ময়দানি প্রেমের প্রথম দিনগুলি

ওরা বাল্যবন্ধু নাকি ‘ব্যঙ্গবন্ধু’! ব্যঙ্গ করায় তারা যেন ‘গুপ্ত কবি’কেও ছাপিয়ে যেত। একদিন পিন্টু তো সরাসরি ঘা দিয়ে বসল। ‘তোরা খালিপায়ে খেলে ব্রিটিশদের হারিয়েছিলি, কিন্তু আজকাল ভাস্কোকেও হারাতে পারিস না। পরেরবার জাতীয় লিগে তোদের সঙ্গে দেখা হবে না। তোদের অবনমন কনফার্ম।’ অ-ব-ন-ম-ন শব্দটা পাঁচ অক্ষরের গালাগালির মতো শোনালেও রা করতে পারিনি। কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য আরও অনেক ইস্টবেঙ্গলি বন্ধুও ছিল। তাদের কাছ থেকে খোঁটা খেতে খেতে হামেশাই পেট ভরে যেত। বিশেষ করে সে-বছরটা তো বটেই। রাস্তায় আমাদের দেখা পেলেই ব্যস! শুরু হয়ে যেত ভাঙা টেপরেকর্ড বাজানো― ‘তোদের ছিল শিবদাস, আর এখন হরিদাস’। যা শুনে মনে হত, স্বেচ্ছায় বধিরত্ব নিয়ে নিই। তবে, কালাও খুঁজে ফেরে ‘মোহন-রতন’। হ্যাঁ, সম্মান নামক রত্নের খোঁজেই আমার প্রিয় দল, মোহনবাগানের খেলা দেখতে প্রথমবার মাঠে গিয়েছিলাম। 

ময়দানে কান পাতলে শোনা যায়, প্রিয় দল যখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তখন অধিকাংশের প্রথমবার মাঠমুখো হওয়ার গল্প। সচরাচর এমনটাই দেখা যায়। কিন্তু আমার গল্পটা অন্যরকম। ২০০৫-এর মে মাসের কথা। সে-বছর ন্যাশনাল ফুটবল লিগে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগানের পারফরম্যান্স রীতিমতো হতাশাজনক ছিল। কোনো কিছুই ঠিকঠাক চলছিল না ‘আদরে’র সবুজ-মেরুন দলের। জেতা ভুলে গিয়ে দল যেন হার এবং ড্রকেই নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল। ফলস্বরূপ যা হবার তা-ই হল। দল পড়ে গেল অবনমনের চোখরাঙানিতে। এর আগে, ২৪ এপ্রিল, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের কাছে ০-১ গোলে হেরে গেছে মোহনবাগান। আত্মবিশ্বাস তলানিতে থাকা অবস্থায় এপ্রিলের শেষ দিনে জেসিটির সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে আবারও মাস্ট উইন ম্যাচে পয়েন্ট খুইয়েছে সবুজ-মেরুন বাহিনী। এর পাঁচদিন পর টালিগঞ্জ অগ্রগামীকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দল কিছুটা তাজা বাতাস পেয়েছে। এরপর ছিল সেই ম্যাচ, যে ম্যাচে আমি প্রথমবার মাঠে গিয়েছিলাম প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটাব বলে। কারণ, মোহনবাগানকে অবনমন এড়াতে গেলে চার্চিল ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে হয় জিততে বা ড্র করতে হত। হারা চলত না কোনোভাবেই। অন্যদিকে, চার্চিলও সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল না। তাদের মোহনবাগানের সঙ্গে জেতা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। সুতরাং হারলে তো কোনো কথাই নেই, নিদেনপক্ষে ড্র করেও অবনমন ঠেকাতে পারত না গোয়ার এই ফুটবল টিম। এমন পরিস্থিতিতে চার্চিলের ছেলেরা যে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বাড়তি উজ্জীবিত হয়েই মোহনবাগানের সঙ্গে খেলতে নামবে, তা নতুন করে বুঝিয়ে দিতে হবে না। তাই মোহনবাগানের পক্ষে চার্চিল ম্যাচটি সহজ ছিল না।

অমল দত্ত

 

দুরুদুরু বুকে ব্রহ্মমুহূর্তের আগে, মানে ম্যাচের আগে থেকেই হঠাৎ করেই আমাদের, মোহনবাগানিদের শরীরের ভাষা অনেকটাই ফিরিয়ে দিয়েছিল টালিগঞ্জ ম্যাচটা। সেই টালিগঞ্জ অগ্রগামীর ক্লাবের সর্বময় কর্তা মন্টু ঘোষ আসর জমিয়ে দিয়েছিলেন। মোহনবাগানের সঙ্গে ম্যাচের আগে সাংবাদিকদের তিনি সবুজ-মেরুনের ‘অবনমন’ প্রসঙ্গে জানিয়ে দিলেন, সবার আগে বাংলার ফুটবলের স্বার্থের কথাটা ভাবা প্রয়োজন। এরপরই বাজারে রটে গেল, মোহনবাগানের বিরুদ্ধে পয়েন্ট ছাড়তে চলেছে টালিগঞ্জ। এই নিয়ে তখন রীতিমতো যাকে বলে হইচই চলছে। এবার একটু ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করি। আমি যাকে ‘কোচ’ বলি, তখনো আলাপ না হওয়া সেই ফুটবল গবেষক শুভ্রাংশু রায়ের মুখে পরে একটি ভারী মজার গল্প শুনেছিলাম। শুভ্রাংশুদা টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গে ম্যাচের দিন বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। মোহনবাগান সেদিন তছনছ করে দিচ্ছিল টালিগঞ্জ রক্ষণকে। শুভ্রাংশুদা বলেছিল― ‘‘পরিষ্কার মনে আছে মোহনবাগান যখন প্রথম গোলে এগিয়ে গেল, গ্যালারি থেকে একজন সমর্থক বলে উঠেছিলেন ‘জয় মন্টু’। ব্যাপারটা বোঝ!” শুনে এখন হাসি পেলেও তখনকার পরিস্থিতিটা কিন্তু এতটাও সহজ ছিল না। কারণ পয়েন্ট খুইয়ে খুইয়ে ক্লান্ত সবুজ-মেরুন দল দু-বার মোহনবাগানকে জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন করানো কোচ বাবলুদা ওরফে সুব্রত ভট্টাচার্যকে সমস্ত ব্যর্থতার দায় দিয়ে অপসারিত করেছে। বদলে কোচ হয়ে গোষ্ঠ পাল সরণির ক্লাবটিতে এসেছেন বর্ষীয়ান অমল দত্ত। মোহন জনতার কাছে তখন স্বপ্নের ‘পাইলট’ অমল দত্তই। জাতীয় লিগের অবনমনের বৈতরণি পার হবে টালিগঞ্জ অগ্রগামীকে তিলতিল করে তৈরি করা অমল দত্তের হাত ধরেই, এমনটাই হয়ে উঠেছিল কার্যত শেষ আশা। সবুজ-মেরুন কর্তা বলরাম চৌধুরি সে-বার দল করেছিলেন। লিগে মোহনবাগান হুমড়ি খেয়ে পড়ার পর শাপশাপন্ত কেবল বাবলু ভট্‌চাজই নয়, শুনেছিলেন বলরামও। ক্লাব তাঁবুর বাইরে তখন বিক্ষোভ জানাতে নিয়মিত হাজির থাকতেন ভারী সংখ্যক সমর্থকরা। কিন্তু অমল দত্ত নামটাই পরিবেশটা বদলে দেয়। প্রায় সব হারানো মোহনবাগান যেন মোকাম ফিরে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়। স্বপ্ন দেখানোর কারিগর তখন একজনই— অমল দত্ত।

আরও পড়ুন
শতবার্ষিকী স্মরণে : প্রোফেসর এইচ- বি- বি- ২

বেটো। ছবি সৌজন্য: ফুটবলারের ফেসবুক পেজ

 

আরও পড়ুন
বিভেদের মাংসের টুকরো

দুঃসময়ে যদি দলের পাশে দাঁড়াতে না পারি, তবে কবে দাঁড়াব! এমন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রিয় দলকে সাপোর্ট করতে প্রথমবার মাঠে গিয়েছিলাম। ম্যাচের দু-দিন আগে কেলো আমার জন্য টিকিট কিনে এনেছিল। ম্যাচের দিন সকালেই কেলো, বাপ্পা, উত্তমদা, ভাগ্নেরা মিলে একটা ম্যাটাডোর ঠিক করে ফেলল। তাতে করেই যাওয়া হবে সল্টলেক স্টেডিয়াম। প্রথমবারের জন্য মাঠে যাওয়ার সময় শুনেছি অনেকের বাড়িতে ‘কিন্তু কিন্তু’ থাকে। আমি কিন্তু বাড়ির কোনো বাধা পাইনি। বাবাও যে কট্টর মোহনবাগানি। যাই হোক, দুপুর দুপুর রওনা দিলাম। ম্যাটাডোরে জনা কুড়ি মোহন সৈনিক উঠল পাড়া থেকেই। কারোর হাতে সবুজ-মেরুন পতাকা, কারোর হাতে জাতীয় পতাকা, কেউ-বা ব্যানারে লিখেছে: ‘উঠবে কেতন উঠবে স্লোগান / জিতবে কারা মোহনবাগান’। বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে উত্তর কলকাতার শীলস গার্ডেন লেন থেকে স্টার্ট দিল ম্যাটাডোর। আমাদের গাড়ি যখন তেলেঙ্গাবাগান ক্রস করছে, জনা পাঁচেক সবুজ-মেরুন জার্সি পরা অসমবয়সি মানুষ হাত দেখালেন। আমাদের ম্যাটাডোরেই উঠলেন তাঁরা। বেশ চাপাচাপি করেই মাঠে পৌঁছেছিলাম। তবে একটা কথা, তখন কাঁচা বুদ্ধিতে টের পায়নি, এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারি দলটার নাম মোহনবাগান বলেই হয়তো পয়েন্ট টেবিলের অনেকটাই তলানিতে থাকা একটা দলকে নিয়ে এতটা উন্মাদনা থাকতে পারে। 

আরও পড়ুন
নেতাজির সঙ্গে দেখা হল না

যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। ছবি: আন্তর্জাল

 

দিনটি ছিল বুধবার। ১৮ মে। আমরা দু-নম্বর গ্যালারির সেকেন্ড টায়ারে ছিলাম। খেলা শুরুর আগে আকৃষ্ট করেছিল সবুজ গালিচার মতো মাঠে দুই দলের ফুটবলারদের ওয়ার্ম আপ। দর্শকরা তখন থেকেই প্রিয় দলের ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। অবশেষে প্রায় ২০ হাজার দর্শকের চিৎকারে খেলা শুরু হল। দুর্দান্ত শুরু করে বাগান। আক্রমণাত্মক ফুটবলের নমুনা রেখে ১৯ মিনিটে গোল পায় মোহনবাগান। গোল করেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রবার্তো মেন্ডেজ ডি সিলভা ওরফে বেটো। গোটা মাঠজুড়ে তখন আধিপত্য নিয়েই খেলছি আমরাই। কিন্তু আমি তো গ্যালারিতে তখন নবিশ। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ। নতুন অভিজ্ঞতা। অত্যন্ত আঁটোসাঁটো হয়েই হাতে সবুজ রুমাল আগলে বসেছিলাম। ওটা ছিল আমার লাকি রুমাল। যখন প্রথমার্ধের খেলা শেষ হবে হবে করছে, সেই সময় পিছন থেকে একটা চাঁটি এসে পড়ল আমার মাথায়। পিছনে ঘুরে দেখলাম, দাদুর বয়সি একজন। চোখাচোখি হতেই আমাকে বললেন, ‘মাঠে নতুন মনে হচ্ছে! তা একটু গলা ছাড়ো খোকা।’ বুঝলাম, মাঠে গেলে মুখেও মারা শিখতে হয়। 

কিন্তু আমার তখন কু গাইছে। শেষে এসে গোল খাওয়ার রোগে কিন্তু এই মরশুমে ভুগেছে আমার বাগান। এমন আশঙ্কার মাঝেই শেষ হল ফার্স্ট হাফ। দ্বিতীয়ার্ধে তেড়েফুঁড়ে খেলা শুরু করল চার্চিল। এরই মধ্যে ম্যাচের ৭৬ মিনিটে মার্কোস পেরেইরার গোল সমতায় ফেরাল চার্চিলকে। মনে আছে, মোহনবাগান গ্যালারিতে তখন পিনপতন নীরবতা। ৮০ মিনিটের মাথায় এমন পরিবেশের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলেন কোচ অমল দত্ত— ‘এইইইই কী করছিস তোরা... খেল ঠিক করে...’ ব্যস, প্রবাদপ্রতিম মানুষটির এমন চিৎকার নিমেষের মধ্যে গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরাও তখন চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। গ্যালারিতে তখন যেন হাজার হাজার ‘অমল দত্ত’। 


শেষপর্যন্ত ম্যাচে আর গোল হয়নি। আমরা ২২ ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করে অষ্টম স্থান দখল করে কোনোরকমে অবনমন বাঁচিয়েছিলাম। চার্চিলের পয়েন্টও মোহনবাগানের সঙ্গে এক ছিল। কিন্তু গোল পার্থক্যে পিছিয়ে পড়ে তারা স্টেট ব্যাঙ্ক অব ট্রিভাঙ্কোর (এসবিটি), টালিগঞ্জ অগ্রগামী, ভাস্কোর সঙ্গে দ্বিতীয় ডিভিশনে নেমে গিয়েছিল। এটাই ছিল টালিগঞ্জ অগ্রগামীর শেষ জাতীয় লিগ। সেই যে টালিগঞ্জ অবনমনে নেমে গেল, তারপর বহু চেষ্টাতেও জাতীয় লিগে উঠতে পারেনি তারা। আর এখন অদ্ভুতুড়ে আইএসএলের যুগে ‘অবনমন’ শব্দটাই তো দেশের একনম্বর ফুটবল লিগ থেকে মুছে গেছে। দেশের এখনকার ‘একনম্বর’ লিগে অবনমন নেই। ভাবা যায়, একসময় এই অবনমনের শ্যেন নজরে থাকা মোহনবাগানকে সাপোর্ট করতেই প্রথমবার মাঠমুখো হয়েছিলাম। সেটাই ছিল আমার ময়দানি প্রেমের প্রথম শুরুয়াত।

Powered by Froala Editor