বাংলা শিখবেন বলে নিজের বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর

১৯৪৮ সাল। বম্বেতে তখন নিজের পরিচিতি তৈরি করে নিয়েছেন শশধর মুখোপাধ্যায়। নিজে সিনেমা পরিচালনাও করছেন, আবার প্রযোজনার দায়িত্বও নিচ্ছেন। গোরেগাঁওয়ে তৈরি করেছেন ‘ফিল্মিস্তান’ স্টুডিও। সাদাত হসন মান্টো, ইসমত চুঘতাই, অশোক কুমার— কে না নেই সেখানে! এমনই একটা সময় শশধরবাবুর কাছে হাজির হলেন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বছর উনিশের এক তরুণীকে। মারাঠি পরিবারে জন্ম; ইতিমধ্যে বেশ কিছু মারাঠি ও হিন্দি সিনেমায় গান গেয়েছে মেয়েটি। গুলাম হায়দার ওঁকে শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। ওঁকে কাজ না দিলে হবে না। তাই নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন শশধর মুখোপাধ্যায়ের কাছে।

কিন্তু মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি সেদিন। শশধরবাবু কিছুতেই নিতে রাজি হননি মেয়েটিকে। তাঁর বক্তব্য ছিল, গায়িকার গলা অত্যন্ত পাতলা। ফলে তিনি কাজ করতে পারবেন না। এই কথা শুনে রীতিমতো রেগে যান গুলাম হায়দার। প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসেন সেদিন। তিনি জানতেন, এই মেয়ে সবার মন জয় করতে এসেছে। একদিন এমন হবে যে, পরিচালকরা ওঁর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। পৃথিবীজোড়া নাম হবে এঁর। গুলাম হায়দার খাঁটি জহুরি ছিলেন, হীরে চিনতে ভুল করেননি। সেদিনের উনিশ বছরের সেই মেয়েটির নাম লতা মঙ্গেশকর… 

এরপর ১৯৪৮ সালেই তৈরি হয় ‘মজবুর’ সিনেমাটি। লতার সেই ‘পাতলা গলা’ই গেয়ে ওঠে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’। বাকি সময় জুড়ে আপামর ভারত এক কিংবদন্তির বেড়ে ওঠার সাক্ষী থাকে। লতা মঙ্গেশকর নিজেই এক চলমান ইতিহাস। যিনি কলম দিয়ে বা যুদ্ধ করে নয়; নিজের গলা দিয়ে, সুর দিয়ে, সৃষ্টির সাধিকা হয়ে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। সত্যিকার অর্থেই সাধক তিনি। নিজেই বলেছেন তাঁর জীবন বুঝতে গেলে মীরা-কে বুঝতে হবে, শুনতে হবে। এভাবেই বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। নব্বই পেরিয়েও তিনি আমাদের সামনে জীবন্ত সরস্বতী… 

গানের জগতে পা দেওয়ার পর প্রথমদিকে এক বাঙালি পরিচালকই তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন কে জানত, এই বাংলার সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে লতা’র! সুরে সুরে বম্বে আর বাংলার মধ্যে তৈরি করবেন সাঁকো। প্রথম কোন বাংলা ছবিতে লতা প্লেব্যাক করেন, তা নিয়ে বেশ কিছু তর্ক রয়েছে। তবে মনে করা হয়, ১৯৫৬ সালে ‘অসমাপ্ত’ ছবি দিয়েই তাঁর বঙ্গবিজয় শুরু হয়েছিল। দু’দুটি গান গেয়েছিলেন তিনি। তারপর একের পর এক কালজয়ী গান। কখনও সলিল চৌধুরী, শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কখনও আবার রাহুল দেববর্মণ, বাপী লাহিড়ীর সুরে মাতিয়ে দিচ্ছেন সঙ্গীত জগত। জন্মগতভাবে বাঙালি ছিলেন না, বাংলাও বুঝতেন না। কিন্তু ভাষাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাছাড়াও, একটা ভাষায় গান গাইতে গেলে সেই ভাষা না জানলে চলে! তাহলে যে গানটাকেই ছোঁয়া যাবে না! শুধু বাংলা শিখবেন বলে বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। শিক্ষক হয়েছিলেন বাসু ভট্টাচার্য। দায়সারাভাবে নয়; রীতিমতো লিখতে ও পড়তে যাতে পারেন সেই চেষ্টাই করেছিলেন তিনি… 

সেই সময় বম্বেই হোক বা টলিপাড়া— বাঙালি সুরকারদের জয়জয়কার সর্বত্র। লতা মঙ্গেশকরও জড়িয়ে গিয়েছিলেন সেই পরিবারের সঙ্গে। সেইসূত্রেই পরিচয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। একসময় দুই পরিবারের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। লতা’র কাছে ঠিক কতটা আপন ছিলেন ‘হেমন্তদা’, সেটা বেশ কিছু ঘটনা থেকেই জানা যায়। ১৯৫১ সাল। পরিচালক হেমেন গুপ্ত বম্বেতে ডেকে পাঠালেন হেমন্ত-কে। তাঁর ইচ্ছে, পরবর্তী সিনেমা ‘আনন্দমঠ’-এর সুরের দায়িত্বে থাকবেন তিনি। বাংলায় কাজকর্ম মিটিয়ে বম্বে চলে গেলেন হেমন্ত। হাজির হলেন ফিল্মিস্তানে। শশধর মুখোপাধ্যায় তাঁকে সঙ্গীত পরিচালকের চাকরি দিলেন। ‘বন্দে মাতরম’ গানটা তিনি গাওয়াবেন লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে। শশধরবাবুকে বলতেই তিনি বললেন, লতা হয়তো আসবেন না। পুরনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর? 

এদিকে হেমন্ত তো ঠিক করে ফেলেছেন, এই গান লতা ছাড়া কারোর গলায় গাওয়াবেন না একবার চেষ্টা করে দেখলেই তো হয়! শশধর মুখোপাধ্যায় নিমরাজি হলেন। লতা মঙ্গেশকরের কাছে যাওয়ার পর তিনি একটাই কথা বললেন। ‘আমি ওখানে গাইব না ঠিক করেছি, কিন্তু শুধু আপনার জন্যই গাইব’। আর টাকা? না, লতা’র টাকা চাই না। তিনি শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করতে চান। এমনকি, রিহার্সাল দিতে সটান চলে গেলেন হেমন্ত’র বাড়ি; যা লতা’র স্বভাববিরুদ্ধ। এমনই ছিল সম্পর্ক… 

আরও পড়ুন
‘শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি’, ভারত-চিন যুদ্ধে গানই হাতিয়ার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

এখানেই থেমে থাকেনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। লতা মঙ্গেশকর তাঁর প্রাণের বান্ধবী। এই সময় বাঙালিদের মধ্যে সাধ খাওয়ানোর রীতি থাকে। লতা নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজটি করলেন। হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন তাঁর বান্ধবীকে। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সেই হেমন্ত-সন্ধ্যার কথা কে ভুলতে পারবে! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। খানিক ইতস্তত করেই লতা’কে ফোন করেছিলেন হেমন্ত। যদি আসতে পারেন! ফোনের ওপাশ থেকে নিজেই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন সুরের সরস্বতী। তাঁর ‘হেমন্তদা’র’ গানের পঞ্চাশ বছর পূর্তি, আর তিনি আসবেন না তা কি হয়! অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে প্রবল শরীর খারাপ হয় তাঁর। হয়তো আসতেনই না। কিন্তু ওই যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুষ্ঠান বলে কথা। লতা না এসে থাকতে পারে! 

তথ্যসূত্র—
১) ‘ভাল কথা পছন্দ হলেই বাংলা গানের রেকর্ডিং শুরু করবেন লতা’, স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘ঝগড়া সত্ত্বেও শুধু হেমন্তের জন্য ফিল্মিস্তান স্টুডিও-য় গান গেয়েছিলেন লতা’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘আমার মা কে সাধ খাইয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর’, রাণু মুখোপাধ্যায় ও স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
৪) ‘চেনা আলো চেনা অন্ধকার’/ বিমোচন ভট্টাচার্য
৫) ‘স্বর্ণকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর’, শাহনেওয়াজ, সময়ের আলো 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
৩০ বছর আগে প্রয়াত শিল্পীর গানেই স্বৈরাচার থেকে মুক্তির স্বপ্ন বুনছে বেলারুশ