-একদিন বেশ ভালোই হয়--- এক-একদিন বেশি সুবিধার হয় না।’ সকালে বিকালে প্রায় রোজই লুচি না হয় কোনো একটা মিষ্টি দেয়। যেদিন দুধ কলা থাকে, সেদিন আমার জন্য দুটো লেডি ক্যানিং রাখে। আমাকে কিছু বলতে হয় না। দুধ দুবেলাই গেলাস ভর্তি করে দেয়।’ দুপুরের খাবারে মুগের ডাল সঙ্গে ‘একদিন ছানার ডালনা, দুদিন মাংস আর একদিন ডিমের ডালনা করে।’ মাছের ব্যাপারে একটু ভিন্নমত তাঁর--- সত্যজিৎ মাছ এমনিতেই খুব ভালোবাসতেন না, তার উপর সেখানে ‘মাছটা অতি বাজে বানায়--- রুই হলে তবু খাওয়া যায়--- অন্য কিছু হলে খাই না।’ সেকালের কলাভবনে কেমন লক্ষ রাখা হত ছাত্রদের, তার একটা উদাহরণ এরপরের লাইনটি। সত্যজিৎ মাকে জানাচ্ছেন, ‘রুই ছাড়া অন্য কোনো মাছ বানালে সেদিন আমার জন্য ডিমের ওমলেট বানিয়ে রাখে।’ একেবারে ছোটোখাটো জিনিসের খুঁটিনাটিতে ভরা আন্তরিক এই চিঠি।

শম্ভু সাহার তোলা সেই ছবি

 

এই চিঠিতেই রয়েছে সত্যজিতের সেই বয়সে রেকর্ড সংগ্রহের ইচ্ছের খবর। তিনি মা-কে লিখে জানতে চাইছেন, ‘আমি যে রেকর্ড-এর লিস্টটা দিয়েছিলাম সেটা হারাওনি তো?’ এই লিস্ট ধরে তিনি বাড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বুঝি কিছু রেকর্ড। খুব চমৎকার আর তাৎপর্যপূর্ণ তার পরের লাইনটি। কারণ এর পরেই সত্যজিৎ লিখলেন, তিনি কলকাতায় গেলে নিজেই বেছে নিয়ে আসতে পারবেন সেই তালিকা ধরে পছন্দমতো রেকর্ডগুলি, ‘তা না হলে কিন্তু মঙ্কুদিকে লিস্টটা দিয়ো। ও রেকর্ডগুলো ঠিক বের করে দিতে পারবে।’ বলা বাহুল্য, উল্লিখিত এই ‘মঙ্কুদি’-ই হলেন সত্যজিতের সম্পর্কে মামাতো দিদি বিজয়া দাশ, যিনি পরে সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়। দুজনের সম্পর্কের মধ্যবর্তী সেতু ছিল বিদেশীয় সংগীত--- দিনের পর দিন দুজনে শুনতেন বিদেশীয় সংগীতের রেকর্ড। সত্যজিৎ জানেন, তাঁর পছন্দের রেকর্ডগুলি তিনি না থাকলে, সবচেয়ে ভালো কে খুঁজে পেতে পারেন।

আরও পড়ুন
গুগাবাবা চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!

এই তেইশে জুলাই ১৯৪০-এ লেখা চিঠিতে উল্লিখিত আরেকটি বিষয়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই চিঠিতে বলা হল, সুকুমার রায়ের লেখা ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ গল্পটি সত্যজিৎ এই সময়ে ১৩২৮-২৯-এর ‘সন্দেশ’-এর পাতা থেকে দিয়েছেন এম সি সরকারের তৎকালীন কর্ণধার সুধীরচন্দ্র সরকারকে। সত্যজিৎ মনে করেছেন, ‘ওটাতে কিন্তু ওরিজিন্যাল ছবি থাকা অ্যাবসোলিউটলি এসেনশিয়াল’। এই শেষের ‘অ্যাবসোলিউটলি এসেনশিয়াল’ শব্দ দুটির জোর বোঝাতে আবার নিম্নরেখাঙ্কিত। অর্থাৎ, এই সময়েই এম সি সরকার থেকে সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’ বই প্রকাশের উদ্যোগ চলছে। কোত্থাও উল্লিখিত না থাকলেও এই বইটির প্রস্তুতিতে যে পুত্র সত্যজিতের একটা সম্পাদকীয় ভূমিকা ছিল, সেটা স্পষ্ট এখানে। মনে রাখা দরকার, সুকুমারের জীবৎকালে পরিকল্পিত বই একমাত্র ‘আবোল তাবোল’, যদিও তার প্রকাশিতরূপ তিনি দেখে যেতে পারেননি। সুকুমারের লেখা বই হিসেবে সমধিক পরিচিত ‘পাগলা দাশু’ বা ‘খাই খাই’ বা ‘বহুরূপী’ বা তাঁর লেখা নাট্যসংকলন তৈরি--- সবটাই কিন্তু সত্যজিতের অবদান। দ্বিতীয়ত, এই ‘পাগলা দাশু’ বইয়ের জন্যই সত্যজিৎ প্রথম প্রচ্ছদ অঙ্কন করবেন। আর মা-কে লেখা ১৩ অগস্ট ১৯৪০-এ লেখা অন্য একটি চিঠিতে সত্যজিৎ জানতে চাইলেন এই বইয়ের প্রচ্ছদ কেমন ছাপা হয়ে এলো, তার সমাচার। লিখলেন, ‘‘পাগলা দাশু’-র দাম কত হবে ঠিক হয়েছে? বইটা সবসুদ্ধ কত পাতা হল? মলাটটা ছেপে এসেছে না কি? কী রকম ছাপল আমার বড়ো দেখতে ইচ্ছা করছে।’ নিজের আঁকা প্রথম প্রচ্ছদ ছাপার পর কেমন দেখতে হল, সেটা জানার আগ্রহও আছে, অথচ সেই ইচ্ছাপ্রকাশের ভাষাতেও কত নিয়ন্ত্রিত আবেগ--- সত্যজিতের স্বভাববৈশিষ্ট্য বোঝার জন্যেও এ এক সুন্দর উদাহরণ।

আরও পড়ুন
গুগাবাবা: চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!

মা সুপ্রভার কোলে শিশু সত্যজিৎ

 

আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব-২

আরো কত কৌতূহলপ্রদ তথ্যসূত্রের আধার এই চিঠিগুলি। যেমন, কোনো প্রদর্শনীতে সত্যজিতের আঁকা ছবি বুঝি বা এই প্রথম প্রদর্শিত হল। কলাভবনের ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর উদ্বোধন হল ২৯ অগস্ট ১৯৪০। ত্রিশ তারিখ সত্যজিৎ জানালেন সেই তথ্য। তবে এখানে সত্যজিৎ নিজের আঁকা ওরিজিনাল ছবিটি দিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না--- যদিও শেষে আর সময় না থাকায় সেটাই প্রদর্শনীতে দিতে হয়েছিল, এমন তথ্যও রয়ে গেছে এই চিঠির বয়ানে। এই চিঠির বয়ানেই জানা যায় অবসর সময়ে কুড়ি বছর বয়সী সত্যজিতের বিকেলে অবসর কাটানোর জন্য ব্যাডম্নিটন খেলার কথা, সত্যজিতের কলকাতায় গিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখে ফেরার কথা, শান্তিনিকেতনে সাঁওতাল নাচ দেখে তাঁর দ্রুত সেই স্কেচ করার খবর থেকে সেখানে ছউ নাচ দেখে তা তাঁর বিশেষ ভালো না-লাগার খবর। এক জায়গাতে মা-কে লিখছেন, ‘আমার ভায়োলি শিখবার কোনো ইচ্ছে নেই। যদি কখনো কোনো ইমস্ট্রুমেন্ট শিখি তাহলে পিয়ানো শিখব।’  

আরও পড়ুন
না-হওয়া ছবির প্রস্তুতিপর্ব

খুব ইন্টারেস্টিং তথ্য ‘ দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রথম দুটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল সেটা আমাদের অনেকেরই জানা, কিন্তু সেই লেখা বাবদ সেখান থেকে যে সাম্মানিকও পেয়েছিলেন তিনি--- সেই খবরটি এখানে লিপিবদ্ধ। সম্ভবত এটিই তাঁর লিখে প্রথম উপার্জন, যে-সত্যজিৎ পরে আনন্দ পাবলিশার্সের কর্ণধার বাদল বসুকে বলেছিলেন, লিখে আর লেখার টাকাতেই নাকি চলে তাঁর সংসার-খরচ, সেই সত্যজিতের জীবনে লিখে প্রথম টাকা পাওয়ার তারিখটি ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০। আরেকটি তথ্য পাওয়া যায় এই চিঠির সূত্রে। সত্যজিতের সেই সময়ের একটি বিখ্যাত ছবি ছিল শম্ভু সাহার তোলা। ছবিটি বহুল পরিচিত। এই ছবিটি তোলার এক্কেবাকে নির্দিষ্ট তারিখটি কবে, সেই খবরও রয়েছে এখানে। ১৮ জুন ১৯৪১-এ লেখা একটি চিঠিতে সত্যজিৎ মা-কে লিখেছেন, ‘কাল শম্ভু সাহা এসেছিল। আমার একটা ছবি তুলেছে। তাছাড়া আমরা কয়েকজন মিলে একটা ইনফর্মাল গ্রুপও তুলিয়েছি।’ বোঝা যাচ্ছে, সেই ছবিটি তোলা হয় ১৭ জুন ১৯৪১-এ।

মা আর ছেলে: সুপ্রভা আর সত্যজিৎ

 

এই চিঠির কলমকারির হরেক বড়ো খবর আর ব্যক্তিগত খবরের সন্ধান চলতে থাকবে। খুব দরকার মা-কে লেখা সত্যজিতের চিঠিগুলির সটীক মুদ্রণ গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ। পরের কিস্তিতে আবারো একবার আরো কিছু কথা নিয়ে আড্ডায় বসা যাবে ’খন।

Powered by Froala Editor