পেশাদার জগত ছাড়িয়ে, পারিবারিক ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছেছিল লতা-হেমন্ত সম্পর্ক

১৯৪৫ সাল। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাস নিয়ে তখন হিন্দি সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে মুম্বাইয়ের ফিল্মিস্তান। পরিচালক হেমেন গুপ্ত, আর সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে কয়েকদিন রিহার্সালও দিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু রেকর্ডিং-এর সময় বাধ সাধলেন পরিচালক। একের পর এক টেক কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না হেমেন গুপ্তর। অথচ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay) নিজে তাঁর গান শুনে সন্তুষ্ট। হেমেন গুপ্তর আচরণে তিনি নিজে রেগে উঠছেন। অথচ লতা (Lata Mangeshkar) নিরুত্তাপ। পরপর ২১টি টেক দিয়ে গেলেন একটুও উত্তেজিত না হয়ে, শুধুমাত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধার খাতিরে।

ফিল্মিস্তানের সঙ্গে সেই সময় লতার সম্পর্ক ভালো ছিল না। প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় তো বলেই দিয়েছিলেন, লতা এই ছবিতে গান গাইবেন না। অথচ লতাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে ‘বন্দে মাতরম’ গানটি গাওয়ানোর কথা ভাবতেই পারছিলেন না হেমন্ত। তাই নিজেই একদিন হাজির হলেন লতার বাড়িতে। সেই থেকেই দুজনের মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পারিশ্রমিক নিয়ে কোনোরকম কথা না বলে, শুধুমাত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্যই গান গাইতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন লতা।

গানের জগত থেকে এই সম্পর্ক এসে পৌঁছেছিল ঘরের অন্দরমহলেও। হেমন্ত তখন এক বন্ধুর বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই তাঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয় লতার। হেমন্ত-বেলা দম্পতির দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময়ও তাঁরা মুম্বাইতেই ছিলেন। হেমন্ত তাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একদিন বেলা মুখোপাধ্যায়ের কাছে হাজির হলেন লতা। বললেন, গর্ভবতী মহিলাদের পছন্দের খাবার খাওয়ানোর রীতি বাঙালিদের মতোই মারাঠিদের মধ্যেও আছে। তিনি সেদিন গর্ভবতী বেলাকে তাঁর ‘সাধ’ খাইয়েছিলেন।

‘আনন্দমঠ’-এর পর অসংখ্য সিনেমায় হেমন্তর সঙ্গে কাজ করেছেন লতা। গানগুলি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু সিনেমাগুলি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ছিল। ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন হেমন্ত। ১৯৫৪ সালে ‘নাগিন’ ছবিটির সময় তিনি লতাকে বলেছিলেন, এরপর তাঁকে মুম্বাই ছাড়তে হবে। কিন্তু লতা সাহস জুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এবার অন্যরকম কিছু হবে। আর হলও তাই। প্রথম কয়েকদিন মুম্বাই শহরে হল ফাঁকা যাচ্ছিল। কিন্তু তার মধ্যেই খবর পাওয়া গেল উত্তরপ্রদেশের হলগুলিতে হাউসফুল ‘নাগিন’। কয়েকদিনের মধ্যেই ভিড় বাড়তে শুরু করল মুম্বাইয়ের হলগুলিতেও।

আরও পড়ুন
হেমন্তকণ্ঠে লোকগান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি সংস্করণ, ‘দুর্লভ’ সংকলন যুবকের

বাংলা গানের জগতেও লতা মঙ্গেশকরের আত্মপ্রকাশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। ১৯৫২ সালে প্রথমবার কলকাতা এসেছিলেন লতা। এসে উঠেছিলেন হেমন্তর বাড়িতেই। ৪ বছর পর আবার ফিরলেন কলকাতা। তবে এবার একেবারে গানের রেকর্ডিং-এর জন্যই। বাঙালি শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা গাইলেন ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’।

আরও পড়ুন
অন্য হেমন্ত : গান-ছায়াছবির বাইরের মানুষদের চোখে

সঙ্গীত জীবনে ৩০টির বেশি ভাষায় গান গেয়েছেন লতা। তবে হিন্দি এবং মারাঠি ভাষার পর সবচেয়ে বেশি গান গেয়েছেন বাংলাতেই। লতার কণ্ঠে বাংলা গানের সংখ্যা ১৮৫টি। প্রথমদিকে অবশ্য বাংলা ভাষা জানতেন না তিনি। কিন্তু বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। বাংলা শেখার জন্য বাসু ভট্টাচার্যের কাছে রীতিমতো ক্লাস করেছেন। আর প্রতিটা বাংলা গানের উচ্চারণে আর গায়কিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালিই। ১৯৫৬ সালেই ভূপেন হাজারিকার সুরে গাইলেন ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’। ’৫০-এর দশকেই সলিল চৌধুরীর সুরে গাইলেন ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি’, ‘না যেও না’, ‘ওগো আর কিছু তো নয়’। প্রতিটা গান পরে হিন্দিতেও গাওয়া হয়েছিল। হেমন্তর সুরে ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’; সুধীন দাশগুপ্তর সুরে গেয়েছেন ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ’-এর মতো বহু গান।

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলির ইতিহাস ধরে রাখছেন হেমন্ত

তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সলিল চৌধুরীর প্রতি লতার শ্রদ্ধার পাল্লাটা সবসময়ই ভারী ছিল। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কটাও পেশার জগত থেকে পৌঁছে গিয়েছিল পারিবারিক স্তরে। ৩৩ বছর আগেই সঙ্গীতের জগতকে রিক্ত করে চলে গিয়েছেন হেমন্ত। এবার সমস্ত স্মৃতি পিছনে ফেলে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকরও।

তথ্যসূত্রঃ শিল্পী ও মানুষ, লতা মঙ্গেশকর, চিরহেমন্ত

আনন্দধারা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More