কলকাতায় জন্ম নিল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’, মুখোমুখি মোহনবাগান; কী ছিল সেই ম্যাচের ফল?

২৫ জুলাই, ১৯৭১। তারিখটা দেখলেই বোঝা যায় বাংলার রাজনীতি তখন উত্তাল। পশ্চিমবঙ্গ নয়, কাঁটাতারের সীমানার দুদিকেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখছে তরুণ প্রজন্ম। ঠিক এই সময়ে কৃষ্ণনগরের নদীয়া স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে একটি ফুটবল ম্যাচ। একদিকে নদীয়া জেলা একাদশ, আর অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। বাংলাদেশের এই জাতীয় দলটির প্রথম ম্যাচ সেটি। কৃষ্ণনগরে তখন দুই বাংলার উত্তাল সময়ের আঁচ এসে পড়েছে। আর তাই এই অভিনব ম্যাচ দেখতে ভিড় করেছেন বহু মানুষ। গ্যালারি ভর্তি হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। কেউ উঠেছেন গাছের ডালে, কেউ আবার গ্যালারির ছাদে; প্রত্যেকের চোখেমুখে উত্তেজনা। খেলার ফলাফলে কেউ জিতবে, কেউ হারবে। কিন্তু অপেক্ষা কারোর পরাজয়ের নয়। অপেক্ষা এক মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলার।

কিন্তু বহু প্রতীক্ষিত সেই ম্যাচ শুরুর আগেই দেখা দিল এক জটিলতা। বাংলাদেশ তখন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে নিজেকে স্বাধীন দেশ বলে ঘোষণা করেছে। অথচ স্বাধীনতার স্বীকৃতি তখনও মেলেনি। খাতায় কলমে তখনও সেটি পূর্ব-পাকিস্তান। কিন্তু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের দাবি, তাঁদের স্বাধীন দেশের ফুটবল দলের মর্যাদা দিতে হবে। আর তাই তাঁরা খেলা শুরুর আগে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। বাজাতে হবে দেশের জাতীয় সঙ্গীতও। কিন্তু স্বীকৃতি না পাওয়া একটি দেশের পতাকা বিদেশের মাটিতে উত্তোলন করা হতে পারে কীভাবে? প্রশাসনিক কর্তারা পড়লেন ফাঁপরে। অথচ গ্যালারির জনতা সমানে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন খেলা শুরু করার। জেলা শাসক দীপক কান্তি ঘোষের মনের মধ্যেও তখন বেজে উঠেছে বাঙালি আবেগের সুর। নিজের দায়িত্বে তিনি পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর অনুমতি দিলেন।

নদীয়া স্টেডিয়ামে সেদিন লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। বেজে উঠল দুই বাঙলার বাঙালির মনের মধ্যে তোলপার করা সুর, ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলাদেশের বাইরে সেই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন বাংলার একদল দামাল ছেলে। অবশ্য খেলার ফলাফলে ২-২ গোলে ড্র হল। আর তারপরেও এই ঘটনার জল গড়িয়েছিল বহুদূর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ভারত সরকারের নৈতিক সমর্থন থাকলেও এমন বে-আইনি কাজে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সরকার। দীপক কান্তিকে পদ থেকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু তাতে ইতিহাসের চাকাকে কোনোভাবে থামিয়ে দেওয়া যায়নি।

মুক্তির লড়াইতে যখন বোমা-পিস্তল এবং বন্দুক তুলে নিচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, তখন লড়াইয়ের এক বিকল্প অস্ত্র বেছে নিলেন কয়েকজন। আর সেই অস্ত্রের নাম ফুটবল। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হল বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি। তবে এই সংগঠনও তৈরি হয়েছে কলকাতার মাটিতেই। ফুটবল ছাড়াও অন্যান্য খেলার দল তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও সেটা আর সম্ভব হয়নি। সমিতির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশন। পার্ক সার্কাসের মাঠে শুরু হল অনুশীলন। সমিতির লক্ষ ছিল মূলত তিনটি। ১) স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়া, ২) তহবিল সংগ্রহ ও ৩) পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে পাকিস্তান সরকার ঢাকায় কোনো টুর্নামেন্ট যেন আয়োজন না করতে পারে।

স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দলের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল ৮ আগস্ট। বিপক্ষ দলের নাম মোহনবাগান। এদিকে নদীয়ার ঘটনার পর এই ম্যাচ নিয়ে চিন্তিত মোহনবাগান কর্তারা। কিন্তু অধিনায়ক চুণী গোস্বামী খেলার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কি এতটুকু সাহায্য করতে পারে না মোহনবাগান? শেষ পর্যন্ত নাম পরিবর্তন করে গোষ্ঠপাল একাদশ নামে মাঠে নামলেন তাঁরা। ফলাফলে অবশ্য গোষ্ঠপাল একাদশই জিতল ৪-২ গোলে। কিন্তু এরপর ১৪ আগস্ট কলকাতা স্পোর্টিং একাদশকে ৪-২ গোলে পরাজিত করল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। সেই ম্যাচে আরেকবার বিপাকে পড়ল প্রশাসন। দিনটা পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আর তাই এইদিন রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর আগে নিজেদের পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি পাকিস্তানের পতাকা পদদলিত করে পুড়িয়ে দিলেন খেলোয়াড়রা।

এরপর নরেন্দ্রপুর এবং তারপর বাংলার বাইরে মুজঃফরপুর, পূর্ণিয়া, বেনারস, মুম্বই – জয়পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি স্বাধীন বাংলাদেশ ফুটবল দল। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুম্বই স্পোর্টস ইক একাদশের বিরুদ্ধে খেলাটি। বাংলাদেশ দলের খেলার প্রশংসা জানানোর পাশাপাশি তহবিলে বিপুল অর্থ দান করেন অভিনেতা দিলীপ কুমার, ক্রিকেটার পতৌদি এবং মুম্বই গভর্নর। এরপর কথা ছিল দিল্লি যাওয়ার। কিন্তু তার আগেই এল সেই বহু প্রতিক্ষিত সংবাদ। বাংলাদেশ থেকে ডাক এল বিজয় দিবসের। দিল্লি না গিয়েই ফিরে যেতে হল সবাইকে।

আরও পড়ুন
‘জেল না-খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী’ গোষ্ঠ পাল; ব্রিটিশদের অন্যায়ের প্রতিবাদে ছেড়েছিলেন ফুটবলও

এরপর ৪৯ বছর কেটে গিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন সব খেলাতেই ক্রমশ উন্নতি করে চলেছে। আর সেই অগ্রগতির পিছনেই থেকে গিয়েছে জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের লড়াইয়ের কাহিনি। কিন্তু তবুও এত বছরেও সরকারের পক্ষ থেকে মেলেনি কোনো স্বীকৃতি। ২০১৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য দলের নাম মনোনীত হলেও পরে বাতিল করা হয়। শোনা যায় বঙ্গবন্ধু নাকি এই দলকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর বড়ো ছেলে শেখ কামাল একদিন সইদুর রহমান প্যাটেলকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের জন্য শুভ সংবাদ আসতেছে।’ কিন্তু এর পরেই বঙ্গবন্ধু খুন হলেন। আজও সেই শুভ সংবাদের জন্য আশায় বুক বেঁধে আছেন মুক্তিযুদ্ধের অবহেলিত যোদ্ধারা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More