সত্যজিতের সংলাপ-ভাবনা

১৯৬৩ সালে লেখা একটি ছোট্ট প্রবন্ধ। বইতে মাত্র দু-পাতা এই পর্বন্ধের পরিসর। লেখাটির নাম ‘চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে’। প্রকাশিত হয়েছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য়। সত্যজিৎ রায় সরাসরি আলোচনা করেছিলেন সিনেমার সংলাপ লেখা নিয়ে তাঁর কিছু ভাবনার কথা। একেবারে একটি ক্লাস-লেকচারের মতো যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন সিনেমার সংলাপ কীভাবে লিখতে হবে, সেই কথাগুলি। বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রের সংলাপ আর কল্পনাশ্রয়ী বিভিন্ন কার্টুন ছবি, রূপকথাধর্মী ছবি বা গীতিনাট্যমূলক ছবির সংলাপ থেকে কীভাবে আলাদা হবে বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রের সংলাপ, চলচ্চিত্রে সংলাপের কাজটি ঠিক কী আর কতটুকু, কোন বিষয়ে ছবির সংলাপ আর পাঁচজন ব্যবহার করলেও, বস্তুত তা নিষ্প্রয়োজন--- সেই আলোচনার পাশপাশি বলেছিলেন আরো কিছু কথা। বলেছিলেন চটকদারি সংলাপ বা অলংকৃত বাক্য কেন পরিহারযোগ্য সিনেমার সংলাপ থেকে চরিত্র অনুসারে যেমন বদলে যেতে বাধ্য একটি ছবির সংলাপ তেমনই একই চরিত্র বিভিন্ন শারীরিক আর মানসিক অবস্থায় একই সংলাপ বিভিন্ন ভাব বলতে পারে--- সেই কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর একেবারে শেষে বলেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা--- সত্যজিতের মনে হয়েছিল, এই এমন একজন বাংলা কথাসাহিত্যিক, যাঁর লেখা সংলাপকে চাইলে ভবিষ্যতের সংলাপ-রচয়িতা একটি আদর্শ ভেবে এগোতে পারেন। সত্যজিৎ বিভূতিভূষণ প্রসঙ্গে বললেন, ‘চিত্রনাট্যের সংলাপ রচনার এত বড়ো গুরু আর একউ নেই।’ সত্যজিতের গোটা প্রবন্ধটি এমনিতে অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক তাঁর কথা বলা ভঙ্গি, যেন কথার পৃষ্ঠে বলে চলেছেন কথা। কিন্তু এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটি যেন, আগেই বললাম, একেবারে সংলাপ বিষয়ে কিছু বলার একটা ছোটোখাটো ক্লাস যেন। 

কথাটি শুরু করেন তিনি একটি ছোটো প্রসঙ্গ থেকে। বলে দেন, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রে যে ধরনের সংলাপ ব্যবহার করা হবে, বিভিন্ন অন্য রকম কার্টুনধর্মী ছবি, পৌরাণিক ছবি বা গীতিনাট্যমূলক ছবির সংলাপের ধরন তার থেকে আলাদা। একটি ছবির সংলাপের ভাষা যে সিনেমার ধরন বদলালে বদলাতে পারে, একই সংলাপ রচয়িতার সংলাপের ভাষা যে ছবির সংরূপভেদে বিভিন্ন হতে বাধ্য, সেই কথাটি দিয়েই সূচিত তাঁর এই নিবন্ধ। সত্যজিতের ছবির মানচিত্রেই লক্ষ করা যায় যদি, দেখা যাবে, তাই ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর শুরুতেই যে গুপি তাদের গ্রামের এক চাষিকে নিজের হাতের তানপুরা তুলে বলে, ‘তুমি চাষা, আমি ওস্তাদ খাসা’। সংলাপের এই বাক্যের ধরন এই ছবিরই উপযুক্ত। সত্যজিৎ মনে করিয়ে দেন, সাধারণভাবে বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রে যে ধরনের সংলাপ বলা হয়ে থাকে, এই নিবন্ধে তিনি সেই সংলাপের কথাই বলতে চাইছেন। 

পরিষ্কার করে তার পরেই বুঝিয়ে দিলেন, সংলাপের কাজ ঠিক কী কী? বললেন, ‘এক, কাহিনিকে ব্যক্ত করা। দুই, পাত্র-পাত্রীর চরিত্র প্রকাশ করা।’ এই সূত্রে প্রথমেই আলাদা করে দিলেন, সাহিত্যের কথা আর শব্দের থেকে সিনেমার কথা আর শব্দ কোথায় কোথায় আলাদা। খুব দরকারি বিষয় ‘কথা’ আর ‘শব্দ’। সাহিত্যে কথা আর শব্দের তুলনায় সিনেমায় কথা আর শব্দ ভিন্ন অর্থবাহী। কারণ, ছবিতে ‘শব্দ’ মানে শুধুই কথা নয়, সেখানে শব্দ মানে ধ্বনি বা সাউন্ডও। একটি টেবিল ঠেলার শব্দ থেকে কোনো কিছু ছুড়ে ফেলার শব্দও এখানে শব্দ আর আবহসংগীতের শব্দও সেখানে শব্দ আর সংলাপে বলা কথাগুলিও সেখানে শব্দ। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ‘সাহিত্যের কাহিনিতে কথা যে কাজ করে, চলচ্চিত্রে ছবি ও কথা মিলিয়ে সে-কাজ করা হয়।’ ব্যাপারটা কী রকম? স্পষ্টত উল্লেখ করলেন, সাহিত্যে পরিবেশ বর্ণনা থেকে একটি মানুষের আকৃতি-প্রকৃতির বর্ণনাও কিন্তু পাঠকের কাছে উপস্থিত করে শব্দ আর বাক্য। এমনকি একটি মানুষের প্রকৃতি কেমন, সেটাও কিন্তু পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করেন একজন কথাকার তাঁর লেখা বাক্য দিয়েই। ছবিতে এই বিষয়গুলি অনেকটাই ছবির হাতে ছেড়ে দিতে হয়--- বা ছবির হাতে ছেড়ে দিলেই ভালো। একটি পরিবেশের প্রকৃতি কেমন, তা মনোরম, নাকি ভয়াবহ, নাকি সেই পরিবেশে শান্তি আছে বা দুর্গমতা--- সবটাই কিন্তু ছবিই উপস্থাপিত করবে দর্শকের সামনে। সেখানে চরিত্রের সংলাপে তা বলতে যাওয়া বাহুল্য। বরং সেটা কোনো চরিত্রের মুখে বসালে তা প্রায় ছেলেমানুষি মনে হতে বাধ্য। আবার একটি চরিত্রকে কেমন দেখতে, তার পোশাক-আশাক কেমন, তাকে দেখে ঠিক কী মনে হচ্ছে, সেই কথাও কিন্তু একজন কথাসাহিত্যিকের কাজ পাঠকের কাছে বাক্য দিয়ে হাজির করতেই হবে। কিন্তু একজন সিনেমার কারিগর সেই বিষয়গুলি হাজির করেন তাঁর চরিত্রানুযায়ী অভিনেতা দিয়ে, সেই অভিনেতার মুখ হাত পা-এর গড়ন আর তার রূপসজ্জা আর সাজসজ্জা--- মানে মেক-আপ আর কস্টিউম দিয়েই বুঝিয়ে দেন দর্শককে। সেখানেও ছবি করিয়ের জন্য বাড়তি বাক্যব্যয়ের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি, একটি চরিত্রের প্রকৃতিও অনেকটা তার আঙ্গিক অভিনয় দিয়েই প্রকাশ করা চলে, সেখানে অনেক সময়ে বাক্য বাড়তি কিছু যোগ করলে, তা ব্যবহার করা যেতে পারে, নচেৎ সত্যজিতের মতে, তার দরকার নেই। সত্যজিৎ একেবারে, শিক্ষকোচিত ধরনে, নতুন লেখককে তা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘নতুন চিত্রনাট্যকার সব সময় এ কথাটি  মনে রাখেন না, তাই তাঁর কাজে প্রায়ই অতিকথনের দোষ লক্ষ করা যায়। সংলাপের মাত্রা নির্ণয় করা রীতিমতো কঠিন কাজ। এই মাত্রাবোধ একবার আয়ত্ত হলে চিত্রনাট্য রচনার পথ অনেকটা সহজ হয়ে যায়।’ 

আরও পড়ুন
এক চিত্রনাট্যের ‘খসড়া’-বৃত্তান্ত!

মাত্রাবোধের প্রসঙ্গেই তিনি দিলেন, সিনেমাতে চটকদারি সংলাপ লেখার প্রবণতা থেকে দূরে থাকার চেতাবনি। বললেন, ‘এ ধরনের সংলাপ ছবির চেয়ে নাটকেই মানায় বেশি।’ বাক্যটি, যাঁরা নাটক-অন্ত-প্রাণ, তাঁদের আপাতত পীড়া দেবে, তাঁরা ভুল বুঝতেও পারেন। কথাটা যথার্থ তাৎপর্যে অনুধাবনীয়। কারণ, ঠিক এর পরের বাক্যেই বললেন, ‘নাটকে কথাই সব, ছবিতে তা নয়।’ এই বাক্যটিও এখন অনেকটাই হয়ত ঠিক নয়। সেখানেও দৃশ্য-রচনা আর এক-একটি চরিত্রের আঙ্গিক-অভিনয়, মঞ্চে তাদের পারস্পরিক অবস্থান দিয়ে যে দৃশ্যকল্প তৈরি হয়, সেখানেও সাজসজ্জা-রূপসজ্জা-মঞ্চসজ্জার তো নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তবুও এইসব বিষয় স্মৃতিতে রেখেও সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, নাটকের মধ্যে দর্শক-শ্রোতা যে-বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেন, তার মধ্যে অবশ্যই তাঁর একটি নিজস্ব অংশগ্রহণ আছে, নিজস্ব আলাদা বাস্তবতাকে মেনে-নেওয়ার পূর্বশর্ত আছে। অন্যদিকে ছবিতে তো তা নয়--- ফলে, এই দুই সংরূপের সংলাপ রচনার প্রকৃতি যে স্বতন্ত্র, সেটাও মনে রাখা দরকার একজন সংলাপ লেখকের। 

আরও পড়ুন
এক অন্য সত্যজিতের কথা

পটলবাবু ফিল্মস্টার গল্পের অলংকরণ। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়।

 

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর অন্য ভূতের

সংলাপের স্বাভাবিকতার সঙ্গেই যুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়। চারপাশের স্বাভাবিকতার সঙ্গে ওতপ্রোত অভিনেতার এই সংলাপ বলার অভ্যাস। অভিনেতার উপযোগী সংলাপ তৈরি করাও একজন ভালো সংলাপ-রচয়িতার কাজ। তার সঙ্গে মনে করিয়ে দিলেন, ‘একই কথা অলসমুহূর্তে একভাবে, কর্মরত অবস্থায় আরেকভাবে, এমনকি গ্রীষ্মে ঘর্মাক্ত অবস্থায় একভাবে এবং শীতে কম্পমান অবস্থায় আরেকভাবে ব্যক্ত হয়। নিরুদ্বিগ্ন অবস্থায় মানুষের কথার লয় বিলম্বিত, উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের কথা কেটে যায়, বাক্য উত্থিত হয় নিশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে।’ বাপরে বাপ! কী মোক্ষম এক-একটা ধরিয়ে দেওয়া! লক্ষ করুন, ১৯৬৩-তে লিখছেন এই প্রবন্ধ সংলাপ-রচয়িতার জন্য, আর ঠিক সেই সময়েই অভিনেতার দিক থেকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখলেন ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পটি। ১৯৬৩-র পুজো সংখ্যার আনন্দবাজারে এই প্রবন্ধের প্রকাশ আর তার ঠিক আগের মাসে শ্রাবণ ১৩৭০ বা জুলাই-অগস্ট ১৯৬৩-তে সন্দেশ-এ বেরিয়েছিল ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্প। সেখানে পটলবাবু সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে মাত্র একটি শব্দের সংলাপ দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন--- আর ক্রমশ তিনি উন্মোচন করলেন এক ভিন্ন সত্য। সেখানে গল্পকার সত্যজিৎ লিখছেন, ‘চিমটি খেলে মানুষে যেভাবে আঃ বলে, গরমে ঠান্ডা শরবত খেয়ে মোটেই সেভাবে আঃ বলে না। এ দুটো আঃ একেবারে আলাদা রকমের, আবার আচমকা কানে সুড়সুড়ি খেলে বেরোয় আরও আরেক রকম আঃ। এছাড়া আরো কতরকম আঃ রয়েছে--- দীর্ঘশ্বাসের আঃ, তাচ্ছিল্যের আঃ, অভিমানের আঃ, ছোটো করে বলা আঃ, লম্বা আঃ, লম্বা করে বলা আঃ, চেঁচিয়ে বলা আঃ, মৃদুস্বরে আঃ, চড়া গলায় আঃ, খাদে গলায় আঃ, আবার আ-টাকে খাদে শুরু করে বিসর্গটায় সুর চড়িয়ে আঃ--- আশ্চর্য!’ তারপরে লিখলেন এক চমৎকার বাক্য, ‘পটলবাবুর মনে হয় তিনি যেন ওই একটি কথা নিয়ে একটা আস্ত অভিধান লিখে ফেলতে পারেন।’ 

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর তামাম-জীবন ১

তাহলে একটি মানুষ যেমন বিভিন্ন অবস্থায় একই কথা নানাভাবে বলে, তেমনই শ্রেণিগত পার্থক্যে, লিঙ্গগত পার্থক্যে, মানসিকতার পার্থক্যেও তো সংলাপের বিভিন্নতা তৈরি হবেই। সত্যজিৎ সংলাপ লেখকের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়ে দুটি কথা বললেন এইবারে। প্রথমত, ‘চিত্রনাট্যকার তাঁর নিজস্ব সত্তাকে সম্পূর্ণ বিলীন করে, তাঁর চরিত্রের অন্তরে প্রবেশ করে সেই চরিত্রের সত্তাটিকে সংলাপের দ্বারা ফুটিয়ে তুলবেন।’ লক্ষণীয়, তখনো বা সত্যজিতের নিজের ক্ষেত্রেও, চিত্রনাট্যকার আর সংলাপ-রচয়িতা তো অভিন্ন--- তাই তিনি এখানে চিত্রনাট্যকার কথাটি ব্যবহার করেছেন। এখন, হয়ত আরো নির্দিষ্ট করে বললে, লেখা দরকার ‘সংলাপ-লেখক তাঁর নিজস্ব সত্তাকে সম্পূর্ণ বিলীন করে’ প্রবেশ করবেন চরিত্রের অন্তরে। দ্বিতীয় পরামর্শটি হল, ‘চলচ্চিত্রে সময়ের দাম বড়ো বেশি। যত অল্প কথায় যত বেশি বলা যায়, ততই ভাবলো, আর কথার পরিবর্তে যদি ইঙ্গিত ব্যবহার করা যায়, তবে তো কথাই নেই।’ এই কথাটির ইদানীং এক অপপ্রয়োগের দিকও লক্ষ করা যায় অবশ্য। অনেক সময়েই সংলাপ-রচনার অক্ষমতা অনেক ছবিকে এমনই কেবল চিত্রসর্বস্ব করে তুলছে, যা তা হয়ে উঠছে এক বিকট খাপছাড়া। তাঁরা অনেকেই সত্যজিতের এই কথাটিকে আউড়ে সংলাপ-হ্রস্বতার কথা বলতেই পারেন, তবে মনে রাখতে হবে, সত্যজিৎ ‘যত অল্প কথা’-র ব্যবহার যেমন বলেছেন, তেমনই ‘যত বেশি বলা যায়’ কথাটাও বলেছেন। আসল লক্ষ্য ওই সত্যিকারের বেশি বলা-র দ্যোতনা তৈরি করা। সেটা না হলে যে, সব আয়োজনই বৃথা! 

Powered by Froala Editor