রামকুমার আর নিকুঞ্জ সাহা

সত্যজিৎ রায়ের 'বহুরূপী' গল্পটি লেখা ১৯৮৩ সালে। গল্পটা তো সকলের মোটামুটি জানা। নিকুঞ্জ সাহা উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু টাকা পেয়ে ছেড়ে দিল তার বইয়ের দোকানে সেলসম্যানের চাকরিটাও। যেটা ছিল তার শখ, সেটাই এমন ঘাড়ে চেপে বসল যে, সেই শখটাই নেশার মতো হয়ে দাঁড়াল। তার শখ ছিল মেক-আপ নিয়ে। অথচ সেটা ঠিক জীবিকা অর্জনের পথ হতেও পারল না। কারণ, নাট্যদলে তাকে জায়গা করে দেবে না কেউ। এদিকে তার ভাবনাতে "চুল ছাঁটার সেলুনের মতো তো মেক-আপের সেলুন খোলা যায় না, যেখানে লোক পয়সা দিয়ে নিজের চেহারা পাল্টে নিতে আসবে।" সেই কারণেই নিকুঞ্জ ঠিক করল, নিজের শরীরের ওপরেই সে যাবতীয় পরীক্ষা করবে। তার চেহারাটিও মাঝারি গোছের আর সেটাই তার সুবিধার দিক। ফলে, তার ওপর পরীক্ষা করাই সুবিধা। নিজেই বই পড়ে, আরো বিদেশ থেকে মেক-আপের জিনিসপত্র আনিয়ে নিজের নানা সাজবদলের উপকরণ জোগাড় করে নিল সে। নিজেও বানাল হরেক কিসিমের পরচুলা। কলকাতার ঢের বাজার ঘুরে জোগাড় হল নানান রকম পোশাক। তাছাড়া অনেক রকম চশমা, চটি, টুপি, পাগড়ি, হাতের বালা, গলার পৈতে, বৈষ্ণবের কণ্ঠি আরো কত কী সংগ্রহ করে নিল সে। 

এইভাবেই পুরো তৈরি হয়ে ষোলোই অগ্রহায়ণ সে আরম্ভ করল তার পরীক্ষা। সাজ বদল করে চেনা মানুষ আর অচেনা মহল্লাতেও যেতে- আসতে থাকল সে। দেখা গেল সত্যিই কেউ চিনতে পারল না তাকে। এমনকি তার বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটিও চিনতে পারলেন না তাকে। এইরকম এক অদ্ভুত মানুষের কাহিনিই তো 'বহুরূপী'। এই বহুরূপীর কাহিনিটি সত্যজিতের ভাবনাতে এলো কী করে, তার একটা সূত্র কি আছে সত্যজিতের দশ বছর বয়সের একটি ঘটনায়? 

বহুরূপী গল্পের অলংকরণ। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

 

সত্যজিতের তখন বছর দশেক বয়স। সালটা ছিল ১৯৩১। ১৯৩১ সালের পুজোর সময়, আশ্বিন ১৩৩৮-এ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'রামধনু' পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি লেখা। তার নাম: 'শিল্পী রামকুমার'। ঘটনাটি এই রকম, কলকাতা শহরেই রামকুমার নামে এক দক্ষিণ ভারতীয় মানুষ বেশ কদিন যাবত আশ্চর্য কিছু কাণ্ড করছিলেন। যেমন, একদিন এক সভাতে ছদ্মবেশ ধারণ নিয়ে বক্তব্য পেশ করতে করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল মঞ্চের উপরে উপস্থিত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সক্কলে হতবাক। কারণ, সময়টি ১৯৩১। তার বছর পাঁচেক আগেই মারা গেছেন দেশবন্ধু। 'রামধনু' পত্রিকাতে লেখা হল: "বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটিলে বুঝা গেল যিনি এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছদ্মবেশ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতেছিলেন, তিনিই এক ফাঁকে দেশবন্ধুর চেহারা লইয়া উপস্থিত হইয়াছেন"। এই গুণী মেক-আপের শিল্পীর সম্পর্কে লেখা হয়েছিল: "অপরের চেহারার নকল করিতে ইঁহার সমকক্ষ শিল্পী ভারতবর্ষে তো নাই-ই, সারা পৃথিবীতেও কমই আছেন।" এই রামকুমার এমনকি স্বয়ং শ্রীমতী সরোজিনী নাইডুর "ছদ্মবেশ ধরিয়া ইনি সবাইকে তাক লাগাইয়া দিয়াছেন"। 

আরও পড়ুন
‘সবুজ মানুষ’-এর অদ্ভুত কাহিনি

আমাদের গল্পের নিকুঞ্জ সাহা নাট্যদলে চাকরি পাননি, কিন্তু সেই রামকুমারকে বিশ্ববিখ্যাত জার্মান অভিনেতা এমিল জেনিংস তাঁর নাট্যদলে চেয়েছিলেন সেই রামকুমারকে। যদিও বিদেশের উজ্জ্বল সুযোগ আর প্রলোভন ছেড়ে তিনি থেকে গেছিলেন এখানেই আর আশ্চর্যভাবে নিজের চেহারার ওপরেই তিনিও তাঁর রূপশিল্পীর পরীক্ষা করতেন। এই মানুষটিই কি তাহলে গল্পের চরিত্র হয়ে ফিরে এলো সত্যজিতের কলমে, সেই কথা জানার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর? 

আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’-২

রামধনু পত্রিকায় প্রকাশিত সেই লেখা।

 

আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’

পাঠক এখানে দুটি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, এক এই রামকুমার-ই সত্যজিতের মনের ভিতর ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ আর কী আছে? কারণ, এ তো যেকোনো রূপশিল্পীর কাহিনিই হতে পারে। আর দশ বছর বয়সে সত্যজিতের পাঠের ভেতর এই লেখাটি ছিল, তারই বা প্রমাণ কী? এখানে দুটি অনুমান পরপর বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন
গল্পের আমি- ৩

প্রথমত, এই রামকুমার বিষয়ে 'রামধনু'- র ওই লেখাতে বলা হয়েছিল, 'শিকাগো শহরের গুন্ডারূপে' সেই রামকুমারের ছবি দেখে মনে হচ্ছিল 'গুন্ডামি ভিন্ন বুঝি তিনি আর কিছু করেনই নাই'। মনে পড়বে, 'বহুরূপী' গল্পের ক্লাইম্যাক্সে তো আছে সেই এক গুন্ডার চেহারা ধারণের কাহিনিই। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, সত্যজিৎ শৈশবে সেই লেখা পড়েছিলেন কি না? 

এখানে মনে পড়বে, সত্যজিতের লেখা 'যখন ছোট ছিলাম' গ্রন্থের কথা। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, গড়পার রোড থেকে তাঁরা যখন বেলতলা রোডের বাড়িতে এলেন, তার থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বেই ছিল রামধনু পত্রিকার দফতর। তিনি লিখেছিলেন: "আরেকটা ছোটদের বাংলা মাসিক পত্রিকা তখন বেরোত যেটা বেশ ভালো লাগত, সেটা হল রামধনু। রামধনুর আপিস ছিল বকুলবাগান রোড আর শ্যামানন্দ রোডের মোড়ে। আমাদের বাড়ি থেকে দুশো গজ দূরে। এই কাগজের সম্পাদক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ করে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। কারণ ওঁর লেখা জাপানি গোয়েন্দা হুকাকাশির গল্প 'পদ্মরাগ' আর 'ঘোষ চৌধুরীর ঘড়ি' আমার দারুণ ভালো লেগেছিল।" বোঝাই যাচ্ছে, এই পত্রিকার সঙ্গে সত্যজিতের বেশ যোগাযোগ ছিল। আর তিনি যে দুটি গল্পের কথা বলেছেন, তার একটি, ওই 'ঘোষ চৌধুরীর ঘড়ি' উপন্যাসটি প্রকাশিত হচ্ছিল, যে সংখ্যাগুলিতে তারই অন্যতম ওই আশ্বিন ১৩৩৮ সংখ্যা, যেখানে বেরিয়েছিল রূপশিল্পী রামকুমারের খবর। তার মানে হতেই পারে সেই ছোটবেলার পড়া একটি টুকরো প্রবন্ধ বহু পরে ফিরে এলো সত্যজিতের কথাসাহিত্যের চরিত্র হয়ে!

Powered by Froala Editor