পিতামহ তর্পণ-২

সত্যজিতের অলংকরণ শিল্পের ওপর শিক্ষক নন্দলাল বসুর প্রভাব নিয়ে আলোচনা সুপরিচিত। অবশ্যই তা সংগত। কিন্তু আমাদের মনে যেন থাকে, তিনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলংকরণ শিল্পী উপেন্দ্রকিশোরের পৌত্র। তাঁর উপরে, তাঁর অলংকরণ শিল্পচিন্তার গভীরে যদি কেউ থাকেন, তাহলে তা অবশ্যই উপেন্দ্রকিশোর। অলংকরণের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে যদি চিন্তা ভাবনা করা যায়, তাহলে ঠাকুরদার ছবি আঁকাকে যে কতখানি নিবিষ্ট মনে লক্ষ করেছিলেন সত্যজিৎ, তার একটা খোঁজ পাওয়া যাবে তাঁর লেখা ওই উপেন্দ্রকিশোর বিষয়ক নাতিদীর্ঘ নিবন্ধটিতে। সত্যজিতের পরবর্তী অলংকরণ শিল্পচিন্তার এক দিগনির্দেশ আছে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধটিতে। সত্যজিতের ভাবনাতে, উপেন্দ্রকিশোরের অলংকরণ শিল্পচিন্তার প্রধানতম লক্ষণ ছিল, প্রথমত, 'তাঁর বহুমুখিতা' আর দ্বিতীয়ত, 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্পের সফল সমন্বয়'। এখানে মনে রাখতে হবে, উপেন্দ্রকিশোর অবনীন্দ্রনাথের সমকালীন, তিনিও কিন্ত সেই যুগেই এই দুই শিল্পধারার আশ্চর্য সংযোগের কাজটি করছিলেন। তবে তাঁর কাজের ক্ষেত্র যেহেতু অলংকরণ শিল্প, আর তথাকথিত প্রথাগত শিল্প চর্চার সরহদ্দ থেকে যেহেতু অলংকরণ শিল্প সেদিন (এবং এখনো) ব্রাত্য, তাই উপেন্দ্রকিশোরের শিল্প আঙ্গিক নিয়ে শিল্প ইতিহাসের কৃতী ও পণ্ডিত গবেষকরা তত আলোচনা করেন না। সত্যজিতের অলংকরণ শিল্পের ভিতরে সুগভীর প্রভাব ফেলেছেন পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর।

সত্যজিতের কলমে, উপেন্দ্রকিশোর প্রসঙ্গে লেখা হল, "ভাবে ও রীতিতে ... [উপেন্দ্রকিশোরের] তৈলচিত্রের একেবারে বিপরীত হল তাঁর illustrations। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কবিরা যে সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন, তা এই সব illustration-এই সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠে।" এরপরেই আসল কথাটি ধরিয়ে সত্যজিৎ লিখলেন, "টেকনিক পাশ্চাত্য ঘেঁষা হলেও দিশি গল্প তাঁর ছবিতে কখনো বিলিতি বা দো-আঁশলা হয়ে যায়নি।" এই হল, উপেন্দ্রকিশোরের ছবির স্বাতন্ত্র্য। তাঁর দৃষ্টির এবং সৃষ্টির বহুমুখিনতা বহু ধরনের রেখা ও রূপ গড়ে তুলেছে। যে কাহিনির জন্য ছবি আঁকছেন উপেন্দ্রকিশোর, সেই কাহিনির সঙ্গেই ওতপ্রোত তাঁর ছবির রেখা ও রূপ। সত্যজিতের কথাটাও, "একদিকে বিলিতি অ্যাকাডেমিক শিল্পের প্রভাব, অন্যদিকে জাপানি উডকাট, রাজপুত ও মুঘল মিনিয়েচার ও বাংলার লোকশিল্প এবং আরো অন্যদিকে তাঁর নিজস্ব অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি সব মিলে এমন একটি ভঙ্গির উদ্ভব হয়েছিল যা উপেন্দ্রকিশোরের নিজস্ব ভঙ্গি এবং যার ফলে তাঁর ছবি দেখলে কখনোই অন্যলোকের আঁকা বলে ভুল হত না।" লক্ষণীয়, লেখার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ রেখাঙ্কনের যে ধরনটি সত্যজিতের শিল্প সৃজনের মূল চাবি, সেটা তিনি অর্জন করেছেন পিতামহের শিল্পকৃতির ঐতিহ্য থেকে। 

ছবি ১: প্রথম কবি প্রথম কাব্য লেখাতে উপেন্দ্রকিশোরের অলংকরণ।

 

ছবি ২: চাঙ নামক লেখাতে উপেন্দ্রকিশোরের অলংকরণ।

 

আরও পড়ুন
পিতামহ-তর্পণ: ১

ছবি ৩: জাপানি দেবতা নামক লেখাতে উপেন্দ্রকিশোরের অলংকরণ।

 

আরও পড়ুন
রামকুমার আর নিকুঞ্জ সাহা

বিষয়টি দুই চারটি উদাহরণসহ বুঝে নেওয়া যেতে পারে। সন্দেশ পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যাতেই উপেন্দ্রকিশোর লিখলেন 'প্রথম কবি ও প্রথম কাব্য'। সেই ছবির সঙ্গে যে রঙিন ছবি [ছবি ১] এঁকেছেন শিল্পী উপেন্দ্রকিশোর, সেখানে দেখা যাবে পাশ্চাত্য শিল্পরীতি মেনে আঁকা ছবিতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ভারতীয় একটি ভাব। রবি বর্মার ছবির মেজাজ যোগ করেছেন ছবির অন্তরে। আবার সেই সংখ্যাটিতেই ছিল চিনা উপকথা 'চাঙ'। কাহিনির পটভূমি চিন বলে, সেখানকার ছবিতে [ছবি ২] চিনা ক্যালিগ্রাফির মতো সূক্ষ্ম রেখার অজস্র ব্যবহার। তারপরে ওই বছরের তিন নম্বর সংখ্যাতে প্রকাশিত 'জাপানি দেবতা'র অলংকরণে প্রয়োগ করলেন [ছবি ৩] জাপানি চিত্রকলার রূপ-আঙ্গিক। এরপরে যখন নরওয়ের লোককথা লিখছেন ছোটোদের জন্য সেই সময়ে এক্কেবারে পাশ্চাত্য চিত্রকলার যথাযথ ব্যবহার চোখে না-পড়ে যায় না। [ছবি ৪] 

আরও পড়ুন
‘সবুজ মানুষ’-এর অদ্ভুত কাহিনি

ছবি ৪: নরওয়ের লোককথা নিয়ে লেখাতে উপেন্দ্রকিশোরের অলংকরণ।

 

আরও পড়ুন
রতনবাবু আর গল্পের এক অন্য ‘আমি’

ছবি ৫: ক্ষীরের পুতুল বইতে সত্যজিতের অলংকরণ।

 

ছবি ৬: পদিপিসির বর্মিবাক্সর প্রচ্ছদ, শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 

সত্যজিতের ছবিতেও এই আঙ্গিকের খেলাটি অবিরাম পুনরাবৃত্ত সেই প্রথম থেকে। তাই তিনি যখন অবন ঠাকুরের 'ক্ষীরের পুতুল'-এর ছবি আঁকছেন [ছবি ৫] তখন ব্যবহার করছেন বঙ্গীয় লোকশিল্পের রেখা আবার যখন 'পদিপিসির বর্মি বাক্স'-র প্রচ্ছদ আঁকছেন [ছবি ৬] তখন পুরো বইয়ের চেহারাটিও করছেন এক বর্মি বাক্সের ছাঁদে। আবার পথের পাঁচালী-র শিশু-কিশোর পাঠ্য সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু'-র ছবি তৈরি করলেন যখন, তখন সেখানে সত্যজিৎ আনলেন বাঙালি শিশুর প্রথম-পাঠ্য 'সহজ পাঠ'-এর সাদা-কালো উডকাটের গঠন [ছবি ৭-৮] আর শিশুদের জন্য বর্ণপরিচয় বিষয়ক গ্রন্থ 'হাতেখড়ি'-র চেহারা তৈরি করলেন একদম একটা চক আর স্লেটের গড়নে।  

ছবি ৭: আম আঁটির ভেঁপু র অলংকরণ, শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 

ছবি ৮: সহজ পাঠ-এর অলংকরণ, শিল্পী নন্দলাল বসু।

 

এইভাবেই তো আবার একেবারে অন্যভাবে আরেক কিসিমের কলমকারি দেখব, ফেলুদার গল্পের ছবি আঁকার সময়। সেখানে 'সোনার কেল্লা'-র পটভূমি রাজস্থানের চোখ ঝলসানো রোদ্দুরের আলো ছায়া বলে সেই উপন্যাসের ছবিতে সেই রকম চোখ ঝলসানো সাদা-কালোর ধরন। পক্ষান্তরে 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য'-তে ওই বাঘ কাহিনির কেন্দ্রে আছে বলেই বুঝি সেই উপন্যাসের অলংকরণের ভেতর অনেক ছোটোবড়ো আঁচড়ের দাগ। [ছবি ৯-১০] দেখা যাবে, উপেন্দ্রকিশোরের করা কোনো একটি লেখার দেখনশোভা হেডপিস তৈরিতেও উপেন্দ্রকিশোরের অবদান কম নয়। তিনি যেমন ধরনের ছবি আর ক্যালিগ্রাফিকে একসঙ্গে রাখার একটি ধরন [ছবি ১১] বানিয়েছিলেন, সেটি প্রবাহিত হয়েছে সত্যজিতের মধ্যেও। অবশ্যই সত্যজিতের সৃষ্টিতে তা এক অসাধারণ নতুনত্ব ও চমৎকারিত্ব সৃজন করেছে, তবে তার পূর্বসূত্র থেকে গেছে বুঝি পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরের শিল্পসৃজনে। 

ছবি ৯: সোনার কেল্লা র অলংকরণ, শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 

ছবি ১০: রয়েল বেঙ্গল রহস্য-র অলংকরণ, শিল্পী সত্যজিৎ রায়।

 

ঠাকুরদার উদ্দেশে পৌত্র সত্যজিতের আরেকটি অসামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য 'গুপি গাইন বাঘা বাইন'। না। কেবল উপেন্দ্রকিশোরের কাহিনি অবলম্বনে ছবি-করাই নয়, সেখানে চিত্রকর উপেন্দ্রকিশোরের প্রতি এক বিনম্র উল্লিখন হল, শুন্ডির রাজার কাছে হাল্লার রাজার পাঠানো সাংকেতিক ভাষার চিঠি। সেই যে চিঠি দেখে হা হতোঽস্মি' বলে অজ্ঞান হয়ে যান শুন্ডির রাজা। উপেন্দ্রকিশোর সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকার শেষ সংখ্যাটিতে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা সচিত্র প্রবন্ধ 'অদ্ভুত ইতিহাস'। [ছবি ১২]

ছবি ১১: সন্দেশ পত্রিকাতে উপেন্দ্রকিশোরের তৈরি হেডপিস।

 

ছবি ১২: সন্দেশ পত্রিকাতে উপেন্দ্রকিশোরের লেখায় সাংকেতিক ভাষা।

 

ছবি ১২: সন্দেশ পত্রিকাতে উপেন্দ্রকিশোরের তৈরি ছবির ধাঁধা।

 

সেখানে ছবি দিয়ে কথা বোঝানোর যে ধরনটি উপেন্দ্রকিশোর শিখিয়েছিলেন, ঠিক সেই যুক্তিক্রমেই হাল্লার রাজার চিঠিখানা লেখা। এমন বিনম্র শ্রদ্ধার নমুনা এক সুগভীর অনুধ্যানের বিষয়। সত্যজিতের লেখাতে আর ভাবনাতে আর কাহিনিতে যে নানান ধাঁধার ছড়াছড়ি, বুঝি বা শিশু সত্যজিতের ভেতর সেটাও প্রথম জানিয়েছিলেন ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর। উপেন্দ্রকিশোর কত ধরনের যে শব্দ নিয়ে ছবি নিয়ে ধাঁধার খেলা রাখতেন সন্দেশ পত্রিকার পাতায় পাতায়। নীচে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সন্দেশে ছাপা হয়েছিল এই অদ্ভুত লেফাফা বা খামে লেখা ঠিকানা। ছবিটি দেখলে তার সঙ্গে মিলিয়ে শব্দ সন্ধান করলে লেখাটি পড়লে [ছবি ১৩] তবেই বোঝা যাবে লেখা। বোঝা যাবে, সেখানে লেখা আছে: 'to the man-a-jar/ the sun-desh,/ 22, Shoe-key-a-tree-t.' এই ছবির খেলা শব্দের খেলা ফিরে এলো কি ছিন্নমস্তার অভিশাপ-এ দাদু-নাতনির শব্দ নিয়ে খেলার ভেতর? 

আসলে সেই ছেলেবেলাতে গড়পার রোডের ছাদের ঘরে ঠাকুরমা বিধুমুখী যখন পুরোনো সন্দেশ থেকে নাতি সত্যজিতের সামনে খুঁজে দেখতেন স্বামী উপেন্দ্রকিশোরের কাজগুলি, সরিয়ে রাখতেন আলাদা করে উপেন্দ্রকিশোরের তৈরি ছবির ব্লক, তখন যে রায়বাড়ির উত্তর-প্রজন্মের কাছেও আরেকভাবে উন্মোচিত হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর, তা কি আর সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন বিধুমুখী?

Powered by Froala Editor