কালো মেয়ের পায়ের তলায়

বছর দশেক আগের কথা। পাড়ার দুর্গাপুজো উদ্বোধনে এসেছিলেন ঝুলন গোস্বামী। এখনও স্পষ্ট মনে আছে তার একটি কারণ ওঁর পাশে পুজো প্যান্ডেলের ভলান্টিয়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল হাইট নিয়ে আমার অল্পবিস্তর অহংকার ধুলায় মিশে গেল এক মুহূর্তে। যদিও তার চেয়েও বেশি করে দিনটা আমার মনে আছে অন্য কারণে। ওই একই দিনে পুজো উদ্বোধনে এসেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী এবং এক জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের নায়িকা। অতিথি হিসেবে ঝুলনই প্রথম এলেন। সুতির পাঞ্জাবি আর পাজামা, পিঠে ব্যাগ। সন্ধের দিকে যখন তিনি এলেন তখন প্যান্ডেলের ভিড় থেকে গুটি কয়েক মানুষ এগিয়ে এসে ডায়রি বাড়িয়ে সই নিচ্ছিলেন। মিনিট পনেরো পর সেই টেলি অভিনেত্রীর আগমন এবং সমস্ত কৌতূহলের কচুরিপানা স্রোত যেন ঝলমলে পোশাকে সজ্জিত নায়িকার দিকে ভেসে গেল এক লহমায়। এমনকি কয়েকজন এগিয়ে রাখা ডায়রি বেমালুম বন্ধ করে ছুট দিলেন। ঝুলনের পাশে দাঁড়িয়ে একা আমি, ভাবছিলাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দশ বছর কাটিয়ে ফেলা একজন ক্রিকেটার কীভাবে মেনে নেবেন এই আদেখলাপনা? শব্দটার ব্যবহার কানে লাগলেও আশা করি পাঠক বুঝবেন যথাযথ শব্দপ্রয়োগে আমি এক্ষেত্রে কার্পণ্য করতে চাই না। অগত্যা বাধ্য হয়েই...

সেলফির যুগ তখনও আসেনি, ডিজিটাল ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি যে মুহূর্তে একটি চাঁদোয়ার মত ঘিরে ফেলল সমান্তরাল পৃথিবীকে, ঝুলন একমনে ছোট্ট ফোনটায় কিছু টাইপ করছেন। সাবলীল। অভ্যস্ত অভিনেতা যেন নিজের চরিত্রেই অভিনয় করছেন। সেই নায়িকা পাশের সিটে এসে বসতেই সৌজন্য বিনিময় সারলেন। রাজ্যের মন্ত্রী এলেন। করমর্দন হল। মঞ্চে দু'চার কথা বললেন ঝুলন, নিয়মমাফিক। ফিরে গেলেন। 

চাকদা থেকে কলকাতার দূরত্ব ঝুলন জানেন। দিন কয়েক আগে ঝুলনের বায়োপিকে অনুষ্কা শর্মাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল দশবছর আগের সেই দিনটা থেকে আজকের দূরত্বও ততটাই। সেদিন টেলিনায়িকা এসেছিলেন, ম্যাটিনি শো সুপারহিট হয়ে ওঠার যে রসদ সেদিন আমরা একমাত্র বলে ধরেছিলাম, দশবছর পরেও একই ভাবে ভাবছি। ঝুলন দেশের কিংবদন্তি ক্রিকেটার হতে পারেন, হতেই পারে তাঁর ঝুলিতে সাড়ে তিনশো আন্তর্জাতিক উইকেট - কিন্তু সিনেমার পর্দায় লালটুকটুকে নায়িকা চাই জনতার। ঝুলনের স্ট্রাগল নিয়ে যে কথন, যে আখ্যান, পর্দায় সেই লড়াই-এর ঘাম চুইঁয়ে নামতে হবে জনপ্রিয়-সুন্দরী নায়িকার গাল বেয়ে। ঝুলন কিংবা ঝুলনের লড়াই সেখানে বিপননযোগ্য কাঁচামাল মাত্র! 

ঝুলনকে তো অভ্যাসে মনে পড়ে না, সৌরভ গাঙ্গুলিকে মনে পড়ে। এমনকি ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে যাওয়ার দিনটাকেও বাঙালি বুকের ব্যথা হিসেবে জমিয়ে রেখেছে স্রেফ সৌরভীয় সুবাসের জোরেই। এই সপ্তাহেই সেই বিশ্বকাপ হাতছাড়া হওয়ার উনিশ বছর পূর্তি হল। ঝুলনকে কীর্তি দিয়ে মনে পড়ে না। মনে পড়ল কারণ মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলছে। মনে পড়ল কারণ গত একবছরে এদেশে সর্বাধিক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গেল। মনে পড়ল কারণ রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রে মহিলা অর্থমন্ত্রীর দেশে নয়জন নিরীহ মহিলাকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিতে দুবার ভাবে না হিংসায় উন্মত্ত রাজনৈতিক গুন্ডারা। ঝুলন বিশ্বকাপ খেলছেন। সম্ভবত জীবনের শেষ বিশ্বকাপ। আটত্রিশ বছরের ঝুলন গোস্বামী নিঃশব্দে খেলে ফেলছেন টুর্নামেন্টটা। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সাদামাটা হলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জোড়া উইকেট তুলে ফিরে এলেন স্বমহিমায়।ছেলেদের ক্রিকেটে উনিশ বিশ্বকাপের পর মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দলে রেখে একটা বিশ্বকাপ খেলানোর জন্য যে আকুতি দেখিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটমোদীরা, তাঁদের সিংহভাগই হয়ত বুঝতে পারছেন না ঝুলন গোস্বামী এবং মিতালি রাজের লড়াই মহেন্দ্র সিং ধোনির চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। দুটো দশক জুড়ে জাতীয় দলের বোলিং ইউনিটকে একা কাঁধে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছেন এই উপমহাদেশের দুজন জিনিয়াস। একজন যদি কপিল দেব হন তো অন্যজন নিঃসন্দেহে ঝুলন গোস্বামী। ক্রিকেটবোর্ড মনে করে না ভারতে পুরুষ ক্রিকেটারদের সমান বেতন মহিলা ক্রিকেটারদের পাওয়া উচিত। একথা প্রকাশ্যে তাঁরা বলেনও। এ-প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ঝুলন নিজেই একবার বলেছিলেন পুরুষ ক্রিকেটাররা যে পরিমাণ রেভেন্যু বোর্ডকে এনে দেন, মহিলা ক্রিকেট থেকে তা আসা সম্ভব হয় না,তাই বেতনের তারতম্য অস্বাভাবিক নয়। ঝুলনের এই কথা আসলে দশ বছর আগের সেই প্যান্ডেলের চেয়ারে বসে থাকা শান্ত ঝুলন গোস্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেয় আমাদের। চাকদা থেকে ভারী একটা কিটব্যাগ বয়ে বয়ে কলকাতা এসে দুবেলা কোনোরকমে টিকে থেকেছেন, টিকে থেকেছেন এমন একটা সময়ে যখন মহিলা ক্রিকেটের ব্যাপ্তি-প্রসার সাধারণ জনমানসে আজকের মত এত বহুল চর্চিত ছিল না। তাই প্রতিকূলতাকে নিঃশব্দে মেনে নিয়েই ঝুলন অভিযোজিত করেছেন তাঁর দর্শনকে। তাই অনায়াসেই তিনি স্বাভাবিক হতে থাকা বাস্তবকে মেনে বলতে পারেন বেতনের অসাম্য নিয়ে তাঁর মত। বাঙালি ঝুলন গোস্বামীকে আজ থেকে চেনে না, ঝুলন 'ঐ ক্রিকেট খেলেন'- জাতীয় তাচ্ছিল্য বহু পরিচিত। দেড় দশকধরেই পরিচিত। 

আরও পড়ুন
যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের অভ্যেস...

ঝুলন গোস্বামী বিশ্বকাপে বল করছেন বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়ে। ২০০৬ সালে যখন সৌরভ-চ্যাপেল তরজা নিয়ে মিডিয়া প্রতিদিন হাজার হাজার নিউজপ্রিন্ট খরচ করত, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের মহিলা ক্রিকেটদল প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতে। ঝুলন গোস্বামী একাই ছারখার করে দেন টনটনের মাঠে, দশটা উইকেট নিয়ে।

আরও পড়ুন
বিভেদের মাংসের টুকরো

সৌরভ গাঙ্গুলি ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালটা জিততে পারেননি। ঝুলনও পারেননি শেষবার ফাইনালে উঠেও বিশ্বকাপ জিততে। এবারেও বিশ্বকাপে তাঁর ফিংগারপ্রিন্ট পড়বে কিনা সে তো সময় বলবে,সামনে কঠিন দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ, কঠিন লড়াই। স্মৃতি-স্নেহ-রিচাদের উজাড় করে দিতে হবে এ অসাধ্য সাধন করতে গেলে। তার মাঝে শুরু হচ্ছে আই পি এল, বিশ্বজয় হলেও আমরা কদ্দূর উচ্ছ্বসিত হব ৩রা এপ্রিল, জানা নেই। 

আরও পড়ুন
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা

কিন্তু সেই বিশ্বজয়ের ট্র‍্যাজেডি কিংবা রোমান্সের বাইরে ঝুলন একটি স্বতন্ত্র পথের হদিশ দিয়ে গেলেন। ফেমিনিজমের চলতি পাঠ থেকে আলাদা, সমানাধিকারের দাবির বদলে সমানাধিকার অর্জনের নিঃশব্দ লড়াই ঝুলন এখনও করে চলেছেন। দীপাবলির অভ্যাস ছাড়া কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখার মোহ আমাদের আচ্ছন্ন করে না কোনোকালেই, ঝুলন গত দেড় বছরে কন্যাভ্রুণ হত্যার বিরুদ্ধে একটা আউটসুইং ছাড়ছেন, কখনও বধূনির্যাতনের বিরুদ্ধে ফেলছেন বিমার, আর আমাদের ঔদাসীন্যের দিকে নীরব বাউন্সার তো রইলই। 

সেদিন প্রথম আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল, আমার হাইট নিয়ে কিঞ্চিৎ কলার তোলার রোয়াব একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। দশ বছর পর, আজ আরেকবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে আমাদের চারপাশের অনেক খর্বকায় মানসিকতাকে আপনি মাথা উঁচু করে আকাশ দেখার একটা সুযোগ করে দেবেন, আমি নিশ্চিত...

Powered by Froala Editor