বাংলার মাটি , বাংলার জল, বেঁচে থাক বাঙালির ফুটবল

তুমি কি সেই আগের মতই আছ? নাকি অনেকখানি বদলে গেছ? কলকাতা ময়দানের দিকে তাকিয়ে এমন একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায় পয়লা বৈশাখ এলেই। বাঙালির নববর্ষ-হালখাতা-মঙ্গলঘট-নতুন পঞ্জিকা-বাংলার মাটি-বাংলার জল-নতুন জামা পেরিয়ে সবুজ ময়দান। ময়দান। গড়ের মাঠ। এসপ্ল্যানেড কথাটির অর্থ গড়চত্বর, গড়ের মাঠ, দুর্গ ও নগরের মধ্যবর্তী সমতল মাঠ। উত্তরে এসপ্ল্যানেড ইস্ট (বর্তমানে সিধো-কানহো ডহর), দক্ষিণে এ.জে.সি. বোস রোড, পুবে চৌরঙ্গী, পশ্চিমে গঙ্গা। পরিখা দিয়ে ঘেরা অঞ্চল। কলকাতার ফুসফুস। কাদাজল মাখা ফুটবল। জোনাকির মতো জ্বলে থাকা ক্লাবগুলো। ছোটো ক্লাবের তাঁবুগুলো থেকে বেরিয়ে আসত জীর্ণ মালি। বেশিরভাগই উড়িয়া। ঘাসের সঙ্গে আবাল্য সখ্য এই সব মালিদের। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডানের তাঁবুর বাইরে ভিড়, খেলার দিন। টিকিটের দাম ছিল ৬০ প. (মাঠের লম্বালম্বি) আর ১ টা. ১০ প. (আড়াআড়ি)। কাঠের গ্যালারি। টিকিট ফুরিয়ে গেলে বা লাইনে মারপিট। মোহনবাগান মাঠের ‌র‌্যামপার্টের (এই শব্দটিও গড়-সংক্রান্ত, একদিকের খোলা অঞ্চল) দিকে পজিশন নিতে পারলে কষ্ট করেও কিছুটা দেখা যেত। ও-দিকটায় আবার পেরিস্কোপ ভাড়া পাওয়া যেত, পাঁচ মিনিটের হিসেবে। ম্যাচ শুরু হলে সেই পেরিস্কোপে চোখ রাখছে বাঙালি। আর এই ময়দানি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো ফেস্টিভাল হল পয়লা বৈশাখের বারপুজো। 

ব্রিটিশরা যখন পরাধীন ভারতে ফুটবল নিয়ে আসে তখন এই খেলাটিকে সবার আগে রপ্ত করে নিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঙালিরা। ব্রিটিশ শাসকদের চিন্তায় ছিল ফুটবল নামক নেশায় বাঙালিদের বুঁদ করে রেখে স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তিমিত করে রাখা। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হল কিছুদিনের মধ্যেই। উনিশ শতকের একেবারে শেষদিকে, মানে বাঙালির ফুটবলের পায়েখড়ির ঐ বছর পনেরো পরে শোভাবাজার ক্লাবের বিলিতি টিমকে হারিয়ে ম্যাচ জয়টাই প্রথম টনক নড়ায় ব্রিটিশদের। তারপর এগারোর শিল্ড জয় তো কাল্ট হয়ে আছে ইতিহাসে। ১৯২০-তে ইস্টবেঙ্গলের জন্মের পর এবং তিনের দশকে মহামেডানের স্বর্ণযুগ থেকে ফুটবল খেলাটি বাঙালির কাছে দু’ভাবে এল। এক, স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার হিসেবে আর দুই, জাতি হিসেবে বাঙালির একটি বিশেষ আইডেন্টিটি কার্ড হয়ে। বিশ্বব্যাপী ফুটবলের যে কলোনিয়াল রূপ, যে সাম্যবাদী ইমেজ - বাঙালি তার সবটুকু আখর দিয়েই গড়ে নিল ফুটবলের এক স্বতন্ত্র মূর্তি। উত্তরভারতের পেশিবহুল মহাদেব শিব যেমন বাঙালির ঘরে নাদুসনুদুস ভোলানাথ রূপে হয়ে পূজিত হন, তাঁর আভরণহীন শরীরে যেমন লেগে থাকে মায়াবি লাবণ্য - বাঙালির ফুটবল খানিকটা সেইরকম। ইস্ট-মোহন তরজার সঙ্গে গ্যালারিতে এসে পড়ে মিষ্টির হাঁড়ি, ভোজনরসিক বাঙালি খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মিলিয়ে দিল ফুটবলকে। মিষ্টিপ্রেমে-অপ্রেমে-খুনসুটিতে ফুটবলের গায়ে একটি বাঙালিয়ানার ছাপ লেগে গেল ঐ বিংশ শতাব্দীর গড়া থেকেই। পয়লা বৈশাখ তাই বাঙালির নতুন বছর শুরু হলে, ঢাকে কাঠি পড়ে ময়দানি ফুটবলের নতুন মরশুমেরও। ফুটবলে সাফল্য লাভের প্রত্যাশায় পয়লা বৈশাখ এই পুজো উদযাপন করে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল এবং তাদের মতো আরও অসংখ্য ময়দানের ক্লাবগুলি। এই পুজোর মূল ভাবনা ছিল যে, প্রথম দিনটি যদি ভালো কাটে তাহলে সারাবছরই ভালো যাবে। বারপোস্ট তুলে খুঁটিতে পুজোর আয়জন করা হয়ে আসে প্রতিবছর। শতাব্দী পেরিয়েও এ-প্রথাটির জনপ্রিয়তা কমেনি। 

ময়দানের বারপুজোর কথা উঠলে সবার আগে মনে পড়ে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের দুই জাঁদরেল কর্তার কথা। এই দুই কর্তা ময়দানের বারপুজোর উৎসবকে কয়েক দশক ধরে আরও যেন রঙিন করে দিয়েছিলেন। 

জ্যোতিষ গুহ আর ধীরেন দে। জ্যোতিষ গুহ ১৯৩০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে কিছুদিন খেলেছিলেন, ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উত্তপ্ত আবহাওয়ার মাঝেই জ্যোতিষ গুহ পাড়ি জমান বিলেতে। গুহ পরিবারের জ্যোতিষ বিলেতে গিয়েছিলেন মূলত ব্যারিস্টরি পড়তে, কিন্তু ঐ যে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। জ্যোতিষ গুহর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। ইস্টবেঙ্গলে ততদিনে কিছুটা হত্তাকর্তা হয়ে যাওয়া জ্যোতিষ গুহ ইউরোপে সান্নিধ্য পেলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্লাব আর্সেনালের, সেখানে খেলার পাশাপাশি খেলা পরিচালনার কাজটাও মন দিয়ে শিখে দেশে ফিরে এলেন তিনি। কলকাতায় ফিরেই ধরলেন ইস্টবেঙ্গলের হাল, স্বাধীনতার আগে আগে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক ক্রমশ বাড়ছে এ দেশে, জ্যোতিষ গুহর হাত ধরেই দলে আসতে শুরু করলেন একের পর এক তারকা। বাংলা ফুটবলের সম্ভবত প্রথম বিদেশি ফ্রেড পাগস্লে ছিলেন বার্মিজ রিফিউজি, তাঁকে দলে নিয়ে জ্যোতিষ গুহ প্রথম সাড়া ফেলে দেন। অন্যদিক ধীরেন দে-ও ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র৷ একদিকে যেমন তিনি কলকাতার বিখ্যাত দে'জ মেডিকেলের মালিক, তেমনি পাশ করা রেফারিও বটে। মোহনবাগানের ইতিহাসে ধীরেন দে-র মতো চরিত্র আর নেই। জ্যোতিষ গুহ যেমন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন ইস্টবেঙ্গলের জন্য, ধীরেন দে তেমনি সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখতেন মোহনবাগানকে। নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে মোহনবাগান তাঁবুতে বিলিয়ে দিতেন দুঃস্থ খেলোয়াড়দের মধ্যে। পঞ্চাশের দশকে বদ্রু ব্যানার্জি-চুণী-সাত্তারের মতো তারকাদের গডফাদার হয়ে উঠেছিলেন ধীরেন দে, স্যুটেড বুটেড ধীরেন ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের বন্ধু, কলকাতার উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাশীল সমাজে আনাগোনা সত্ত্বেও ময়দানি আবেগে ধীরেন দে ছিলেন সবার ওপরে। একদিকে জ্যোতিষ গুহ যখন মোহনবাগানের দিকে অভিযোগের তির ছুঁড়তেন কোনো ম্যাচকে ঘিরে, সঙ্গে সঙ্গে রেগে আগুন ধীরেন বাবু। অথচ এই দুই কর্তার বন্ধুত্বের গল্পটি বাস্তবে দেখা যেত নববর্ষের প্রথম দিনটিতে। পয়লা বৈশাখে যখন সেজে উঠত ময়দান তখন প্রিয় সহযাত্রী জ্যোতিষ দার মতোই ধুতি-পাঞ্জাবি আর চন্দনের তিলক কেটে ময়দানে আসতেন ধীরেন দে। দুই ক্লাবে ঘটা করে বারপুজো, সদস্য আর সমর্থকদের ভিড়ে গমগমে ময়দান। কালীঘাট থেকে পুরোহিত এনে হত সেই বারপুজো। বারের চারপাশে থাকত পাহারা। পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারটিকে পাহারা দেওয়ার রীতি। পাছে কেউ বার ডিঙিয়ে না যায়! আসলে বার ডিঙোলে নাকি ক্লাবের পক্ষে তা অমঙ্গল! ময়দানে এমন কিছু মিথ আজও বর্তমান। গোটা গ্যালারি ভরে যেত বারপুজো দেখতে। ক্লাবগুলির গেট সেজে উঠত আমপাতা-কদমফুলে, বসত মঙ্গলঘট, বিলি হত সরবত ও মিষ্টি। দুই দলের ফুটবল আগামী মরশুমের প্লেয়ারদের আগ্মনে জমজমাট হয়ে উঠত ময়দান। দেদার খানাপিনা। শোনা যায় খাওয়া দাওয়ার পর দুই সাবেক কর্তা কখনো দেখা করতেন গড়ের মাঠের কাছে, সে আড্ডায় যেমন মিশে যেত দুই চিরন্তন ফুটবল স্রোত তেমনি সেই নববর্ষের সকালে মতি নন্দী, মুকুল দত্ত, পুষ্পেন সরকারের সামনেই মজার ঝগড়া লেগে যেত দুই কর্তার, পরক্ষণেই আবার হাসির ফোয়ারায় এসে মিলে যেত সেই আড্ডা। 

আরও পড়ুন
বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা

নয়ের দশকের পর থেকেই ময়দানে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা কমল। বড়ো ক্লাবগুলি নয়ে এল কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট। রীতি মেনে পয়লা বৈশাখের আগে প্লেয়ার সই করানো, পয়লা থেকে মরশুম শুরুর যে প্রথা তা বদলাল সময়ের দাবিতে। তবে বিলিতি ও ভিনরাজ্যের প্লেয়ার আগমনের পরেও বারপুজোর উন্মাদনা টিকল অনেক বছর। ২০১৯ সালে শেষবার গিয়েছিলাম ময়দানে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের তৎকালীন কোচ আলেহান্দ্রো মেনেন্দেসকে দেখেছিলাম হাঁড়ি থেকে হাসিমুখে তুলে নিতে রসগোল্লা, মনে মনে ভাবছিলাম ফুটবলের স্বতন্ত্র বাঙালি রূপটির সঙ্গে কেমন মিশে গেলেন সেই রাউল, ইনিয়েস্তা - ক্যাসিয়াসদের দেশ থেকে আসা আক নাগরিক। শুনেছি মার্সেসাইডের বিখ্যাত ক্লাব লিভারপুলের ফ্যানেরা ম্যাচ শুরুর আগে স্কার্ফটি মাথার ওপর তুলে গান গায় - ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক আলোন’ - বিটলসের শহরে, লিভারবার্ডের দেশে কত ইতিহাস মিশে আছে এই রীতিটির পিছনে। প্রায় তিন যুগ আগে হিলসবরো স্টেডিয়ামে মারা যাওয়া মানুষদের জানান দেওয়া, তাঁরা একা নন। তেমনই স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো ফুটবল ক্লাবগুলির রয়েছে নিজস্ব ফুটবল সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন
কালো মেয়ের পায়ের তলায়

বাঙালি ফুটবলকে একটি সংস্কৃতির বল্কল দিতে পেরেছে, একশো বছরে সে আবরণে এসেছে নতুন নতুন পালক, আরও জমকালো হইয়েছে ময়দান, পয়লা বৈশাখ, বারপুজো। জানা নেই, অদূর ভবিষ্যতে এই বারপুজোর রীতি জানবে কিনা উত্তর প্রজন্ম, ছোটোক্লাবগুলি টাকার অভাবে ধুঁকছে, সারাবছর ধুধু করতে থাকা বড়ো ক্লাবের টেন্টেও বারপুজোর জৌলুস দেখা গেল না গত দু-বছরে। এ-বছর হয়ত আবার কিছু তর্ক হবে আকাশবাণীর নিচে, খুনসুটিতে মাতবেন সমর্থকেরা, আনাগোনা হবে তারকাদের। পুরোনো জলসাঘরে আচমকা জ্বলে উঠবে ধুলো জমা ঝাড়বাতি। তবে সেখানে আলাহিয়া বিলাওল বাজবে না নিশ্চিত। বাজবেন মান্না দে।     

আরও পড়ুন
যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের অভ্যেস...

"রকে রকে ঝগড়া, ঘরে ঘরে ডাইভোর্স
ইলিশে ঘটিতে রসাতল,
সব খেলার বাঙালির তুমি ফুটবল..."
শুভ নববর্ষ ময়দান। শুভ নববর্ষ বন্ধুরা। বাঙালির ফুটবল, বেঁচে থাক, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক হে ভগবান…

Powered by Froala Editor