একই সময় একই নাম গল্প দুটি আর 'তিন রকম' বই

মানিকলমকারি - ৬৬
আগের পর্বে

সত্যজিতের কাহিনিতে পুরুষ চরিত্র যত রয়েছে, নারী চরিত্র তার তুলনায় হাতে গোনা। এই নিয়ে উত্তরকালের পাঠকদের অনেকেরই অনুযোগ রয়েছে। তবে সংখ্যায় কম হলেও সত্যজিতের গল্পে নারী চরিত্রগুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেখানে যেমন ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’ গল্পের বৃদ্ধা ম্যাজিশিয়ান রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন একেবারে সাধারণ ঘরোয়া নারীরাও। এই তালিকায় এসে যায় ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’ গল্পে সদানন্দের মা অথবা ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পের গিন্নির কথা। আবার ‘অতিথি’ গল্পের সুহাসিনীর চরিত্রটি বদলে গিয়েছিল ‘আগন্তুক’ সিনেমা তৈরির সময়। ফেলুদার গল্পেও নারী চরিত্র একেবারে অপ্রতুল নয়। এঁদের বেশিরভাগই আবার ফেলুদার গল্পের একনিষ্ঠ পাঠিকা। অন্যদিকে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ এবং ‘নায়ক’ সিনেমার জন্য তৈরি হলেও কাহিনি সত্যজিতের নিজস্ব। সেখানে মুখ্য চরিত্রে দেখা গিয়েছে দুই নারীকেই।

একটা সাজানোর ভুলে আর আমাদের অ-কারণ একটা মনে হওয়ার ভুলে কী না হয়? আসলে শতকরা নব্বুইজন সত্যজিৎ-পাঠককে জিজ্ঞাসা করুন, এই উত্তরটাই পাওয়া যাবে। সকলেই বলবেন, সত্যজিৎ প্রথমে ছোটোদের জন্য গল্প লেখা শুরু করেন। পরিণত বয়সে তিনি বড়োদের জন্যেও গল্প লেখেন আর সেখানেও তিনি একটি ছোট্টো কিন্তু দরকারি ছাপ রাখেন, সামান্য কয়েকটি গল্প লিখেও। কথাটা মোটের ওপরে বহুল প্রচলিত বহুল উচ্চারিত। কিন্তু কালক্রম মেনে সত্যজিতের গল্পের ইতিহাস সাজালে এই কথাটি সর্বৈব ভুল, ইতিহাসসম্মত নয়। অথচ, এটাই সাধারণ ধারণা। আজকের কিস্তি সেই ভুলের হিসেবটাকে একটু উল্টে-পাল্টে দেখার একটা চেষ্টা।

প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে, আদৌ সত্যজিৎ ছোটোদের জন্য গল্প লেখা দিয়ে শুরু করেননি তাঁর গল্প-লিখিয়ে জীবন। এটা সহজেই বোঝা যাবে। কারণ, সত্যজিতের লেখা প্রথম দুটি ইংরাজি গল্প ঠিক ছোটোদের জন্য নয়। গল্প দুটির নাম ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ আর ‘শেডস অফ গ্রে’ সত্যজিতের মৃত্যু-পরবর্তী গল্পসংকলন ‘গল্প ১০১’-এ অন্য কারো অনুবাদে সেই গল্প দুটির বাংলা অনুবাদ থাকায় এই তথ্যটি অনেকেই জানেন। যদিও এই মানিকলমকারি-র একটি কিস্তিতেই আমরা দেখিয়েছিলাম ওই গল্পের অনুবাদ যিনিই করুন না কেন, সেই অনুবাদ অনেকাংশে লেখকের মূল ইংরাজির অভিপ্রায় থেকে বারেবারে বিচ্যুত হয়েছে। আমাদের মনে হয়, ‘গল্প ১০১’-এ অবশ্যই মূল দুটি ইংরাজি গল্প প্রকাশ করা উচিত। সেই গল্প দিয়েই শুরু করা উচিত ওই বই--- না হলে মূল গল্পদুটি ক্রমশ হারিয়ে যাবে। ইতিহাস আমাদের সেই অপরাধ ক্ষমা করবে না। ইতিহাসসচেতন প্রকাশক হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থার দায়িত্ববান হওয়া উচিত আর এই ব্যাপারে রে-সোসাইটি-র ভূমিকাও ইতিবাচক ও ইতিহাসনিষ্ঠ হওয়া সমীচীন।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। আগেই বলেছি, আমাদের সাধারণ ধারণা হল, সত্যজিৎ ছোটোদের জন্যেই গল্প লিখেছিলেন, পরে লেখেন বড়োদের জন্য গল্প। এই ধারণাটির একটা বড়ো কারণ হল, ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যন্য’ গল্পগ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৮৫। এখানেই প্রকাশিত হল ‘পিকুর ডায়রি’, ‘পিকু’ ছবির চিত্রনাট্য, ‘আর্য়শেখরের জন্মমৃত্যু’, ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’, ‘সবুজ মানুষ’, ও ‘শাখা প্রশাখা’-র প্রথম চিত্রনাট্যের খসড়া। এর কয়েক বছর পরেই চলে যাবেন সত্যজিৎ--- ফলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এই লেখাগুলি তাঁর পরের লেখা। আর সেখানে যেহেতু গল্পগুলির প্রথম প্রকাশকাল অনুল্লিখিত, তাই সেভাবে পাঠকদের মনে রেখাপাত করে না এর প্রথম প্রকাশকাল সম্পর্কিত তথ্যের তাৎপর্যও। তার চেয়েও বড়ো কথা হল, সত্যজিতের লেখা একটি গোটা বই সম্পর্কে আমাদের বিস্মরণ। বইটির নাম ‘তিন রকম’। আনন্দ বা নিউ স্ক্রিপ্ট থেকে নয়, অখ্যাত এক প্রকাশনা সংস্থা ‘কথামালা’ থেকে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই বইটির কথা যে আমরা বেমালুম ভুলেই গিয়েছি। বস্তুত এই বইটাই তো সত্যজিতের লেখা প্রথম সেই অর্থে বড়োদের গল্প-সংকলন। এখানেই ছিল তিন রকমের তিনটি লেথা--- একটি হল ছোটগল্প ‘আর্যশেখরের জন্ম মৃত্যু’, একটি ছিল ডাইরির ধরনে লেখা ‘পিকুর ডাইরি’ আর তৃতীয়টি ছিল চিত্রনাট্য ‘শাখা প্রশাখা’-র সেই প্রথম খসড়া। এই বইটির জন্যেও হলুদে-সবুজে দুই রঙা প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। তবে এই বইটি আজ সত্যজিতের বইয়ের ইতিহাসের স্মৃতি থেকে নির্বাসিত। এই বইটির কথা মনে থাকলে তবু আমাদের মনে থাকত, সেই ‘পিকুর ডায়রি’ বই বেরোবার অন্তত বছর ছয়েক আগে তিনি বড়োদের গল্প লিখতে শুরু করেছেন।

আরও পড়ুন
সুহাসিনী, মেরি শীলা, রুনা, বিবি-রা

এবার এই বড়োদের জন্য গল্প লেখার হিসেব পেছোনোর খেলাটা আরো পিছিয়ে যাবে ওই ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য’ বইয়ের ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’ গল্পটির প্রকাশকালে চোখ রাখলে। সায়েন্স ফিকশন আর অপরাধের গল্পের এক চমৎকার মিশেলে তৈরি এই গল্পটির প্রথম প্রকাশ শারদীয় আশ্চর্য পত্রিকার শারদীয় ১৩৭২ সংখ্যায়। আপাতনিরীহ এই সালতামামি ইতিহাসের মানচিত্রে ফেলে চমকে ওঠার মতো। কারণ শারদীয় ১৩৭২ বঙ্গাব্দ মানে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর- অক্টোবর। আরে ঠিক এই সময়ে এদিকে ‘আশ্চর্য’ পত্রিকার পাতায় যখন এই ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’ বেরোচ্ছে, ঠিক তার পরে পরেই ওদিকে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় তো প্রকাশিত হবে ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। সময় মেলালে দেখবেন, ‘আশ্চর্য’-র শারদ সংখ্যাতে ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’ বের হল পুজোতে, মানে ভাদ্র-আশ্বিনে আর কার্তিক ১৩৭২ বাদ দিলে ১৩৭২-এর অগ্রহায়ণ- পৌষ- মাঘ সংখ্যাতেই প্রকাশিত হল ফেলুদার প্রথম কাহিনি ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। তবে লক্ষণীয়, ‘তিন রকম’-এ কিন্তু ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’ গ্রন্থিত হয়নি। ফলে আমাদের সত্যজিতীয় গল্প-সাজাবার ধারাবাহিকতা থেকে নির্বাসিত হল ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’-র যথাযথ অবস্থান। সেই হিসেব আরো গোলমেলে হয়ে গেল ‘গল্প ১০১’ প্রকাশিত হওয়ার পরে। কারণ, সেখানে আবার এক অদ্ভুতুড়ে সম্পাদকীয় নীতি মেনে সত্যজিতের পরিচিত তথাকথিত সব ছোটোদের গল্প বসাবার পরে, মোল্লা নাসিরুদ্দিন আর তাঁর করা অনুবাদ গল্পগুলি বসাবার-ও পরে এক্কেবারে শেষে বসানো হল ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য’ শীর্ষক একটি গুচ্ছ। গোটা বইতে কোত্থাও বইয়ের নাম না রেখে অকস্মাৎ শেষে কেন এই গুচ্ছনামটি বইয়ের নামে হল, তা বোঝাও মুশকিল! মোট কথা, অনেকগুলি কারণে ধীরে ধীরে আমাদের মনের গণিত থেকে হারিয়ে গেল এই তথ্যটি যে, ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’-র মতো তথাকথিত বড়োদের গল্প লেখা হয়েছিল ‘ফেলুদার গোয়ন্দাগিরি’ লেখার অব্যবহিত আগে।

আরও পড়ুন
পুতুলের স্বল্প-গল্প

এই ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’ গল্পটির গঠন আরেকদিক থেকে বেশ কৌতূহলপ্রদ। গল্পটি এর আগে লেখা শঙ্কু-সিরিজের গল্পের মতো কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক আবার তখন সত্যজিৎ যে ছোটোদের জন্য একের পর এক অলৌকিক গল্প লিখছেন, সেই অলৌকিকত্বের একটা স্পর্শও আছে এই গল্পে আর এরপরে যে অপরাধের গল্প হয়ে উঠবে ফেলুদার গল্পের মুখ্য অবলম্বন--- সেই অপরাধের গল্পও শুরু হচ্ছে এই গল্পে। এইদিক থেকে দেখলে এই গল্পটা একটা সেতুর মতো। আবার ভেবে দেখুন, বড়োদের জন্যেও যে কল্পবিজ্ঞান লেখা হতে পারে, তারও একটা সূচনা যেন এই কাহিনি। সত্যজিতের গল্পে বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর যে মোটিফটি এরপরে পুনরাবৃত্ত--- এই স্বল্পালোচিত গল্প তো তারও এক শুরুয়াত। সত্যজিতের গল্পের এই বন্ধুত্বের মোটিফ ইনডেক্সটি নিয়ে পরবর্তী কিস্তিতে বরং গুছিয়ে একটা আড্ডা দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন
 যখন ছোট ছিলাম: পত্রিকাপাঠ আর গ্রন্থপাঠ

এই গল্প সম্পর্কে এবার আসি আরেক কথায়। ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’ গল্পে একজন গুণী বিজ্ঞানী ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর আবিষ্কৃত জিনিসটাকেই নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁর এক বন্ধু। পাশে দাঁড়াবার নাম করে সে বন্ধুকে ঠকায়। মজা হল, সেই গুণী বিজ্ঞানীর নামটি কী জানেন? তাঁর নাম ছিল প্রদোষ সরকার। একই সময়ে একজন গুণী বিজ্ঞানীর নাম দিলেন প্রদোষ আর তার পরের মাসেই প্রকাশিত হল প্রদোষ মিত্রের গল্প। একই নামে দুটি চরিত্র কেন লিখলেন সত্যজিৎ পরপর--- সেটার সন্ধান আজ আর কি বোঝা সম্ভব?

আরও পড়ুন
রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন: এক অন্য ছবির গল্প

Powered by Froala Editor

Latest News See More