দুর্ঘটনায় পা হারিয়েও ইংলিশ চ্যানেল জয়, বঙ্গসন্তানের ইচ্ছাশক্তির সামনে নত হয়েছিল পৃথিবী

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে দশ বছরের ছেলেটা। রেল দুর্ঘটনায় আহত পা দুটোকে অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারলেন না ডাক্তারেরা―হাঁটু থেকে বাদ দিতে হল দুটো পা-ই। মায়ের চোখের জল দেখেও একটুও দমল না সে। চোখে চোখ রেখে জোর গলায় জানিয়ে দিল― ‘সাঁতারু আমি হবই।’

উঃ ২৪ পরগনার বল্লভপুর গ্রামের প্রাণবন্ত, ডানপিটে ছেলেটার ছোটো থেকে দুচোখে একটাই স্বপ্ন, বিশ্ববিখ্যাত সাঁতারু হবে সে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কিশোর বয়সেই সে হারিয়ে ফেলে তার স্বপ্নপূরণের যাত্রাপথের সারথি– তার দুটি পা, কিন্তু যা থেকে গেল তা হল তার অদম্য মনোবল আর স্বপ্নকে ছোঁয়ার সেই তীব্র বাসনা। বছর দেড়েক নানা হাসপাতালে চিকিৎসার পর, হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার মাস কয়েকের মধ্যেই বাবার সঙ্গে কাছের পুকুরে যাওয়া শুরু করল সে। যে পথে যেতে হবে তা কতটা দুর্গম, সেদিনই উপলব্ধি করেছিল সেই কিশোর। জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রবল বেগে দুহাত দিয়ে কাটাচ্ছে সামনের জল, তবুও কোমর থেকে এক অদ্ভুত ভার যেন শরীরটাকে টেনে নামিয়ে দিচ্ছে নিচের দিকে। আবারও প্রাণপণে ভেসে থাকার চেষ্টা। এইভাবেই শুরু হয় তাঁর কঠিন অধ্যবসায়ের প্ৰথম পর্ব। সারাদিনে স্নান খাওয়ার সময়টুকু বাদে দিনের সবটুকু সময়ই তার কাটত জলে, আয়ত্ত করত পায়ের ব্যবহার ছাড়াই জলে ভেসে থাকার নানাবিধ কৌশল।

তিনিই মাসুদুর রহমান বৈদ্য― ‘বিশ্বের প্রথম শারীরিক প্রতিবন্ধী এশীয় সাঁতারু’। দীর্ঘ সাধনার পর তিনি ১৯৮৯ সালে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে আর্টিফিসিয়াল লিম্ব সেন্টার  দ্বারা আয়োজিত সতেরোটি সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আর সমস্ত বিচারক, দর্শকমণ্ডলীকে বাকরুদ্ধ করে এর মধ্যে ষোলোটিতেই তিনি প্রথম হন। এরপর গঙ্গাবক্ষে পানিহাটি থেকে আহিরীটোলা পর্য্যন্ত সাঁতার কেটে এক প্রতিযোগিতায় পঞ্চম হন। ১৯৯৫-এ বিখ্যাত সাঁতারু বুলা চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় মুর্শিদাবাদের এক দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতায় দীর্ঘ একাশি কিলোমিটার সাঁতার কেটে প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে আবারও অবাক করে দিলেন সমগ্র ক্রীড়াজগৎকে।

একের পর এক সাফল্য ক্রমে আরও মনোবল বাড়াতে থাকে এই তরুণ সাঁতারুর। তবে এবারের লক্ষ্য ইংলিশ চ্যানেল। ‘দু পা নেই। এভাবে কি ইংলিশ চ্যানেল পেরোনো সম্ভব?’ এই প্রশ্নকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ ফেললেন মাসুদুর। ১৯৯৭-এ পার হয়ে গেলেন ইংলিশ চ্যানেল। সাফল্যের পুরস্কারের সঙ্গে ঘোষিত হলেন ‘বিশ্বের প্রথম চ্যানেল পার হওয়া শারীরিক প্রতিবন্ধী সাঁতারু’ হিসেবে। তবে এই তকমা তাঁকে গর্ব আর ক্রোধের এক মিশ্র অনুভূতি এনে দিয়েছিল। তিনি বরাবর দৃপ্ত কণ্ঠে বলতেন― "আমি প্রতিবন্ধী নই। সকলের মতো আমিও একজন।"

আরও পড়ুন
এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয়, গুগল শ্রদ্ধা জানাল বাঙালি সাঁতারুকে

প্রবল মনোবলে বলীয়ান মাসুদুর এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সাঁতারের দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক স্তরে পাড়ি দিলেন। তারিখটা ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০০১। সংকীর্ণ, তরঙ্গবিক্ষুব্ধ জিব্রাল্টার প্রণালীতে সাঁতার শুরু করলেন এই সাহসী তরুণ সাঁতারু। স্পেনের ট্যারিফ দ্বীপ থেকে সাঁতার কেটে মরক্কোর সাগরতীর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন মাত্র ৪ ঘণ্টা ২০ মিনিটে। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ট্যারিফ দ্বীপের কাছে একটি নৌকা থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছিলেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে জিব্রাল্টার মতো ক্ষুব্ধ সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে জিতলেন তিনি। সাঁতারের ইতিহাসে খোদাই করে দিলেন নিজের নাম। ২০১০ সালে সাঁতার কেটে পার হলেন শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মধ্যবর্তী পক প্রণালী। এভাবেই সফলতার মুকুটে আসতে থেকেছে একের পর এক রঙিন পালক।

মাস্টার ব্লাস্টার সচিন তেন্ডুলকারের কথায় মাসুদুর রহমান ছিলেন এদেশের ‘রিয়েল হিরো’। হিরোই বটে! মঞ্চে দুটো ক্লাচে ভর দিয়ে মাইক হাতে যখন তিনি বলতেন তাঁর নিরলস সাধনা, অদম্য মনোবল আর সংগ্রামের কাহিনি, এক অদ্ভুত বিস্ময় যেন গ্রাস করে ফেলত সকলকে।

আরও পড়ুন
রাগবি বল দিয়ে কসরৎ শুরু, ধীরে ধীরে বাঙালিকে ফুটবল খেলতে শেখালেন নগেন্দ্রপ্রসাদ

২৩শে এপ্রিল ২০১৫। কলকাতার বিধান শিশু উদ্যানের এক অনুষ্ঠানে একঝাঁক কচিকাঁচাদের সামনে নিজের কাহিনি শোনানোর সময় তিনি বললেন ‘ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার সময় আমি এক মৎস্যকন্যাকে দেখতে পাই, সে কিছুদূর অবধি সাঁতারও কেটেছিল আমার পাশে পাশেই’, একদিকে ভাগ করে নিচ্ছেন এমন সব রূপকথার মত অভিজ্ঞতা, পাশাপাশি শেখাচ্ছেন জীবন যুদ্ধে হার না মানার মূলমন্ত্র― ‘নিজেকে কেউ কখনো প্রতিবন্ধী ভাববে না, অক্ষম ভাববে না। আমিও ভাবিনি, ভাবি না।’

সাহসী এই যোদ্ধা লড়াইয়ে ভয় পেয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি এক মুহূর্তের জন্যও। কিন্তু পরবর্তীকালে স্পনসরের অভাবে অধরা থেকে গেছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাগর প্রণালী পার করার স্বপ্ন। ছেলেবেলা থেকে দীর্ঘ সময় জলে থাকার ফলে পাকতন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ছিল, রক্তাল্পতায় ভুগেছেন বরাবর, শেষদিকে ডায়াবেটিস। ২০১৫-এর ২৬শে এপ্রিল মাত্র ৪৬ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণ হয় সাঁতারের ইতিহাসের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের। একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকলতাই মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানানো হয়।এই মহান যোদ্ধার মৃত্যুতে কয়েক মুহূর্তের জন্য শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে সারা শহর। 

আরও পড়ুন
তাস খেলেই দেশে এনেছেন স্বর্ণপদক, এবার অর্জুন পুরস্কারের দৌড়ে দুই বাঙালি

কিংবদন্তি সাঁতারু বুলা চৌধুরী একবার বলেছিলেন ‘মাসুদুর সাঁতারের জগতে একটা দৃষ্টান্ত।’ দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দুর কথায় ‘ও বুঝিয়েছিল, প্রতিভা আর জেদ থাকলে যে কোনো স্বপ্ন পূরণ করা যায়।’

সত্যিই সাঁতারের ইতিহাসে মাসুদুর রহমানের এই সংগ্রামের কাহিনি, জয়ের চিত্র এক অধ্যায় হয়ে থেকে যাবেন। ক্রীড়ার জগতে তিনি সাহস ও মনোবলের অপর নাম। মাসুদুর জীবনে লড়েছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে, লড়েছেন প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে, উত্তাল ঢেউ-এর সঙ্গে। দিনশেষে থেকে গেছে লড়াইটাই, রেকর্ড আর খেতাবগুলো সেই লড়াই-এর একটা লিখিত ইশতেহার মাত্র...

আরও পড়ুন
আন্টার্কটিকার বরফশীতল জলে সাঁতার, উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সাঁতারুর

Powered by Froala Editor