গল্পের ‘আমি’-২

গত হপ্তায় যে ‘আমি’-কথকের কথা বলছিলাম, সেখানে ‘আমি’-রা মূল গল্পের পার্শ্ব-চরিত্র। তারা মূল কাহিনির নায়ক নয়, তারা মূল কাহিনির মাঝখানে আছে, তারা দেখছে তার চারপাশের লোক আর পরিস্থিতি--- তারা সেটাকে তুলে আনছে আমাদের কাছে। কিন্তু আরেক ধরনের ‘আমি’-কথকও তো আছে এই সব গল্পে, যেখানে সেই ‘আমি’-ই প্রধান। ওই আমি-ই তার গল্প বলে চলেছে আমাদের। সেখানে এমন দুই ‘আমি’-র কথা যখন শুনি আমরা সেখানে দুটি এমন কাহিনি আছে যেখানে ওই আমি আসলে তার অনুভূতির কথা বলে। সেখানে কোনো ঘটনার বিবরণ সে দেয় না, সে শুধু চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে তার কিছু মনে-হওয়ার কথা বলে। অদ্ভুতভাবে এই দুই ‘আমি’-ই হল দুই খুদে ‘আমি’। একজন হল ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’-এর সদানন্দ আর আরেক জন হল ‘পিকুর ডাইরি’ গল্পের পিকু। এই দুনিয়াটার গল্প বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে এর আগে এনেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ছোটোদের চোখ দিয়ে বড়োদের জগৎটাকে দেখার গল্প। চারপাশে বড়োদের কাজকম্মোর অসাড়তা আর তাদের দুনিয়াটা কতখানি হৃদয়হীন আর অনুভূতিশূন্য--- সেটা যত রকম ভাবে উন্মোচন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, তার জুড়ি মেলা ভার। বড়োরা বুঝতেই পারে না, তারা নিজেদের অজান্তে কতভাবে কষ্ট দেয় ছোটোদের, বড়োরা বুঝতেই পারে না তাদের যাবতীয় কাজকর্মের একজন নীরব দর্শক রয়েছে তাদের সামনেই। তার চোখে তাদের দুনিয়াটা কীভাবে মাপা হচ্ছে, তার গল্প শুনিয়েছিলেন বুদ্ধদেব।

সদানন্দের খুদে জগৎ-এর অলংকরণ। শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 

আজকের এই দুই ‘আমি’-কথক যেন সেই গল্পবিশ্বের দুই চমৎকার উত্তরসূরি। এই দুই গল্পে এই দুই কথকের একজনের সামনে একজন শ্রোতা রয়েছে, সে হল এই গল্পের পাঠক আরেকজনের সামনে কোনো শ্রোতা নেই, সে নিজেই নিজের কথা নিজে লিখে চলেছে নিজের খাতায়। দুটি কাহিনির মধ্যে বছর আষ্টেকের ব্যবধান। ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’ লেখা ১৯৬২-তে আর ‘পিকুর ডাইরি’ লেখা ১৯৭০-এ। সদানন্দ যে মধ্যবিত্তীয় সামাজিক পরিসরে থাকে সেখানে তবু একজন শ্রোতা আছে বলে সে যেন ভাবতে পারে, তাই সে তার অনুভূতির কথাগুলো বলে সামনে কাউকে। অন্যদিকে পিকু কলকাতার যে উচ্চবিত্ত সামাজিক পরিসরে বড়ো হচ্ছে সেখানে তার সামনে তার কথা শোনার কেউ আছে বলে সে ভাবতেও পারে না, তাই সে শুধু নিজের মনের কথাগুলো লেখে। আরো একটা তফাত আছে এই দুই কাহিনির বলার ধরনে। সেটা আরো কৌতূহলপ্রদ। সদানন্দ যেন তার চারপাশে ঘটে চলা বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন, তাই তার মনে হওয়াটার সঙ্গে চারপাশের লোকজন আর ঘটনা সম্পর্কে তার মত-মন্তব্যও আছে। অন্যদিকে পিকুর লেখার অনন্যতা এখানেই যে, সে তার চারপাশের ঘটনাগুলো শুধু দেখছে, তাকে লিপিবদ্ধ করছে--- যে পাঠক সেই লেখা পড়ছে, তাকে অনেকটা বুঝে নিতে হবে সেই ঘটনামালার মধ্য দিয়ে তার সামনে যে জগৎটা চলছে তার তাৎপর্য। এই বিষয় দুটি বিস্তারিত করলেই বোঝা যাবে, এই অন্য ধরনের ‘আমি’-কথকের কাহিনি বলার স্বাতন্ত্র্য।

পিকুর ডাইরি-র অলংকরণ। শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 

আরও পড়ুন
গল্পের ‘আমি’-১

সদানন্দ তার সামনের শ্রোতাকে গল্প ‘বলা’ শুরুই করে নিজের ‘কথা’ বলে। সে বলে, ‘আজ আমার মনটা বেশ খুশি-খুশি, তাই ভাবছি এইবেলা তোমাদের সব ব্যাপারটা বলে ফেলি।’ এই ‘তোমরা’ যে তার বয়সেরই মানুষ, সেটা পরিষ্কার এর পরের কথাতেই। সে বলে, ‘আমি জানি তোমরা বিশ্বাস করবে। তোমরা তো আর এদের মতো নও। এরা বিশ্বাস করে না। এরা ভাবে আমার সব কথাই বুঝি মিথ্যে আর বানানো। আমি তাই আর এদের সঙ্গে কথাই বলি না।’ গল্পের শুরুতেই সদানন্দের কথায় বিশ্বাস না-করা একটা দল আর তার কথায় বিশ্বাস করতে-পারে এমন একটা দলে ভাগ হয়ে যায় সদানন্দের গল্পের জগৎ। সদানন্দের বিশ্বাসে বিশ্বাসবাসতে পারার মতো মানুষ তার ওই খুদের দল। সে বিশ্বাস করে, তার এই শ্রোতা-বন্ধুদের জগৎ হল তার মতোই খুদেদের জগৎ। তাদের সে শোনায় তার আরেকদল বন্ধুদের কথা। তার সেই আরেকদল বন্ধুরা হল পিঁপড়ে। সদানন্দ শুধু পিঁপড়ে নয়, সে দেখতে পায় এই দুনিয়াটাকে নিজের মতো করে--- তার সেই দেখাটা দেখতে তো পায়ই না, বরং তার দেখাটা যে আদৌ আছে, সেই দেখাটাও যে থাকতে পারে, সেই কথাটাই বিশ্বাস করতে পারে না সদানন্দের চারপাশের বড়োরা। সেখানেই তার ক্ষোভ বড়োদের নিয়ে। সে বলে, ‘ধরো, তুমি হয়তো কিছু না-ভেবে মাটিতে একটা কাঠি পুঁতেছ আর হঠাৎ দেখলে একটা ফড়িঁ খালি উড়ে উড়ে এসেই কাঠির ডগায় বসছে--- এটা তো ভীষণ মজার ব্যাপার! কিন্তু তাই বলে, তুমি সেটা দেখে যদি হো হো করে হাসো, তাহলে তো লোকে পাগল বলবে!’ এই চারপাশের অদেখা জগৎটাকেই দেখতে পায় সদানন্দ। এমন কত কী দেখে সে আনন্দ পায়! জানলা দিয়ে উড়ে আসা শিমুল তুলোর ভেসে বেড়ানো বা জানলার মাথায় এসে বসা কাকের চলন আর ঘাড় ঘোরানোর কত কসরত--- সবটাই সে দেখে আর আনন্দ পায়। কিন্তু তার এই আনন্দ আর অনুভূতির জগৎটা যেন দেখতেই পায় না বড়োরা। এইভাবেই সে মন দিয়ে লক্ষ করে পিঁপড়েদের প্রতিটি চলাফেরা, সে এইভাবেই বন্ধুত্বও করে ফেলে তার বাড়ির এক-একটা লাল-কালো পিঁপড়ের সঙ্গে। তাদের প্রতি মানুষের না-দেখা আর তাদের অবজ্ঞা ভরে মেরে ফেলার এক নিষ্ঠুর গল্পও এই ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’। সদানন্দ নিজে এক ‘খুদে’, তার দেখা এই দুনিয়াটা খুদে পিঁপড়েদের দুনিয়া বলে সেই জগৎটা নিজেও সত্যিই ‘খুদেদের’ জগৎ আর তার সেই চোখে দেখা পৃথিবীর গল্প সদানন্দ শোনায় যারা তারাও তো ‘খুদে’-ই। তাই ওই ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’ নামখানা একেবারে মোক্ষম। যেমন মোক্ষম তার সদানন্দ নাম। সত্যিই সে সমস্ত কিছুর মধ্যে নিজের আনন্দ খুঁজতে জানে আর তার সেই আনন্দের খবর যারা তার মনের শরিক নয়, তারা পাবে কোথায়?

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২

বুদ্ধদেব বসু

 

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১

লীলা মজুমদার

 

আরও পড়ুন
গুগাবাবা-র ত্রয়ী। পর্ব ১

এর অন্যদিকে আছে পিকুর পৃথিবী। আগেই বলেছি, সদানন্দ তার চারপাশের মানুষ যে তার দুনিয়াটা দেখতে পারছে না তা নিয়ে সচেতন কিন্তু পিকুর গল্পের মজাটা অন্য জায়গাতে। সে যে দুনিয়াটা দেখছে আর তার ডাইরি-তে লিখে রাখছে, সেটা একান্তই বড়োদের জগৎ। সেখানে বিশ্বাসহীনতা আছে, সেখানে পরকীয়া আছে, সেখানে রাজনীতি আছে, সেখানে বড়লোক বাড়ির ছেলে রাজনীতি করলে, তা নিয়ে বাড়ির বড়োদের সঙ্গে সেই ছেলের দূরত্বের গল্পও আছে, আছে ধনীগৃহে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হতে থাকা কিছু মানুষের চোখে অন্যদের লক্ষ পর্যন্ত না করার হৃদয়হীনতার কাহিনি। কিন্তু সেই সবটাই পিকুর ডাইরিতে ধরা থাকে। সে সেটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না। কারণ সে যে ছোটো। সে লক্ষ করে বিষয়গুলো। কিন্তু সেগুলো ভালো না মন্দ, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা তো তার হয়নি। পিকুর ডাইরি তাই এক অসাধারণ রচনা, যে-লেখাটি যারা কেবল সত্যজিতের তৈরি ‘পিকু’ ছবিটি দিয়ে বুঝতে চাইবেন, তারা পুরো বুঝতে পারবেন না। কী জানি আমার কেন মনে হয়, ‘পিকুর ডাইরি’ বোধ হয় ‘পিকু’ ছবির চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আর গভীর একটা টেক্সট। এখানে ছদ্ম মেকি আধুনিক সময় কত নিষ্ঠুর তা লক্ষ করতে পারে মনস্ক বয়স্ক পাঠকই। সে-ই দেখতে পাবে কীভাবে তাদের সময় ধীরে ধীরে পিকুদের জগৎটাকে বদলে দেয়। কীভাবে বদলে যায়, পিকুর চারপাশ। এই কাহিনিতে সবচেয়ে নিষ্ঠুর কী জানেন? সেটা হল পিকুর লেখার ভাষা। পড়তে পড়তে, পাঠক হিসেবে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, পিকু তার চারদিকে কী কী দেখছে আর শুনছে, কিন্তু তার ভাষা তার মনের মতোই নির্মল। সেখানে কোনো ক্ষোভ নেই, রাগ নেই, উত্তেজনাও নেই। সে শুধু বলে চলেছে, নিজের মায়ের অন্য এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের কথা। মজা হল, সেই ‘অন্য পুরুষ’ শব্দের যে সামাজিক তাৎপর্য, সেটা তো সে জানে না। সে নিজস্ব বানানে সেই সামাজিকভাবে যাকে তার মায়ের জীবনের অন্য পুরুষ বলছি আমরা তাকে সে চেনে তার ‘হিতেসকাকু’ নামে। তাকে তার সেই ‘হিতেসকাকু’ যে-উপহার দেয়, সেটা সে নেয়ও। তাকে সেই উপহার দেওয়া যে সহজ কোনো উপহার দেওয়া নয়, সেটা বোঝা তার পক্ষে অসম্ভব। সে দেখে তার মতোই তার দাদাও বন্দুক নিয়ে ছাদে টিপ প্র্যাকটিস করে। সে শুধু জানে না, তার এই বন্দুক ছোড়া হল খেলা আর তার দাদার কাছে তা সশস্ত্র বিপ্লবের ভেতর দেখা মুক্তির পথ। তার বাড়িভর্তি অনেক ব্র্যান্ড। সেই নানাবিধ ব্র্যান্ড তাকে গ্রাস করে, সে বুঝতে পারে না। সে বুঝতে পারে না, তার চারপাশের ওই বড়োদের দুনিয়াটা তাকে তার অজান্তেই গ্রাস করছে। এই নিজেকে বুঝতে না-পারা ‘আমি’-র কাহিনিই হল ‘পিকুর ডাইরি’। শেষ মুহূর্তে দেখা যায় এক নিষ্ঠুর দৃশ্য। পিকুর সামনে তার দাদুর মৃতদেহ--- সে এটাও বোঝে না যে তার দাদু মৃত। কিছু একটা অনুভব করে। তাই তার লেখার ভাষা অকস্মাৎ সেখানে গিয়ে দ্রুত হয়ে যায়, আগের থেকেও যেন অসংলগ্ন হয়ে যায় সেই ভাষার দ্রুতি। সে চারপাশের সঙ্গে নিজের অজান্তে বদলে যায়। বদলে যায় তার ভাষা। সে বুঝতে পারে না, এখানে হয়ত সদানন্দের মতো খুদেরা বুঝতে পারবে না সেই কথার আসল গতিপ্রকৃতি। সেটা বুঝতে লাগবে হৃদয়বান বড়োদের--- যাঁরা ছোটোদের এই জগৎটাকে বুঝতে পারেন। এই দুই খুদে ‘আমি’--- সদানন্দ আর পিকুর জগৎ--- তিনিই লিখতে পারেন, যাঁর পিসির নাম লীলা মজুমদার। কেমন যেন মনে হয়, লীলা মজুমদারের ছোটোগল্পেরই এক সার্থক উত্তরাধিকার এই দুই ‘আমি’-র গল্প।

Powered by Froala Editor