একটি দৃশ্য কয়েকটি সংলাপ

খুব চেনা ছবির চেনা একটা দৃশ্য। ‘মুকুল ধর কি জাতিস্মর’--- খবরটা করতে এসেছেন এক সাংবাদিক। তাঁর সঙ্গে আছেন এক চিত্রগ্রাহক। তিনি তুলে চলেছেন ছবি। সাংবাদিকের সামনে উপস্থিত বালক মুকুল, পাশে বসে আছেন তার বাবা, সুধীর ধর। দরজায় উৎকণ্ঠিত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন ছেলের মা। আর বলার দরকার নেই। এতক্ষণে সক্কলেই বুঝতে পেরেছেন, ছবির নাম ‘সোনার কেল্লা’। এই একটি দৃশ্য আর সেই ছবির সংলাপ নিয়ে দুই-এক কথা বলার জন্যই আজকের কিস্তি। এমনিতে কথাবার্তা ভারি সাদামাটা। কিছু প্রশ্ন, কিছু ছোটো উত্তর। আর পাশাপাশি কিছু কিছু আশপাশের কথা। সক্কলের মনে আছে, এই দৃশ্যের সেই বিখ্যাত সংলাপ। চিত্রগ্রাহক সাংবাদিক ক্যামেরা হাতে নিয়ে বললেন, একটু হাসো তো খোকা। সেই বালক তখনো গম্ভীর। ফলে, আবার সেই চিত্রগ্রাহক বললেন, হাসো। শান্ত গলায় ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’ তার উত্তর খুব সহজ। চিত্রগ্রাহক বললেন, ‘হাসলে ছবি ভালো ওঠে।’ তারপরেই সেই বালকের সেই বিখ্যাত উত্তর, যা প্রতিটি বাঙালির মনের ভেতর বসে গেছে। বালকটি বলে, ‘আমার হাসি পাচ্ছে না।’ এই দৃশ্যটির আগের কথাগুলো কী ছিল, সেটা নিয়ে একটু কথা বলে নেওয়া যাক। দেখা যাক, আগের কথাগুলি এই ছবির জন্য কতখানি দরকারি ছিল।

মজা হল, এই দৃশ্যটির কথা বলার জন্য আমাদের কাছে দুটো উপকরণ আছে। এক তো ‘সোনার কেল্লা’ ছবির দৃশ্যটিই আর দ্বিতীয়ত, সত্যজিৎ রায়ের নিজের হাতে লেখা এই দৃশ্যের সংলাপ--- যেটা তিনি মুকুল চরিত্রের অভিনেতা কুশল চক্রবর্তীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। কুশলকে নিজের হাতে লেখা সত্যজিতের সেই পাতাগুলি পাওয়া যাবে, কুশল চক্রবর্তীর বাবা রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর লেখা ‘সোনার কেল্লার সন্ধানে’ বইতে। তার সঙ্গে আমরা চোখ রাখব, সত্যজিতের সেই বিখ্যাত লাল খেরোর খাতায় লেখা এই অংশের পাতাগুলিতে। খেরোর খাতায় সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘‘শ্রীমান মুকুলের পূর্বস্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক রাজস্থানে তার নিজের বাড়িতে গুপ্তধনের ইঙ্গিত।’’ ঠিক। এটাই তো মূল উদ্দেশ্য ওই দৃশ্যের। শিশু মুকুলের কাছে ছিল একটা পূর্বস্মৃতির প্রসঙ্গ, তাকে কলকাতার গরম-খবর করতে-চাওয়া সাংবাদিক করে তুললেন গুপ্তধনের গল্প। সেটাকেই তো সহজভাবে গড়িয়ে যাওয়া সংলাপে তুলে আনতে হবে ছবিতে। সঙ্গে আরো কিছু দরকারি কথাসূত্র গেঁথে দেওয়া হল এখানে। কথাগুলির পরম্পরা বোঝা যাক।

ক্যাপশন: সোনার কেল্লা নিয়ে কুশল চক্রবর্তীর বাবা রুদ্রপ্রসাদের বই ও সেখানে সত্যজিতের হাতে লেখা চিত্রনাট্যের পাতা।

 

ছবিতে ওই সাংবাদিকের নাম জানা যায় না। চিত্রনাট্যে সেই সাংবাদিকের নাম নরেশবাবু। খেরোর খাতায় ছিল নরেশ গুপ্ত। তাঁর প্রথম প্রশ্ন মুকুলের বাবা সুধীরের কাছে, ‘কবে থেকে লক্ষ করলেন ওর এই ব্যাপারটা?’ এই একটি প্রশ্নেই অনেকখানি ঘটনা বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। ঠিক তার আগে নাম দেখানো হয়েছে। আর তার আগে দেখেছি, মাঝরাত্রে ঘুম থেকে উঠে ছবি আঁকছে মুকুল। ওই একটি প্রশ্নেই স্পষ্ট মাঝখানে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। সুধীর জানালেন, ‘এই মাস দু-তিন’। তারপরের প্রশ্ন, ‘কোনো বিশেষ সময়ে কি ওর এই ইয়েটা প্রকাশ পায়?’ তার উত্তরে সুধীর জানায়, বিশেষ সময়ে না, ছেলে অন্যমনস্ক প্রায় সবসময় থাকে। তার সেই ছবিগুলোর কথা জিজ্ঞাসা করলে বলে, ও যেখানে ছিল এগুলি সেখানে সে দেখেছে। সে জানায়, ‘আমি তো ওখানে ছিলাম।’ কবে ছিল মনে নেই--- তবে সেখানে ও ছিল। তার ছবি দেখে অনুমান করা চলে তার স্মৃতির সময়। সে বেশ রাজারাজড়ার সময়। সেই সময়টিও পরে গল্পের মধ্যে নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। সে কথায় পরে আসা যাবে। এখন সেই রাজাগজার সময়, পূর্বজন্মে মুকুল তির ধনুক তলোয়ার দেখেছে, সে যুদ্ধ দেখেছে। সাংবাদিকের কৌতূহল অন্য জায়গাতে। সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি নিজে যুদ্ধ করতে?’ এর একটা অসামান্য উত্তর দেয় মুকুল। ছবির জন্য সহজ, কিন্তু গভীর তাৎপর্য তার, সেই সংলাপ যেন গুগাবাবা-র গানের ‘তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’ গানের উত্তরসূরি। মুকুল বলে, ‘আমি তো ছোটো ছিলাম’। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলে ছোটোরা, যুদ্ধের পোশাক পরে থাকতে ভালোবাসে তারা, কিন্তু যুদ্ধ করে ‘বড়োরা’। সাংবাদিকের সন্ধানী মনের প্রশ্ন, ‘আর যখন বড়ো হলে?’ এর উত্তরটিও অসামান্য। মুকুল বলে, ‘আমি তো বড়ো হইনি’। সাংবাদিক নরেশবাবুর প্রশ্ন এরপরে, ‘তোমার বাবা কী ছিলেন? রাজা?’ এখানেই আমাদের মনের মানচিত্রের গোলমাল, আমাদের কাছে রাজস্থান মানেই রাজা আর রানি। সেখানেও যে ছিল সাধারণ মানুষ, তাদের গল্প তো ভুলেই যাই আমরা। মুকুল জানায়, ‘রাজা তো আরেকজন ছিল?’ সাংবাদিকের প্রশ্ন ‘আর তোমার বাবা?’ ঠিক এই সময়েই নরেশের হাতের একটি পাথর-বসানো আংটির দিকে চোখ যায় মুকুলের। সে বলে, তার হাতে আংটি ছিল। রাজস্থান আর একটি বাচ্চার হাতে আংটি। সাংবাদিকের কৌতূহল তাকে নিয়ে যায় তার পরের প্রশ্নের দিকে। কী ধরনের পাথর? কী ধরনের পাথরের আংটি, সেই পাথর ঝলমল করত কি না? এইসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে চলে সাংবাদিক। সাংবাদিক খুঁজছে একটা গল্প। শুধু আগের জন্মের কথা বললে তো আর গল্প জমবে না, স্টোরি তৈরি করতে হলে চাই আরো উপাদান। সেই উপাদানের খোঁজ করতে বসলেন সেই সাংবাদিক।

আরও পড়ুন
শতবার্ষিকী স্মরণে : প্রোফেসর এইচ- বি- বি- ২

দরজাতে উদ্বিগ্ন মুকুলের মায়ের মুখ।

 

আরও পড়ুন
শতবার্ষিক স্মরণে প্রোফেসর এইচ বি বি- পর্ব ১

তিনি ভেবে বসলেন, একটা বাচ্চার হাতে ঝলমলে পাথর বসানো আংটি ছিল মানে, তারা নিশ্চয়ই বড়োলোক ছিল। সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা বড়োলোক ছিলে? খুব বড়ো বাড়ি ছিল তোমাদের?’ কিন্তু মুকুল জানায়, তাদের ছোটো বাড়ি ছিল। সেই ছোটো বাড়ির গল্প তো শুনতে চায় না সাংবাদিক। তার বরং আগ্রহ ওই ঝলমলে পাথর নিয়ে। তার গালগল্প-বানাবার মন জিজ্ঞাসা করে বসে, ‘পাথর কোথায় ছিল? সিন্দুকের ভিতর? নাকি মাটির নীচে পোঁতা ছিল?’ গুপ্তধনের গল্প-পড়া কলকাতার সাংবাদিক জানে বাড়িতে দামি পাথর মানেই গুপ্তধন--- আর তাকে লুকিয়ে রাখতে হয় কোনো দুর্গম জায়গায়, সকলের অলক্ষ্যে। সেই মন থেকেই তার এই প্রশ্ন। এই কথাটি মনে পড়ে না মুকুলের। আমরা আসলে, গল্প দেখতে দেখতে মুকুলের মনটা পড়ি না, আমরাও তো আছি ওই সাংবাদিকের পক্ষেই। আমাদের মনও তো গপ্পো খুঁজছে। সুধীর ধর বলেন, সব কথা তো আর মনে নেই ওর। যখন যেমন মনে পড়ে, তেমন বলছে মুকুল। কিন্তু মুকুলের মনে তখন কী হচ্ছিল? সে তার শৈশবে দেখে এসেছে, ওই ঝলমলানি পাথর ঘরে ছড়ানোই থাকে। তার পূর্বজন্মের বাবা যেহেতু মণিকার ছিলেন, তাই তাদের বাড়িতে ওইসব মহামূল্যবান পাথর সংগ্রহ আর জমানোর জিনিস নয়, তাদের কাছে তা কাজের উপাদান। সে সহজেই দেখেছে তা। এই দেখাটা মুকুলের গল্প, সাংবাদিক বা বলা ভালো আমাদের দেখাও নয়। তার মানে, গল্পের প্রথমেই মুকুলের গল্পটা আমরা বুঝতে পারতাম। মুকুল সবটাই ঠিক-ঠিকই বলেছে। আমরা শুনতে চাইনি বলেই বুঝতে পারিনি। আমরা আমাদের গল্প শুনতে চাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে অন্যের কথা শুনেছি বলেই, তাদের কথাটা আর শোনা হয় না আমাদের। ‘সোনার কেল্লা’-র এই অংশের সংলাপ যেন সে কথাটাও বলে যায়। রাজস্থানের গল্প মানে যে রাজা-রানির বাইরে আম-আদমিরও গল্প--- সেটা শুনতে চাই কই আমরা?  

আরও পড়ুন
পিতামহ তর্পণ-২

সাংবাদিক নরেশ গুপ্ত আর চিত্রগ্রাহক সোনার কেল্লা ছবিতে

 

আরও পড়ুন
পিতামহ-তর্পণ: ১

এবারে আরেকটি কথা, সেই চিত্রসাংবাদিকের কথার উত্তরে মুকুলের বলা আমার হাসি পাচ্ছে না সংলাপের কথায় আসা যাক। সংলাপ হিসেবে এটা যেমন অসামান্য, তেমনই ছবিতেও তার ব্যবহার দারুণ!! এক তো বড়োদের ভাবনায় আছে, হাসলে ছবি ভালো ওঠে। এই ছবি তোলার জন্য হাসতে হয়, এটা একটা বড়োদের ভাবনা--- সেটা কখনোই ছোটোদের ভাবনা হতে পারে না। আর ছবির প্রথমে মুকুল বলে, তার হাসি পাচ্ছে না। ছবির মাঝখানে তোপসেও মুকুলকে লক্ষ করে ফেলুদাকে বলে, মুকুল কী গম্ভীর রে বাবা! আর ছবির শেষে, মুকুল তার বর্তমানে ফেরে কেল্লার ওপর থেকে প্রাণখোলা হাসি হেসে। তার গম্ভীর মুখ তার আগের জন্মের দেহভাষা আর তার এই হাসি এই জন্মের গল্প।

সোনার কেল্লার চিত্রনাট্যে মুকুলের সংলাপে একটি বাক্য ছিল, ‘আমাদের বাড়ি থেকে কেল্লা দেখা যেত। সোনার কেল্লা।’ সেই কেল্লার কথায় কান না দিয়ে সাংবাদিক নরেশবাবু জানতে চায়, ‘পাথর কোথায় ছিল? সিন্দুকের ভিতর? নাকি মাটির নীচে পোঁতা ছিল?’ গোটা একটা কেল্লা যে সোনার--- সেটা নজরে পড়ে না সাংবাদিকের, তার মন পড়ে আছে সেই এক গুপ্তধনের গপ্পোতে। এমন সুন্দর আর লোভনীয় একটি সংলাপ, লিখেছেন, কিন্তু ছবিতে আর মুকুলকে দিয়ে বলাননি সত্যজিৎ। সংলাপটি পাওয়া যাবে, কুশল চক্রবর্তীকে দেওয়া স্ক্রিপ্টের পাতায়। কিন্তু সংলাপটি বাদ দিলেন কেন? চট করে মনে পড়ে যাবে, কেল্লার গঠন। মুকুলের বাড়ি ছিল কেল্লার ভেতরে--- সেটাই তো সোনার কেল্লার ভেতরে, তাহলে সেখান থেকে কী করে আর কেল্লা দেখা যাবে! তবে, সাংবাদিকের ওই লক্ষ-না-করার ব্যাপারটা রাখলেন সত্যজিৎ অন্য ভাবে।

নরেশ জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি যাবে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে--- রাজস্থানে?’ তার উত্তরে মুকুল জানায়, ‘আমি সোনার কেল্লা দেখব। ডাক্তারজেঠু দেখাবে।’ তাহলে, সোনার কেল্লার কথা তো শুনেছিল সাংবাদিক নরেশ গুপ্ত--- কিন্তু ওই সোনায় মোড়া কেল্লার চেয়ে তার কাছে বেশি রহস্যজনক মনে হয়েছিল সোনার কেল্লার গুপ্তধনের গল্প। গল্প বাঁধতে গিয়ে গল্পের ছলটাকেই ব্যবহার করার এই কারিগরিখানা, যাকে বলে, লা--- জবাব।

সত্যিই সত্যজিৎ কি চমৎকার একটি দরকারি মন্তব্য করে গেলেন সাংবাদিকের দায়িত্ব আর কর্তব্য নিয়ে। ভেবে দেখুন, মূল খবরটা তো ছিল, গুপ্তধনের থেকেও চিত্তাকর্ষক। একজন শিশুর পূর্বজন্মের ঘটনা শোনার চেয়ে পরের দিনের কাগজে দরকারি হয়ে উঠল, তার বাড়ির নীচে নাকি- লুকিয়ে-রাখা গুপ্তধনের গল্প। আমাদের এই বিষয় আশয়ের সন্ধান যে আমাদের অনেক সময়েই মুখ্য বিষয়ের বিন্দু থেকে সরিয়ে দেয় আমাদের। এ গল্পের ভেতরে কি তারও গল্প লুকোনো নেই? সেটাও কি একটা অ্যাডভেঞ্চারের গল্পের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়-সংযোগ নয়?  

Powered by Froala Editor