বিভেদের মাংসের টুকরো

কী গুমোট একটা ফেব্রুয়ারি মাস। দমবন্ধ হয়ে আসছে। পলাশ ফোটার মরশুম। অথচ মৃত্যু যেন দু'দণ্ড শোকপ্রকাশের বিরতিও দিতে চাইছে না। ভাইরাসের মতো মৃত্যুরও কি একটা অভিযোজন হল? সে হাসতে হাসতে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আমাদের ক্রমশ ক্লিশে হতে থাকা শোকপ্রকাশের ভণিতাকে? লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar), সন্ধ্যা মুখার্জি (Sandhya Mukhopadhyay), বাপ্পি লাহিড়ী (Bappi Lahiri), সুরজিৎ সেনগুপ্ত (Surajit Sengupta)— নাম চারটে লিখত লিখতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতা মনে পড়ছিল।

'যখন
একসঙ্গে হাত মুঠো ক'রে দাঁড়াতে পারলেই আমরা সব কিছু পাই—
তখন
বিভেদের একটুকরো মাংস মুখে ধরিয়ে দিয়ে
চোরের দল
আমাদের সর্বস্ব নিয়ে চলে যাচ্ছে।'

সর্বস্ব-আসলে সময়। সময়ই সব। বাংলার ত্রস্ত নীলিমা থেকে কমে আসে নীল। বাংলাদেশের শরীর জুড়ে বয়ে যায় ফুলেশ্বরীর জল। আজান কিংবা শাঁখের সুর থেকে আচমকা পুলিশের বুটের শব্দে পর্দা নেমে আসে মঞ্চের। দেশভাগ হয়। সময় ভেঙে টুকরো হয় র্যাথডক্লিফ লাইনে। ভারতবর্ষ বলে সে সময়ে যে ভূখণ্ডকে চিহ্নিত করা হল, সে যেন একতাল মাটি। অবয়বহীন। পাঁচের দশকের গোড়ায় হিন্দি ভাষায় সিনেমা আর গানকে খাটো নজরে দেখছে জনতা। চটুল বিলাসিতা। লতা মঙ্গেশকর কত বড় শিল্পী, সে বিচার করবে ভবিষ্যৎ, কিন্তু এক সাদামাটা শাড়ি, কপালে টিপ, মঞ্চে প্রণাম করে উঠে আসা অবয়বের রিনরিনে অথচ শাণিত ফলার মতো ধারালো কণ্ঠ এই ভাবনাকে ঐ সময়টায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। ধুয়ে দিল যমুনার জলে। ওই নদী, ভারতের আইডেন্টির প্রথম তরী ভাসল জলে। পাশ্চাত্যের গায়িকাদের সামনে ভারতীয় নারীর অপাপবিদ্ধ গলাই কেবল নয়, ঐ আটপৌরে আখ্যানটিকে সদ্যজাত জাতি পেল অবয়ব হিসেবে। 'ইঁহা আনা না দোবারা' থেকে 'কোই হাসিনা কদম পহেলে বাড়াতে নেহি'— লতা নির্মাণ করলেন এক সামাজিক দৃষ্টিকে, যার বিনির্মানের পথ পরে আশা, গীতা দত্তরা করবেন। কিন্তু, সদ্যোজাত জাতির বুকে দাঁড়িয়ে এ নির্মাণের কণ্টকাকীর্ণ পথে লতা রক্তাক্ত হয়েছেন বারবার, অধ্যাবসায়ের চাবুক সবার অলক্ষ্যে তিনি সারাজীবন নিজের পিঠে আছড়েছেন। তাই এ দেশের কোণায় কোণায় জাতীয় পতাকা, পোস্ট কার্ড ছাড়া এক ও একমাত্র লতা মঙ্গেশকর পৌঁছেছেন। শূন্য থেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার লড়াই কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার চেয়ে কম কিছু না। ভিন্ন পথ ও ভিন্ন মতের সাযুজ্যের বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখা আশু প্রয়োজন। তাঁর মৃত্যুর পর শুরু হল সাভারকর-লতা ও ডানপন্থা নিয়ে গুঞ্জন, কালক্রমে তা আছড়ে পড়ল সোশ্যাল মিডিয়ায়। উল্টো শিবির থেকে চব্বিশ ঘণ্টা কাটার আগেই এল শাহরুখের ফুঃ বিতর্ক! হায় রে দেশ! হায় রে মৃত্যু! 

লতার জীবন শিষ্টাচার আসলে এক সময়ের শিক্ষা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে যাওয়ার আগেই যেমন বিতর্কের কেন্দ্রে পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান, মৃত্যুর পরেও তাই। মৃত্যু আমাদের আর স্মৃতির কাছে জিরোতে দেয় না আজ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বললেই যে সাদাকালো সময়টা আমাদের চোখে আসে, লোডশেডিং-এর বাংলায়, পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপে চোখ রাখা মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে, রেডিও-বায়োস্কোপ-হ্যারিকেনের শহরে মায়াভরা চাঁদ হয়ে নেমে আসা কিছু গান, মায়াবী নায়ক-নায়িকার ভেসে যাওয়া রোম্যান্সের সেই মায়াবিনী রাত— সবটুকু স্মৃতিকে বয়ে বয়ে চলছে কয়েকটা গান। বাঙালির একান্ত নিজস্ব কিছু ফিরে আসার জায়গা, কিছু বিশ্বস্ত কুঠুরি সন্ধ্যা নির্মাণ করে গেছেন— এ কথা অস্বীকারের জায়গা নেই। সঙ্গীত অ্যাকাডেমির কোনো একটি আড্ডা বা অনুষ্ঠানে ঘরোয়া পরিবেশে গান গাইলেন সন্ধ্যা। রাতে, বাড়ি ফেরার সময়, সুমন যখন তাঁকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন, অশীতিপর শিল্পী সেই মাঝবয়সী গায়কের হাত ধরে বলে ওঠেন— 'অন্তরার সুরটা, ঠিকঠাক লাগল না, তাই না? '

আরও পড়ুন
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা

এ হল সময়ের শিক্ষা। নিজেকে শান্তভাবে প্রশ্ন করার শিক্ষা। যা সন্ধ্যা নিয়ে চলে গেলেন বহুদূরে। আমাদের হাতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই 'বিভেদের মাংসের টুকরো'! 

আরও পড়ুন
পুরস্কার, বঞ্চনা ও ‘তুলসীদাসী’ নিয়তি

সত্তরে ভেঙে গেল যুক্তফ্রন্ট সরকার। অজয় মুখোপাধ্যায় দিশেহারা। বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন। নকশালবাড়ির আগুন ছড়াচ্ছে দক্ষিণবঙ্গেও। বরানগর, ডানলপে লাশ পাওয়া যাচ্ছে ভোরের দিকে। কলকাতায় মাঝে মাঝে কার্ফিউ। আলো নিভে আসে। ছিটকে বেরোন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। রেডিও কমেন্ট্রিতে দুলে ওঠে হুগলি নদীর দু-পাশের ফুটবলপাগল জনতা। সাতের দশকের গোড়ায় বাঙালি যে তারকারা এলেন, সুরজিৎ ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী এই কারণেই, কারণ সাতের দশকে বাংলা যে উত্তাল সময়টা ডিঙোচ্ছিল সেখানে সুরজিৎ আনতে পেরেছিলেন আচমকা ড্রিবলের মত বিস্ময়, এমার্জেন্সি অবস্থা কেটে যাওয়ার প্রগাঢ় কোনো বিশ্বাস। ময়দান দেখছে এক বাঙালিকে, মাছেভাতে বাঙালি স্রেফ ড্রিবল করে, টার্ন মেরে ছিটকে দিচ্ছে পাঞ্জাবি ডিফেন্ডারদের। কর্নার ফ্ল্যাগ থেকে বলকে ঠেলে দিচ্ছেন জালে, ময়দান দেখছে অলিম্পিক গোল, প্রথমবার। তেউনি পরে ছেলে এসে বসছে সুরো-র ড্রিবলের টানে, বিড়ির টান দিতে দিতে বাঙালির থমথমে আকাশে জ্বলে উঠছে নক্ষত্রের আলো। সুরজিৎ সেনগুপ্ত-র মৃত্যু এই সময়টাকে নিয়ে চলে গেল, এই রাতের আকাশে তারা গোনার মতো করে পেরিস্কোপে চোখ রেখে বাঙালির ফুটবল ভালবাসার সময় পিয়ারলেস হাসপাতালের বাইরে, পড়ন্ত বেলার রোদের পাশে পড়ে রইল। 

আরও পড়ুন
এ যদি আমার দেশ না হয়, তো...

'রোতে, হাঁসতে, বাস ইঁউহি তুম, গুনগুনাতে রেহনা...'— এতগুলো মৃত্যুর পরপর এসে পড়াও আমাদের মৌন করতে পারেনি। শোক করতে পারেনি বিহ্বল। কাভি আলভিদা না ক্যাহেনা-র মতো আশাবাদও ছুঁয়ে যাচ্ছে না। বাপ্পি লাহিড়ী কী অবলীলায় হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছেন দূরে৷ এত হাসি, এত আলো আলো রোদ, জমকালো চাঁদের ভেলা পৃথিবীর ঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সেদিন রাতে কে একজন পোস্ট করলেন— 'বাপ্পি লাহিড়ী বড় ওভাররেটেড সুরকার'— মৃত্যু পরবর্তী কিসসায় এসব দেখে সরোজদা বলল— 'মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থাকাটাই ওভাররেটেড'।

সত্যিই। এত বিদ্বেষের মাঝে মনে হয়, বেঁচে থেকে এমন বিরাট কোনও সমাজ আমরা প্রস্তুত করতে পারছি না যা রেখে যাওয়া যাবে উত্তরপ্রজন্মের জন্য। বেঁচে থাকার এ দৈনন্দিন উদযাপন তাই ওভাররেটেডই বটে। অথচ আমরা দেখছি৷ একটা সময়ের সমস্ত শিক্ষা, চিহ্ন, স্মৃতি একটু একটু করে চলে গেল আমাদের সামনে থেকে। এ চলে যাওয়া আমাদের ভাবতে শেখাল না কিছুতেই। শেখাল না শোকপ্রকাশের শিষ্টাচার।

'একসঙ্গে হাত মুঠো করে দাঁড়াতে পারলেই আমরা সব কিছু পাই—'

পেতাম। হয়ত পেতাম। তবু, আমাদের সর্বস্ব নিয়ে চলে গেল সময়।

হাতে পড়ে রইল— বিভেদের মাংসের টুকরো।

Powered by Froala Editor