রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’

গত কিস্তিতেই কথাটা পেড়ে ফেলেছি। কথাটা হল, যে-সময়ে সত্যজিৎ পরপর গল্পের ‘কথক’ হিসেবে একজন ‘আমি’-কে দিয়ে বলাচ্ছিলেন তাঁর গল্প, সেই সময়েই লেখা একটিমাত্র গল্পের কথক ওই ‘আমি-কথক’ নয়। গল্পের নাম ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, এ কাহিনিতে কথক ‘আমি’ না থাকলেও, এ এক্কেবারে এক জটিলতম ‘আমি’-রই গল্প। এখানে গল্পটা হয়ত ওই ‘আমি’ চরিত্রটি নিজে বলছে না, কিন্তু গল্পটা প্রবলভাবে এক ‘আমি’-র গল্প। যে একাকী এক মানুষের কথা সত্যজিতের গল্পে প্রায় সমস্ত আলোচকরাই লক্ষ করেছেন, এই গল্প সেই একাকিত্বের গল্পও নিঃসন্দেহে।

রতনবাবু মানুষ হিসেবে ভারি অদ্ভুত--- না তিনি নিজে বিশেষ কারো সঙ্গে মেশেন, না তিনি কারো সঙ্গে সহজ। মানুষের সঙ্গে মেশার মতোই জটিল তাঁর কাছে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারখানা। তিনি বেড়াতে ভালোবাসেন, তাই গল্পকার বলে দেন, ‘ভ্রমণ জিনিসটা রতনবাবুর একটা বাতিক বলেই বলা যেতে পারে। সুযোগ পেলেই তিনি কলকাতার বাইরে কোথাও ঘুরে আসেন।’ পুজোর ছুটির সঙ্গে নিজের বাৎসরিক ছুটিগুলো এক করে তিনি লম্বা ছুটি বের করে বেড়াতে বের হন, কিন্তু তাঁর এই বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটার ভেতরেও দুই ধরনের একাকিত্ব আছে। প্রথমত ‘এই বেড়ানোর ব্যাপারে রতনবাবু আর কাউকে নেন না, বা নেবার ইচ্ছেটাও তাঁর মনে আসে না।’ আর দ্বিতীয়ত, সকলে আর পাঁচজন সাধারণ লোক যেখানে যেখানে যায়, তিনি যান তার থেকে ভিন্ন কোথাও। গল্পকার বলে দেন, ‘লোকে সচরাচর যেসব জায়গায় চেঞ্জে যায়, রতনবাবু সেদিকে দৃষ্টিই দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘আরে মশাই--- পুরীতে সমুদ্র আছে, জগন্নাথের মন্দির আছে, দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, হাজারিবাগে পাহাড় আছে, জঙ্গল আছে, রাঁচির আকছে হুড্রু ফলস আছে, এসব তো সকলেই জানে। আর লোকমুখে একটা জিনিসের বর্ণনা বারবার শোনা মানে তো সে জিনিস প্রায় দেখাই হয়ে গেল।’’ তাই তিনি চেঞ্জে যাওয়ার সময় যান রেল স্টেশনের ধারে একটা ছোট্টো শহরে। তাঁর ভ্রমণের পরিকল্পনাটি কী রকম? জানা যাবে, ‘প্রতি বছরই ছুটির আগে টাইম টেবল খুলে, খুব বেশি দূরে নয় এমন একটি জায়গার নাম বের করে তিনি দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়েন। কোথায় গেলেন কী দেখলেন, তা কেউ জিজ্ঞেস করে না বা কাউকে তিনি বলেনও না। এমন অনেকবার হয়েছে যে, যেখানে গেছেন, সেই জায়গার নাম তিনিও আগে শোনেনইনি।’ নতুন নতুন এইসব জায়গাতে তিনি কী দেখেন, দেখেন যা, সেগুলি আর পাঁচজনের চোখে হয়ত সামান্য আর তুচ্ছ, কিন্তু তাঁর চোখে আহামরি কিছু। যেমন, ‘রাজাভাতখাওয়ার একটা বুড়ো অশ্বত্থ গাছ--- যেটা একটা কুলগাছ আর একটা নারকেল গাছকে পাকিয়ে উঠেছে মহেশগঞ্জে একটা নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ, ময়নাতে একটা মিষ্টির দোকানের ডালের বরফি---’। এহেন রতনবাবু সেবার এলেন যেখানে, সেই জায়গাটার নাম সিনি। টাটানগর থেকে মাইল পনেরো দূরে এই শহর।

এখানে এসে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে তাঁর প্রথম চোখে পড়ল ছোট্টো একটা ডোবা পুকুরে ফুটে-থাকা শালুক ফুল। জলে খেলে-বেড়ানো বক ডাহুক কাদাখোঁচা মাছরাঙা তাঁর চেনা--- কিন্তু এই শালুক তাঁর চোখে নতুন। এরপরে তাঁর চোখে পড়ল, একটা রেলওয়ে ওভারব্রিজ--- তার উপর থেকে তাকালে একদিকে দেখা যায় একটা ছোট্টো স্টেশন, আরেকদিকে দিগন্তবিস্তৃত রেললাইন চলে গেছে। রেললাইন বোঝাতে গিয়ে একটা চেনা শব্দকেই অন্যভাবে লেখেন গল্পকার  সত্যজিৎ। বলেন, রেললাইনটা হল ‘সমান্তরাল দুটো লোহার পাত’--- তারপরেই তাঁর মনে হয়, এখন যদি একটা ‘হঠাৎ একটা ট্রেন এসে পড়ে আর ব্রিজের তলা দিয়ে সেটা যদি যায় তাহলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হবে’। কী জানি কেন, ‘এটা ভাবতেই রতনবাবুর গায়ে কাঁটা দিল।’ সকলেই বলবেন, যেকোনো রেলওয়ে ওভারব্রিজের ওপর থেকে দেখতে পাওয়া এই ছবিটাতে কী এমন আছে, যা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো? ছবিটাতে কিছু নতুনত্ব নেই--- আছে ছবিটাকে যেভাবে দেখছেন রতনবাবু, সেই দেখাটাতে। সেটা একটা আশ্চর্য জ্যামিতি। কী রকম?

দুটো লোহার পাত--- সমান্তরালভাবে ছুটে চলেছে। তারা সমান্তরাল--- তারা সাধারণভাবে মিলছে না। তাদের ভেতর যোগসূত্র তৈরি করে আরেকটা এমন জিনিস যেটা আবার প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে সোজা। এবারে সেই দুটো সমান্তরাল লাইন আর ওই ধাবমান গাড়িটা একটি তলে থাকলে, অন্য একটা উচ্চতায় আছেন রতনবাবু। সেই উচ্চতা থেকে তিনি দেখছেন ব্যাপারটা। এই দুটো তল আলাদা। তবে উল্লম্বভাবে দুটো তল তাঁর দৃষ্টিতে যেন একে অন্যকে ছেদ করছে--- কখন তারা ছেদ করছে? যখন তিনি দেখছেন, রেললাইনটার উপর দিয়ে সেই ট্রেন ওই ওভারব্রিজের ঠিক নীচ দিয়ে যাচ্ছে। রতনবাবুর এই গল্পটা নিয়ে কখনো ছবি করলে, নিশ্চয়ই রতনবাবুর চোখ দিয়ে এই জ্যামিতিটাকে নিয়ে একটা আশ্চর্য দৃশ্যকল্প তৈরি করতেন সত্যজিৎ। তবে এই দৃশ্যকল্পটা তো বাইরের বিষয় হল--- এবার বোঝা যাক, সেটা কীভাবে গল্পের সঙ্গে জুড়ে আছে। দুই আর এক--- লক্ষণীয়, এই দুটো ধারণাকে বারবার কাটাকাটি করে এগোতে থাকে এই ছবিটা। লক্ষ করার মতো, সমান্তরাল লাইন দুটো, দুটো লাইনকে জুড়ছে একটা ধাবমান গাড়ি, তারপরে দুটো তল, দুটো তলকে জুড়ে এক জায়াগায় এনে দিচ্ছে রতনবাবুর দৃষ্টি। তিনি দেখছেন, ধাবমন ট্রেন ব্রিজের নীচ দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই আপাত সহজ কিন্তু দেখাতে জটিল জ্যামিতিটা বুঝলেই বোঝা যাবে, গল্পের শেষ মুহূর্তটির রহস্য। সে কথায় পরে আসা যাবে।

আরও পড়ুন
গল্পের আমি- ৩

রতনবাবু আর সেই লোকটা গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-২

চূড়ান্ত একা আর অদ্ভুত একটি মানুষ এই রতনবাবুর কাছে এই সময়েই এলেন আরেকজন মানুষ। গল্পকার বলেন, এতক্ষণ ‘একদৃষ্টে রেললাইনের দিকে দেখছিলেন বলেই বোধহয় কখন যে আরেকটি লোক এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে সেটা রতনবাবু খেয়াল করেননি, তাঁর পাশে তাকাতেই তাঁকে চমকে উঠতে হল।’ দৃশ্যকল্পের দুই আর এক এবার গল্পের ভেতরে নেমে এল। একা আর একাকী রতনবাবুর পাশে আরো একটি লোক। সেই লোকটিও আবার সেই অর্থে ‘আরেকজন’ নয়। সেও আসলে রতনবাবুই। সত্যজিতের গল্পের ধরনের সঙ্গে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরা জানেন, যেকোনো চরিত্রকে গল্পে আনলেই সত্যজিৎ--- নিজে শিল্পী বলেই হোক, বা নিজে ছবির চিত্রনাট্য লিখিয়ে বলেই হোক--- প্রথমেই তার চেহারার একটা বর্ণনা দিয়ে দেন। এই রতনবাবুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। এখনো তাঁকে কেমন দেখতে, সেটা বলেননি সত্যজিৎ। এবারে পাশে আসা নতুন লোকটির পোশাক আর তার চেহারার বর্ণনা রতনবাবুর চোখ দিয়ে বলতে বলতে, গল্পকার রতনবাবুর একটা মনে হওয়া ধরিয়ে দেন পাঠককে। তিনি লেখেন, ‘হঠাৎ বুঝে ফেললেন কেন তাঁর খটকা লাগছিল। লোকটিকে চেনা চেনা মনে হবার কারণ আর কিছুই না--- এই ধাঁচের একটি চেহারা রতনবাবু বহুবার দেখেছেন--- এবং সেটা তাঁর আয়নায়।’ এই আগন্তুক ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে রতনবাবুর মিল, তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে রতনবাবুর মিল, এমনকি তাঁদের স্বভাব আর গতিবিধিতেও ভারি মিল। মানে, তিনিও একা ছোটো জায়গাতে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, গতবারের মতোই তিনিও ধুলিয়ান গেছিলেন রতনবাবুর মতো, রতনবাবুকে এই সিনি জায়গার খোঁজ দিয়েছিল তাঁর আপিসের এক সহকর্মী, ওই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রেও তাই, এমনকি, তিনিও এখানে এসেছেন তাঁর আপিসের এক সহকর্মীর কাছ থেকে জায়গাটার কথা জানতে পেরে। এখানে এসে রতনবাবু উঠেছেন মহামায়া হোটেলে, ওই ভদ্রলোক উঠেছেন কালিকা হোটেলে--- মহামায়া আর কালিকা-ও তো সমার্থক। অদ্ভুতভাবে তাঁদের নামেও ভারি মিল--- ইনি রতনলাল আর এই ‘আগন্তুক’ হলেন ‘মণিলাল’। রতন আর মণিও তো সমার্থক। এঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দুই-এর ভেতরে একের পর এক মিল শুনতে শুনতে পাঠক হিসেবে বুঝতে পারা যায়, গল্পে কেন ওইভাবে দুই আর একের জ্যামিতিটা ভিসুয়ালি তৈরি করছিলেন লেখক। সব কথা এক হতে হতে, কোন কথাটায় রতনবাবু একটু স্বস্তি পান? সেটা হল, দুজনেই বিকেলে ডোবার দিকে গেছিলেন, তবে, রতনবাবুর চেনা ছিল পাখিগুলো আর ভালো লেগেছিল শালুক আর মণিলালের মনে হয়েছিল, ‘কিছু পাখি দেখলাম যা বাংলাদেশে আগে দেখিনি। আপনার কী মনে হল?’ গল্পে এর আগেই ছিল, কিছু পাখি রতনবাবুর চেনা হলেও সেখানে যত ধরনের পাখি ছিল তার ‘বাকিগুলো এই প্রথম তিনি দেখলেন’। তবে, তিনি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলেন, শালুক দেখে। এই শালুকের কথাটা আগন্তুক বলেনি শুনেই বুঝি একটু আশ্বস্ত হলেন রতনবাবু। এরপরেই ওই রেলব্রিজের উপর থেকে দুজনে দেখলেন সেই রেললাইন ধরে ধেয়ে আসা রেলগাড়ি--- দুজনেই খুশি হলেন। রতনবাবুর মনে তৈরি হল ‘ছেলেমানুষি রোমাঞ্চের ভাব’ আর মণিলাল বলল, ‘আশ্চর্য! এত বয়স হল, তবু ট্রেন দেখার আনন্দটা গেল না!’   

আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-১

এই রতনবাবু আর মণিলালের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু সেই বন্ধুত্বটাও যেন মেনে উঠতে পারেন না এই একাকী রতনবাবু। তাঁর মনে হয়, ‘কেন জানি মনে হল যে, তিনি একাই ছিলেন ভালো। বন্ধুর তাঁর কোনো দরকার নেই। আর বন্ধু হলেও, সে লোক যেন মণিলালবাবুর মতো না হলেই ভালো। মণিলালবাবুর সঙ্গে তিনি যতবারই কথা বলেছেন, ততবারই মনে হয়েছে তিনি যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। প্রশ্ন করলে কী উত্তর পাওয়া যাবে, সেটা যেন আগে থেকেই জানা, তর্ক করার সুযোগ নেই, আলোচনার প্রয়োজন নেই, ঝগড়াঝাঁটির কোনো সম্ভাবনাই নেই। এটা কি বন্ধুত্বের লক্ষণ?’ এখানেই গল্পের আসল রহস্য। একা হতে হতে একা ‘আমি’ নিজের সঙ্গেই একটা বন্ধুত্ব তৈরি করে। সেই একা ‘আমি’ যদি নিজেরই আরেকটা সত্তা হয়, তাহলে তো সেও আসলে ক্লান্ত করবে ‘আমি’-কে। আর এখান থেকেই একটা জটিলতর প্রশ্ন তৈরি হয়ে ওঠে, এই একা ‘আমি’ আসলে কী চায়? সে কি তার থেকে অন্য রকম কাউকে চায়, নাকি তার মতোই কাউকে চায়? নাকি নিজের কাছে নিজেও একটা অন্য ‘আমি’ হয়ে ক্লান্ত করে তাকে? এই দুই ‘আমি’-র সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব নিয়েই আসলে ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ গল্পের দ্বিতীয় অংশ--- সেটা বরং তোলা থাক পরের কিস্তির জন্য।

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১