সেই অমলময় দিনগুলি

পাড়ার ক্লাবের পুজো বেদির ওপর রাখা আছে রেডিয়ো। ফুল ভলিউমে চলছে। অথচ শব্দ মাঝেমাঝেই হাওয়ায় অন্য শব্দের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। কারণ ওই ক্লাবঘরের সাদা-কালো টিভিটায় মোহন-ইস্ট ফুটবল খেলা চলছে। দূরদর্শনে। আর বাক্সবন্দি টিভির মধ্যে প্রায় ঢুকেই গিয়েছে দুই দলেরই সমর্থক। ভাবুন একবার। ১৯৯৭-এর বিখ্যাত ‘ডায়মন্ড ম্যাচে’র কথা বলছি। ওটাই ছিল টিভিতে দেখা আমার প্রথম বড় ম্যাচ। বড় ম্যাচ চলাকালীন আমরা কল্পনাও করতে পারি না, মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা পাশাপাশি বসে খেলা দেখছেন। কিন্তু এটা মাঠ নয়। তাই পরিবেশটাও বেশ আলাদাই ছিল। সকাল থেকেই মাঠমুখো হয়েছিলেন বহু। মানে, কাতারে কাতারে লোক সেদিন যুবভারতী-মুখো হয়েছিল ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে ইলিশ-চিংড়ির লড়াই দেখবে বলে। আমাদের পাড়া থেকেই চার-পাঁচটা ম্যাটাডোর প্রবল উৎসাহ নিয়ে রওনা দিয়েছিল স্টেডিয়ামের উদ্দেশে। এত মানুষকে তো কখনও একসঙ্গে কখনো ভিড়ে ঠাসা গাড়িতে করে যেতে দেখিনি। মোড়ের মাথায় ঘোষ সুইটসের সামনে বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখছি এসব দৃশ্য। দুপুরের পর মুহুর্মুহু ছুটে চলা ম্যাটাডোরগুলো যেন কেবল স্টেডিয়াম নয়, স্বপ্নের খোঁজেও চলেছে।

ম্যাচের পর ‘পাহাড়ি বিছে’, দারুণ উচ্ছ্বসিত। ছবি: ইএসপিএন

তখন গোটা ভারতের ক্যাচওয়ার্ড যেন একজনই, মোহনবাগানের কোচ অমল দত্ত। বরাবরই স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে ভালোবাসতেন তিনি। চার্চিল ব্রাদার্সকে তাঁর ডায়মন্ড ছকে শেষ আটে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছেন সবুজ-মেরুনের ছেলেরা। পালতলা নৌকায় তখন হিরের চমক। সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল। লাল-হলুদ বাহিনীর বিরুদ্ধে নামার আগে অমল দত্ত ব্যঙ্গ করে ইস্টবেঙ্গলের তিন হার্টথ্রব বাইচুংকে ‘চুংচুং’, ওমেলোকে ‘অমলেট’ এবং সোসো-কে ‘শসা’ বলে বসলেন। ব্যস! তারপর জ্বলে উঠল ময়দান। এরজন্য প্রচুর নিউজ প্রিন্ট খরচ হল। প্রাক্তন ফুটবলাররা মতামত দিলেন। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল কোচ পিকে ব্যানার্জি বেশ শান্ত ছিলেন। একটি শব্দও খরচ করেননি। এর পর বাকিটা বলার আগে কয়েকটা বছর ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে, যে ইতিহাস পরে জেনেছি। ... ১৯৯২-এ ইস্টবেঙ্গল বরখাস্ত করে তাদের কোচ অমল দত্তকে। এরপর কোচিং থেকে ছুটি নিয়েছিলেন অমল দত্ত। এর ঠিক একবছর আগে, ১৯৯১-এর ২৪ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং একটি যুগান্তকারী বাজেট পেশ করেছিলেন। ভারতকে একটি ‘নতুন স্বাধীনতা’র পথ দেখিয়েছিলেন দেশের এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বিখ্যাত বাজেট বক্তৃতার সময় তিনি ফরাসি কবি, রাজনীতিবিদ ও জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন সদস্য ভিক্টর হুগোকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন: “পৃথিবীর কোনো শক্তি এমন একটি নতুন ধারণাকে থামাতে পারবে না, যার আসার সময় এসেছে।” 

 বাইচুংকে ‘ভোকাল টনিক’ পিকে ব্যানার্জির

আরও পড়ুন
ময়দানি প্রেমের প্রথম দিনগুলি

একটা কথা আগেই বলে রাখি। এতসব তথ্য কিন্তু বড় হতে হতে ময়দানের পথে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতেই জেনেছি। কখনো খেলার বিভিন্ন ম্যাগাজিন, কখনো খবরের কাগজ কিংবা বয়সে বড়দের কাছ থেকেও জেনেছি। আর সংবাদপত্র অফিসে কাজ করার কারণে এই খোঁজের কিছুটা সুবিধা তো হয়েইছে। যাই হোক, শীর্ষ পর্যায়ের কোচিং থেকে দূরে থাকা অমল দত্ত-ও তখন বিশ্বজুড়ে ফুটবলের বিবর্তন বোঝার ওপর ফোকাস করেছিলেন। নতুন ‘ধারণা’ নিয়ে তিনি ময়দানে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন কিছু নতুন তিনি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, যা ভারতীয় ফুটবল আগে কখনো দেখেনি। চেয়েছিলেন একটি অ্যাকাডেমি তৈরি করতে। কিন্তু তাঁর আইকনোক্লাস্টিক প্রকৃতি অনেকেরই পছন্দ ছিল না। ১৯৯৭ সাল। অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার ধারণা ভ্রষ্ট হল কোনো স্পনসর না পেয়ে। হতাশ হয়ে পড়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম মানুষটি। ঠিক তখনই মোহনবাগানের কয়েকজন কর্মকর্তা অমল দত্তের বাগুইআটির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। তাঁরা অমল দত্তকে নয়া পথ বাতলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ওই সময় অঞ্জন মিত্র এবং স্বপন সাধন বসু মোহনবাগানের কর্মকর্তা ছিলেন। এর আগে অবশ্য টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির চাকরি ছেড়ে সবুজ-মেরুনের কোচ হয়েছিলেন মহম্মদ হাবিব। তাঁর সঙ্গে দীপেন্দু বিশ্বাস, ললেন্দ্র সিং, রেনেডি সিং, কল্যাণ চৌবের মতো জামশেদপুর-ভিত্তিক অ্যাকাডেমির বেশ কয়েকজন তরুণ ফুটবলারও এসেছিলেন। অন্যদিকে, ১৯৯৬-এ জাতীয় ফুটবল লিগ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলও একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মোহনবাগান ক্লাব জাতীয় লিগের উদ্বোধনী সংস্করণে যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হাবিবকে তাঁর দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা হয়। ১৯৯৬-এর মাঝপথে হাবিবকে সরিয়ে সঈদ নঈমউদ্দিনকে কোচ করে মোহনবাগান। কিন্তু তাতেও সাফল্য আসেনি। ঠিক এই সময়েই বাগান কর্তারা অমল দত্তের কাছে গিয়েছিলেন। অমল দত্ত বাগান কর্তাদের বলেছিলেন― “আমি আপনাদের টুপিতে অনেক পালক দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু একটা হিরে হারিয়ে গেছে।”

 সেই ডায়মন্ড ছক।

এই সেই অমল দত্ত যিনি কোচ হওয়ার জন্য এক বছরের এফএ কোচিং কোর্সের জন্য ইংল্যান্ডে যান। একটা কথা বলি, ১৯৫৩-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক এবং ১৯৫৪-এ এশিয়ান গেমসের জন্য ভারতীয় স্কোয়াডে জায়গা পাওয়া অমল দত্তের কাছে ইংল্যান্ড সেই সময় ইংল্যান্ড অভিযান ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কারণ, কেবলমাত্র কোচ হওয়ার জন্য নিজের ফুটবল কেরিয়ারকে বিসর্জন দিয়ে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬০-এ ভারতের প্রথম পেশাদার কোচ হয়ে দেশে ফেরেন। এরফলে মধ্যবিত্ত আদর্শকে ভেঙে দেন অমল দত্ত। ভারতীয় ফুটবলে বিশাল ছাপও রাখেন তিনি। কেবল তাই নয়, এই কোচ হওয়ার জন্য ভারতীয় রেলওয়েতে নিরাপদ চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মাথায় তখন অসংখ্য-অজস্র নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ঘুরছে। তাই তাঁর লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় ফুটবলের চেহারা পরিবর্তন করা। এই ব্যাপারে প্রচণ্ড একগুঁয়ে ‘নতুনত্বে’ বিশ্বাসী অমল দত্ত তাঁর ডায়মন্ড সিস্টেমের বীজ পোঁতেন ১৯৮৮-র নেহরু কাপে। তখন ভারতীয় জাতীয় দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর অমল দত্তের ছেলেরা খেলেছিলেন ৪-৪-২ ছকে। যদিও সহজ ছিল না এই কাজ। ততদিনে ফুটবল প্রশাসকরা-সহ ভারতীয় কোচিং মহল তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন অমল দত্তের। আর হ্যাঁ, তখন ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন সঈদ নঈমউদ্দিন। ভারতীয় ফুটবল দল লিগ তালিকায় সবশেষে শেষ করলেও শক্তিশালী পোল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। গোল করেছিলেন সম্ভবত পি বিজয় কুমার। ভারত সেই বছর খেলেছিল শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি এবং চিনের বিরুদ্ধে। ফেলে দেওয়া যায়নি নঈম-অমলের যুগলবন্দিকে। সমালোচনাকে গায়ে না মেখে এই অমল দত্তই ব্যর্থতার ঝুল ঝেড়ে ফেলতে নতুন ধারণা নিয়ে মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের কোচ হয়েছিলেন, ১৯৯৭-এ। আর সেই বছর মোহনবাগান ক্লাবের রিক্রুটার ছিলেন সদ্যপ্রয়াত হারু মণ্ডল।

 

’৯৭ ফেড কাপ সেমির লাল-হলুদ দল

 

অমল আসায় সেই বছরটা তেতে উঠেছিলাম আমরা। আমাদের কাছে ডায়মন্ড, গোল্ড কিংবা মেটাল— সবই এক। ‘যেনতেনপ্রকারেণ মোহনবাগান জিতুক’ কেবল এটুকুই বুঝতাম। তবে, সবাই যখন ‘ডায়মন্ড ডায়মন্ড’ করে হইহই করছে সে-বছর, তখন বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ব্যাপারটা কী? ‘ডায়মন্ড’ মানে হিরে বলে এড়িয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। এরপর পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে শুনেছিলাম, ব্যাপারটা আসলে একটি ছক। দলের ফুটবলাররা এমনভাবে উঠবে-নামবে যাতে তা হিরের আকার নেয়। তাই আশা আরো দ্বিগুণ হল। হিরেও নিশ্চয়ই সবুজ-মেরুন খনির আঁচিয়ে উঠবে, এমন স্বপ্নে বিভোর হতে থাকলাম আমরা। সেই সময় কলকাতায় হামেশাই পাওয়ার কাট হত। দমবন্ধ করা গরমে সকাল, বিকেল, রাত কোনো বালাই নেই, লোডশেডিং হয়ে যেত। ফেড কাপ ফাইনালে চার্চিলকে ছয় গোল দেওয়ার পর যখন শেষমেশ ঘোষণা হল, মোহন-ইস্ট সেমি টিভিতে দেখানো হবে, আনন্দের সঙ্গে ভয়ও হয়েছিল। ম্যাচ চলার সময় কারেন্ট চলে গেলে খেলা দেখব কীভাবে! মনে আছে যে, ম্যাচের আগের দিন থেকে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে আমাদের পাড়া থেকে ফোন যাওয়া শুরু হয়েছিল। একটাই আর্জি, ‘‘দাদা ম্যাচের সময় যাতে কারেন্ট না চলে যায়, একটু দেখবেন।’’ নীলেশ ভট্টাচার্যের ‘ডায়মন্ড টাচ’ নামে এক লেখায় (‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত) মহামূল্যবান কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। সেখানেও ছিল এই কারেন্ট চলে যাওয়ার কথা। ডায়মন্ড সিস্টেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন প্রাক্তন ভারতীয় মিডফিল্ডার সত্যজিৎ চ্যাটার্জি। অভিজ্ঞ কোচ কীভাবে তাঁর ডায়মন্ড মিশনে তখন মজে ছিলেন, সে-কথা জানা যায় সত্যজিতের কাছে। তখন মোহনবাগান ক্লাবে চলত সকাল-বিকেল অনুশীলন। ফুটবলাররা ক্লাব তাঁবুতে সময়মতো চলে আসতেন। গরমকাল। বাতাস আর্দ্র। তবুও ক্লান্তি গিলে ফেলতে পারেনি সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের। লোডশেডিং হলে অমল দত্ত প্রায়ই সমস্ত ফুটবলারকে গাছের তলায় বসিয়ে ডায়মন্ড সিস্টেমটি বোঝাতেন। কিংবদন্তি কোচ অ্যারিগো সাচ্চির অধীনে থাকার সময় ডায়মন্ড সিস্টেমে খেলা এসি মিলানের সাফল্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন অমল দত্ত। এসি মিলান সেই সময়, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত, তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ, দু-টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ, তিনটি উয়েফা কাপ জিতেছিল। আর অমল দত্ত মোহনবাগান ফুটবলারদের ওপর এই সিস্টেমকে প্রয়োগ করার আগে এর কিছু পরিবর্তনও করেছিলেন। কী সেই পরিবর্তন? ফর্মেশন দাঁড় করালেন ৩-২-৩-৩’এ। এই ফর্মেশনে ডিফেন্সিভ স্ক্রিন হিসাবে দেবজিৎ ঘোষ এবং আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসাবে বাসুদেব মণ্ডলকে তিনি ব্যবহার করলেন। ১৯৯৭-এর ফেডারেশন কাপকে তিনি বেছে নিলেন ডায়মন্ড সিস্টেমের পরীক্ষার মঞ্চ হিসাবে।

কোচ অমল দত্তের সঙ্গে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড

 

এভাবেই রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছিলেন বাইচুং

 

স্বপ্ন দেখার শুরুটা দারুণ হয়েছিল টুর্নামেন্টের ‘কালো ঘোড়া’ চার্চিল ব্রাদার্সকে হাফ ডজন গোলের মালা পরিয়ে। এবার এল সেই দিন। ১৩ জুলাই, ১৯৯৭। অমল দত্তের ব্যঙ্গের (চুংচুং, অমলেট, সসা ইত্যাদি) জবাব দেওয়ার জন্য তাঁর ‘ভোকাল টনিক’-কেই বেছে নিলেন পিকে ব্যানার্জি। আর ফেড কাপের সেমিফাইনালটি ছিল মরশুমের প্রথম ডার্বিও। যা ঘিরে তুমুল উন্মাদনা ছিল। মনে আছে যে, মোহনবাগান তারকা চিমা ওকেরি এবং ইস্টবেঙ্গল তারকা বাইচুং ভুটিয়া দূরদর্শনে একটা সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন করেছিলেন দুই দলের সমর্থকরা মাঠে গিয়ে যাতে সুষ্ঠুভাবে খেলা দেখেন সেই উদ্দেশে। স্থানীয় মিডিয়া, খবরের কাগজ ম্যাচটি ঘিরে বিরাট হাইপ তুলে দিয়েছিল। তাছাড়াও দূরদর্শনে ম্যাচটি সরাসরি সম্প্রচারিত হবে কিনা, তা ঠিক হয় ম্যাচের কয়েকদিন আগে। তাই কলকাতার তামাম দর্শকরা সদলবলে খেলা দেখতে ছুটেছিলেন। দুপুরের পর মুহুর্মুহু ছুটে চলা ম্যাটাডোরগুলোকে দেখছি। ইস্টবেঙ্গলের ম্যাটাডোর দেখলেই চিৎকার করছে নুতোদা। ‘‘চার্চিলকে ছ-গোল দিয়েছি। তোদের জন্য একটা কন্সেশন করে পাঁচ শূন্যয় হারাব।’’ আর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা কেমন একটা ম্রিয়মাণ। যেন পাহাড়প্রমাণ চাপ ঢলে পড়েছিল তাঁদের ওপর। প্রায় ১,৪০,০০০ দর্শক নিয়ে শুরু হল ফেড কাপ ডার্বির সেমি। মোহনবাগান গতিময় শুরু করল, মনে হল যে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে ফেরার তাল খুঁজছে ইস্টবেঙ্গল। এরই মধ্যে সত্যজিৎ চ্যাটার্জি মিস করলেন সিটার। চিমাও সহজ সুযোগ হাতছাড়া করলেন। বাসুদেবের একটা শট লাল-হলুদ গোলকিপার বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। টিভিটাই তখন যেন স্টেডিয়াম। যে যার নিজের নখ খাচ্ছে। কেউ বা ঘনঘন গলায় ঢালছে জল। শৈলেন কাকা এরইমধ্যে বলে উঠল, “চিন্তা করিস না গোল একটা না একটা ঢুকবেই ঢুকবে।”গোল ঢুকেছিল বটে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে মোহনবাগানের জালে। নাজিমুল হক তিরিশ মিনিটের আগেই ইস্টবেঙ্গলকে কাউন্টার অ্যাটাক করে এগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন যেন মূল ভিলেনের নাম নাজিমুল নয়, শৈলেন কাকা। সে-ই যেন সেম সাইড গোল করে ফেলেছে। আর যাই কোথা! শৈলেন কাকাকে ‘দূর হ, বেরো ঘর থেকে, শালা ঘর শত্রু বিভীষণ’ বলে ক্লাব ঘর থেকে বের করে দেওয়া হল। তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন ইস্টবেঙ্গলের বাইচুং। করলেন হ্যাটট্রিক। আর চিমা ওকেরি অসামান্য ব্যাকভলিতে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো মোহনবাগানের পক্ষে একটা গোল করেছিলেন বটে। কিন্তু তা ছিল সান্ত্বনামূলক। আমরা ১-৪ গোলে হেরে গিয়েছিলাম। এক্কেবারে গো-হারা! ইস্টবেঙ্গল কোচ পিকে ব্যানার্জি ততক্ষণে পেয়ে গেছেন ‘ডায়মন্ড কাটার’ আখ্যা। আর ম্যাচের পর দেখলাম রেডিয়োটা বেদির ওপরে উলটে পড়ে আছে। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের ভালোবাসার অত্যাচার আর কী! ক্লাবের টিভির ঘর থেকে ব্যান্ড খঞ্জরি নিয়ে ততক্ষণে উল্লাসে বেরিয়ে পড়েছে লাল-হলুদ ভক্তরা। এমন জয় তারা ভাবতেও পারেনি। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার হল, সেদিন কেউ আমাদের মতো হঠাৎ রাজা থেকে ফকির হয়ে যাওয়া ‘সর্বহারা’ মোহনবাগান সমর্থকদের টিটকারি করেনি। কি জানি, ম্যাচ জিতলে অতি-আনন্দেও কেউ দার্শনিক হয়ে যায় কিনা! তাহলে কি ডায়মন্ড সিস্টেম ব্যর্থ হয়েছিল? কেবলমাত্র একটা ম্যাচের বিচারে কি কোনো সিস্টেমকে ব্যর্থ বলা যায়? উত্তরে ‘হ্যাঁ’ হয়তো বলতে পারবেন না অতি বড় ফুটবল বিশেষজ্ঞও। ফেড কাপে হারের বদলা কিন্তু মোহনবাগান একমাসের মধ্যেই নিয়েছিল কলকাতা লিগে ১-০ গোলে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে। মোহনবাগান টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিকে হারিয়ে শেষবার ডিসিএম ট্রফি জিতেছিল অমল দত্তের আমলেই। পৌঁছেছিল ডুরান্ড কাপের ফাইনালেও। কিন্তু তা পর্যাপ্ত মনে হয়নি তখন। তাই পরের মরশুমে অমল দত্তকে সরিয়ে টিকে চাতুনিকে কোচ করার সঙ্গে সঙ্গে এই ডায়মন্ড সিস্টেম ব্যর্থ নয়, বরং অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল মোহনবাগানে। তবে চাতুনিকেও বেশ মনে পড়ে। সে-কথাগুলি তোলা রইল আগামী পর্বের জন্য।

Powered by Froala Editor