এমন অদ্ভুত ঘটনা কস্মিনকালেও দেখেননি কলকাতার দর্শক। ক্যালকাটা ক্লাবের সঙ্গে খেলা চলছে মোহনবাগানের। ১৯৩৫ সাল। ঘেরা মাঠের দুপাশ ভিড়ে ঠাসা। ব্রিটিশ টমটম গাড়ি আর ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে পিছন দিকে। কিন্তু খেলা চলাকালীন হঠাৎ-ই মোহনবাগান খেলোয়াড়রা সটান শুয়ে পড়লেন মাঠের মধ্যে। রেফারি অবাক। কিন্তু কেন এমন অদ্ভুত ভঙ্গি?
রেফারি ক্লেইটন ম্যাচের শুরু থেকেই ব্রিটিশ দলের পক্ষে নানা সিদ্ধান্ত দিচ্ছিলেন, যা মেনে নিতে পারছিল না মোহনবাগান খেলোয়াড়েরা। এমনই একের পর এক পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন মোহন অধিনায়ক, যিনি কোনোদিন আপস করেননি ব্রিটিশদের সঙ্গে। তাঁরই কথায় এমন অভিনব প্রতিবাদ জানালেন মোহন খেলোয়াড়েরা। ফলস্বরূপ শাস্তির খাঁড়া নেমে এল তাঁর ওপর, আর সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলকেই চিরবিদায় জানিয়ে চিরকালের মতোই একবার ব্রিটিশ দম্ভকে টলিয়ে দিলেন তিনি। হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নন, ভারতীয় ফুটবলের দ্যা চাইনিজ ওয়াল, গোষ্ঠ পাল...
'চৌধুরী' পদবিটা ব্রিটিশদের দেওয়া উপাধি। কিন্তু কখনো তা ব্যবহার করেননি তিনি। বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার ভোজেশ্বর গ্রামের গোষ্ঠ বিহারী ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন ফুটবল পাগল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলার জন্য প্রাথমিকভাবে যে বিশাল শারীরিক শক্তির দরকার, তা যেন কিছুটা স্বয়ং ফুটবল ঈশ্বরই দিয়েছিলেন গোষ্ঠ পালকে। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে যখন মাত্র ১১ বছর বয়সে ফুটবলের আঁতুরঘর কলকাতায় একটি ক্লাবে সুযোগ পান, তার কয়েকবছর পরেই মোহনবাগান আই এফ এ শিল্ড জিতল। কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল ফুটবল আরও বেশি করে। নাগরিকতার সোপান হিসেবে উঠে এল ফুটবল, স্বদেশি আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠে এল ফুটবল। ১৯০৭ থেকে ১৯১২, পাঁচ বছর কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলে নজর কাড়লেন গোষ্ঠ। তার বিশাল চেহারা ও ভয়ংকর ট্যাকল ব্রিটিশদলগুলোর বিপক্ষে যে বড়ো হাতিয়ার হতে চলেছে, তা বুঝতে পারছিলেন কলকাতার ফুটবল কর্তারা। ১৯১২ সালে গোষ্ঠ পালের পা পড়ল মোহনবাগান তাঁবুতে। হ্যাঁ, সেই মোহনবাগান তাঁবুতেই একের পর এক ইতিহাসের গল্প খোদাই করলেন গোষ্ঠ, যার স্মারক হিসেবে আজ মোহনবাগানের ক্লাব তাঁবুর রাস্তাটিরই নাম তাঁর নামে।
"ট্রফি পাওয়ার কথা যত না চিন্তা করসি, সাহেব গো হারাইমু কী কইর্যায সেই চিন্তাই তখন বেশি করসি। ট্রফি পাই নাই বইল্যা আমাগো কষ্ট নাই..."- কী অদ্ভুত, ২৩ বছর সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পরেও গোষ্ঠ পালের হাত ধরে কোনোদিন বড় ট্রফি জেতেনি মোহনবাগান। কিন্তু তবু আজ, প্রায় দেড় শতাব্দী পরেও কেন গোষ্ঠ পাল প্রাসঙ্গিক?
বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা দ্যা ইংলিশম্যানে একবার ব্রিটিশ সাংবাদিক লিখতে বাধ্য হলেন- "Gostha imapignable as the Chinese wall", এবং একজন বাঙালির লৌহকঠিন দুটো খালিপায়ে থমকে যাচ্ছে ব্রিটিশ বুট, এই রূপকথাটা সিনেমার পর্দায় নয়, বাস্তবের মাটিতে প্রায় পঁচিশ বছর দেখেছে কলকাতা ময়দান। ঐ ব্রিটিশ সাংবাদিক তাই লজ্জায় নিজের নামও ব্যবহার করলেন না প্রতিবেদনে, ছদ্মনাম 'রেডরোজ' দিয়েই লিখলেন নিবন্ধটি।
গোষ্ঠ পালের কলকাতা আগমনের পর মোহনবাগান দল ক্রমশই ব্রিটিশ দলগুলির বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই দিতে শুরু করে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ দলকে হারালেও কলকাতার বুকে খেলে বেড়ানো নর্থ স্ট্যাফোর্ড, মিডলসেক্স, লিস্টার্স, হাইল্যান্ড ইনফ্যান্টির মতো বিলিতি দলকে প্রথম কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে গোষ্ঠ পালের বাগান। দুপায়ে গোলার মতো শট, নির্ভয় ট্যাকলিং আর হিমশীতল মেজাজে গোষ্ঠ পাল যেভাবে ব্রিটিশদের কড়া জবাব দিতেন, তাতে শুধু ফুটবল মাঠ নয়, বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছিল তৎকালীন সমাজেও। কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের আনাচেকানাচে তখন একটা জীবন্ত বিপ্লবের নাম হয়ে উঠলেন গোষ্ঠ পাল। অনেকবছর পর গোষ্ঠ পালের পুত্র নীরাংশু পাল বলছিলেন - বাবা ছিলেন জেল না-খাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী। ফুটবল পায়ে যে ব্রিটিশদের পিছু পা করে দেওয়া যায় এ বিশ্বাস ধারাবাহিকভাবে বাঙালির রক্তে মিশিয়ে দিলেন গোষ্ঠ। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতির ময়দানে না নামলেও খেলার ময়দানে গোষ্ঠ যে উন্মাদনা গড়ে তুলেছিলেন তা যে পরোক্ষভাবে স্বদেশি রাজনীতিতে একটা বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিল তা বলার অবকাশ রাখে না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গোষ্ঠ পালের খেলা দেখতে এসেছিলেন একবার। সে সময়ে মোহনবাগানের সভাপতি ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু, যিনি পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসেরও সভাপতি হন। খেলার শেষে গোষ্ঠ পাল ভূপেনবাবুকে ডেকে বলেন- "আপনারা আর সুভাষের সাথে ঝগড়া কইরেন না, ও থাকলে স্বাধীনতা পেতে সুবিধা হইব..."
আরও পড়ুন
১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের কাহিনি ঠাঁই পাচ্ছে পাঠ্যপুস্তকেও
সুভাষ আর গোষ্ঠ পাল ছিলেন সমবয়সী। তবু প্রত্যক্ষ সখ্য গড়ে ওঠেনি। তবে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ ছিলেন গোষ্ঠ পালের একান্ত অনুগামী। গোষ্ঠপালই প্রথম ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে দল নিয়ে সিংহল যাত্রা করেছিলেন যা সেই সময়ে ছিল প্রায় অকল্পনীয়। রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাই স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবার পরই পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন গোষ্ঠ পালকে। কলকাতার অভিজাত মহলে গোষ্ঠ পাল বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ছিল মধুর সম্পর্ক। গোষ্ঠ পালের ফরিদপুরের বাড়িতে পা রেখেছিলেন স্বয়ং গান্ধীজি!
ব্রিটিশদের চিরকাল ঘৃণা করে আসা গোষ্ঠ পাল যে কতখানি মনে প্রাণে বাঙালি ছিলেন, তা বোঝা যায় পদ্মশ্রী পুরস্কারের মঞ্চে। সকলে যেখানে গলাবাঁধা কোট পরে, গোষ্ঠ পাল গেলেন ধুতি পাঞ্জাবিতে। সদর্পে জানালেন এই পোশাকেই তিনি পুরস্কার নেবেন। মোহনবাগান মাঠে ব্রিটিশদের তৈরি গ্যালারিতে বসতেন না গোষ্ঠপাল। এই স্বজাতি ও স্বদেশচেতনা যেন গোষ্ঠ পালের মধ্যে দিয়েই ছড়িয়ে পড়েছিল ফুটবলের প্রাঙ্গণে। একটিও ট্রফি না জিতেও তাই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অধ্যায়টির নাম গোষ্ঠ পাল, যাঁর হাত ধরে ব্রিটিশ জগদ্দল ঠেলে উঠে এসেছিল কলকাতার ময়দান, তবু আজ ভাবতে অবাক লাগে বহু ফুটবল শিক্ষার্থী গোষ্ঠ পালের নামটুকু জানেন না, এ নিয়ে দুঃখ করেছিলেন তাঁর পুত্র। তাঁর বহু কষ্টার্জিত পদক, খেতাব হারিয়ে যায় এই কলকাতারই বুক থেকে, বাঙালির আধুনিক ফুটবলের ইঁট গাঁথার পরেও চিনের প্রাচীর দিনশেষে অনেকাংশেই হয়ত বিস্মৃত, নামে আছেন, চেতনায় ক্রমশ ফিকে হয়ে গেলেন...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু