পরজন্মেও মোহন-সমর্থক হতে চেয়েছিলেন উমাকান্ত, আত্মহত্যার ৪৫ বছর পর ফিরল সেই স্মৃতিই

বাঙালির চিরকালীন আবেগপ্রবণতাই যে বাংলা ময়দানের এক দৃঢ় ভিত্তি হয়ে আছে, তা হয়তো আজ আর অস্বীকার করবে না কেউ। এই তো, দুদিন আগে সকালে আত্মহত্যা করলেন টিংকু দাস। ইতিহাস বইয়ের পাতা ওল্টালে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ খুঁজে পাবে না টিংকু দাসকে। আমরাও তো সেভাবে পাইনি উমাকান্ত পালধিকে।

ক্ষয়িষ্ণু বঙ্গফুটবলের সৈকতে একটা তিনচাকার সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছেন টিংকু। সবুজ আর মেরুন রঙের পতাকা কোনোদিন গা ছাড়া হয়নি যে মানুষটির। বছরখানেক আগে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে একটি পা, তারপর থেকে মোহনবাগান অন্তপ্রাণ মানুষটির ভরসা ঐ তেচাকায়। স্ত্রী অন্যের বাড়ি পরিচারিকার ঠিকে কাজ করেন, নিজের সম্বল বলতে ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর আর একফালি মুদি দোকান। অথচ পড়ন্ত বেলার রোদে ঘরের একদেওয়ালে টাঙানো মোহনবাগান পতাকাটা চকচক করে উঠত। কেন আত্মহত্যা করলেন টিংকু?

বেশিরভাগেরই মত যে কলকাতা থেকে খেলা দূরে সরে যাওয়ায় নিজের সামান্য অর্থে বাইরে গিয়ে খেলা দেখা সম্ভব হচ্ছিল না টিংকুর। এই মানসিক অবসাদ তাঁকে খুকে দেয় অন্ধকারের দরজা!

আরও পড়ুন
অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক তিনি, ডাক পেয়েছিলেন আর্সেনাল ক্লাব থেকেও

বাংলা ময়দানের মাটির তলায় তলায় চিনেঘাসের মতো থেকে গেছেন টিংকুরা, ১৯৭৫ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে ৫-০ হারের পর মৃত্যুর পথ বেছেনিয়েছিলেন উমাকান্ত পালধি, এক্ষেত্রে উল্লেখ্য তার সুইসাইড নোটটি যাতে বড় বড় হরফে লেখা ছিল -

‘পরের জন্মে যেন মোহন মায়ের কোলেই আমার জন্ম হয় আর এই অপমানের বদলা নিতে পারি।’ এভাবেও ভালোবাসা যায়?

কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের মতো ময়দানেও এখন কর্পোরেটের হাওয়া, আধুনিকতার নিওন আলোর তলায় কোথাও মুখ লুকোচ্ছে জ্যোৎস্না। সত্তর আশির দশকে মোহনবাগান তাঁবুতে দেখা যেত ভাঁড় নিতাই, ছাতা ঘোরানো মণ্ডলের মতো মানুষদের। প্রবল দারিদ্রও যাদের হাত থেকে কোনোদিন কেড়ে নিতে পারেনি ২০ পয়সার টিকিট। সেই কুড়ি পয়সা কালের স্রোতে ভেসে ভেসে হয়েছে ২০০ টাকা, সেই সুব্রত-প্রশান্ত জমানা থেকে চিমা-সত্যজিত-ব্যারেটো হয়ে গোষ্ঠপাল সরণীর বাগানে এখন নতুন বসন্ত বেইতিয়া-ফ্রানরা।

আরও পড়ুন
‘মোহনবাগানি’ নবনীতার ফুটবলে-প্রেমেও জড়িয়ে ছিল পিতৃতন্ত্রের দেওয়াল-ভাঙার মধুর স্বপ্ন

কত খেলোয়াড় এলেন, চলে গেলেন, থেকে গেল রেকর্ডবুকের খসখসে অক্ষর আর একটা একটা করে বসন্ত। সেই সংখ্যাতত্ত্বে হয়ত ব্যারেটো আছেন, বাইচুং আছেন, আছেন চিমা থেকে সুব্রত-দিলীপ সবাই কিন্তু বাগানের বসন্তের দূত যে আজন্ম তার আকুলপ্রাণ সমর্থকরা। একটা ৫-০ হার হয়ত সুব্রত ভট্টাচার্যের কেরিয়ারে কালো ছাপ দিয়েছিল কিন্তু ঐ অপমান কেড়ে নিয়েছিল উমাকান্তর জীবন। মোহনবাগান গোল করলে গোষ্ঠ পাল গ্যালারির মাথা থেকে আর ছাতা ঘোরান না মণ্ডলবাবু। ভদ্রলোকের নাম আর মনেও রাখেনি কেউ। এই মরশুমে বাগানের গালিচায় ফোটা রক্তপলাশের ভিড়ে টিংকু হারিয়ে গেলেন। হারিয়ে গেলেন শুধুমাত্র ক্লাবের পাশে না থাকতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে।

১৩০ বছরের ইতিহাসে কত মানুষ যে হারিয়ে গেলেন, তার হিসেব রাখেনি কোনো স্কোরবোর্ড। কাজুর ক্যান্টিন থেকে ফাঁকা হয়েছে শুধু একটা করে মুখ।

এখন কিবু ভিকুনার যাদুদণ্ডে দেশের সেরা ট্রফির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে গঙ্গাপাড়ের দল। আর কটা দিন পরেই হয়ত সবুজ মেরুন আবিরে মুড়ে কোনো এক চৈত্রের বিকেলে রক্তিম হয়ে উঠবে কল্লোলিনী কলকাতা। ট্রফির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উচ্ছ্বাস দেখাবে কোটি কোটি মোহনজনতা আর বিকেলের গড়ের মাঠে তেচাকার সাইকেলে বসে থাকবে টিংকু। তার পাশে ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে থাকবেন উমাকান্ত, মণ্ডলবাবু, সুখেন চাটুজ্জেরা - সবুজ মেরুন আবিরের রং ওদের শরীর ছুঁয়ে বেঁকে যাবে গোষ্ঠপাল সরণীর দিকে। এখানেই হয়তো স্কোরবোর্ডের সাদাকালোর ওনেক ওপরে পড়ন্ত বেলার রোদে মায়ের আঁচলের রঙে সেজে উঠবেন এঁরা, সেখানে কোথায়ই বা পেশাদারিত্বের মোড়ক, কোথায়ই বা কর্পোরেট অনুশাসন?

Latest News See More