অমলা বাড়ি ফিরে দেখলেন শূন্যগৃহ

আলমোড়ায় সদ্য-আসা অমলার সেই দিনগুলো মনে পড়ে। কথায়-কথায় অমলাকেই প্রয়োজন উদয়ের। এক ঘর লোকজন, নিজের বসার জায়গাটি খুঁজে পেলেন ঠিক অমলার পাশটিতেই। প্রাক-বিবাহপর্বে অমলাকে লেখা চিঠিতে যোগ্য স্বামী হতে চেয়েছিলেন উদয়শঙ্কর, চেয়েছিলেন সে যাত্রাটিতে প্রেম হোক তার সহায়। নিজের সমস্ত অভ্যস্ত উৎকেন্দ্রিকতাকে পরিহার করে উদয় এসেছিলেন অমলার কাছে। তারপর সেই সুরলোকের বিবাহ। আলমোড়ার বিদ্রুপ-কুৎসা থেকে একদিন অমলাকে আগলে রেখেছিলেন তিনিই। সেই ঝঞ্ঝাতেও অমলার প্রতিভাকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন জগৎসভার বিরাট আসনটিতে। শত সংকটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তখনও বলতে পারতেন, ‘উফ, তোমাকে ছাড়া থাকতে যে আমার কী কষ্ট হয়!’

সেই আলমোড়া, সেই কাছে-আসতে-চাওয়ার আকুলতা, সেই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ভেসে গেল সব। ‘কল্পনা’র একটি পাঠ দেশ ও সমাজ-সংস্কার। আরেক অন্তর্লীন পাঠ বুঝি অমলা-উদয়ের প্রেম-যাত্রা। ‘মেরি বনোগি’-র সেই আকুতি গমগম করতে থাকে পর্দা জুড়ে। হৃদয় নিঙড়ে ডেকে চলেছে উদয়ন, উমা কি দেবে সাড়া? প্রেমের চালচিত্রেই অলঙ্কৃত হয়ে উঠছে জীবনপ্রবাহ। মান-অভিমান দাম্পত্যের সহচর। অহং আর দূরত্ব, সেও ভুল বোঝাবুঝির ক্রমান্বয়ে হাঁটে। কিন্তু সন্তর্পণে যে এসে দাঁড়াল, সে কাঁপিয়ে দিল বুকের ভেতরখানা। অন্যন্যোপায় এক বিভেদ এসে প্রেম-সম্বন্ধ আর যোগাযোগে তুলে দিয়েছিল দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর। নিষেধের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অমলা দেখতেন তাঁর স্বামীকে। সমস্ত পৃথিবীতে প্রেমের সাক্ষ্যে যে মানুষটা একমাত্র তাঁরই। সেই অলঙ্ঘনীয় দূরত্বে দাঁড়িয়েই তাঁরই সংসারে একদিন দেখলেন, স্বামীর কাছে এলেন অন্য নারী। লোকে বললে, রুখে দেওয়া দরকার এ অনধিকার প্রবেশ। প্রেম যে অনিবার অধিকারে ভূষিত করে সম্বন্ধকে, অপ্রেম তো অস্তিত্বহীন করে দেয় তাকে। তাহলে কার বিরুদ্ধে কার কাছে নালিশ। নিজের শোক আর হাহাকারের ওপর সম্ভ্রমের কপাট তুলে দিলেন অমলা।

অমলা দেখলেন, বাড়িতে লোকজন আসছে, পৃথক থাকার জন্য নতুন বাড়ি খুঁজছেন উদয়শঙ্কর। কিন্তু সেই দিনটা সত্যিই আসবে বোধকরি বিশ্বাস করতে চায়নি তাঁর মন। সেদিন রবিবার। দুপুরবেলা অমলা ফিরলেন তাঁর নাচের স্কুল থেকে। দেখলেন শূন্যগৃহ। উদয়শঙ্কর নেই। নেই তাঁর প্রয়োজনীয় যাবতীয় কিছু। গৃহকর্ম সহায়ক জানাল, চলে গিয়েছেন গৃহকর্তা। অমলা দাঁড়িয়ে রইলেন স্তম্ভিত।

'কল্পনা' ছবিতে 'মেরি বনোগি' সংলাপের দৃশ্য।

 

আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের কাছ থেকে দর্শক ফিরলেন শূন্য হাতে

শুরু হল নতুন লড়াই, নতুন পথচলা। সন্তানদের নিয়ে কর্মব্যস্ততার মাঝে ঝাঁপ দিলেন অমলা। কিন্তু এ দেশে শুধু তো শোক আসে না, শোকের অবিচ্ছেদ্য পরম্পরায় এসে পৌঁছয় অস্বাভাবিক ঔৎসুক্য। কুতুহলি চাহনি। আজব জল্পনা, মন-গড়া গল্পগাথা। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যাকে দস্তুরমতো একটা ছাঁচে ফেলে রফা না করতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারেন কই অত্যুৎসাহীরা! শোককে তার নিজের মর্যাদায় কবে দেখেছে ভারতীয় সমাজ? স্বামীর প্রতি অবহেলা, উদয়শঙ্করের অর্থাভাব বিচিত্র-বিস্তর গুজবে, রটনায় ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে উঠল অমলার জীবন।

আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করকে রাখা হল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে

এই সময় শিক্ষাচিন্তক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সতীকান্ত গুহ-র সঙ্গে পরিচিত হন উদয়শঙ্কর। স্থির করেন সতীকান্তের স্কুলেই তিনি শুরু করবেন এক্সপেরিমেন্টাল ডান্স ক্লাস। তাঁর থাকার বন্দোবস্তও করেন শ্রী গুহই। ১৯৭৩-এ গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়ি ছেড়ে উদয়শঙ্কর এসে ওঠেন বালিগঞ্জ প্লেসের দশতলার ফ্ল্যাটে। উদয়শঙ্কর চলে আসার আগে এসব পরিকল্পনার কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি অমলা। তবে এ পরিস্থিতিতে শুধু দুর্জনেরাই নয়, ছিল কিছু সুজনও। প্রবল এই দুর্দিনে অমলাকে আশ্বস্ত করে চিঠি দিলেন তাঁর চিরদিনের বলভরসা সেজো-জা কৃষ্ণাশঙ্কর। অমায়িক সেই মানুষটি ২৫ নভেম্বর ১৯৭৪-এর চিঠিতে লিখলেন, ‘…সত্যই অনুভব করতে পেলাম কত অসুবিধার মধ্য দিয়ে তোমায় চলতে হচ্ছে। তোমার কথা ভেবে আমরা সকলে তোমায় বাহাদুরি দিয়ে থাকি। কি জানি ভগবান তোমায় কি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা দুজনে কায়মনে প্রার্থনা জানাই তুমি যেন তাঁর পরীক্ষায় জয়ী হও…’। ‘আমরা দুজনে’ শব্দটি দৃঢ়, নিরপেক্ষ ভাবে উদার। অর্থাৎ উদয়-অমলার পৃথক হবার মুহূর্তে শুধু কৃষ্ণাশঙ্করই নন, অমলার পাশে রইলেন উদয়শঙ্করের সহোদর দেবেন্দ্রশঙ্করও।

আরও পড়ুন
একাকী ভ্রমণ বদলে দিল অমলার জীবন

উদয়শঙ্করের জীবনে তখন একটা সমস্যা বুনে তুলতে লাগল অন্যান্য সমস্যাসমূহকে। এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্যে এলেন যাদের বিবেচনা-পরামর্শকে সাধ্যমতো এড়িয়ে চলাই সমীচীন, তিনি আশ্রয় করলেন তাদেরই। চিরদিন অর্থমোহ থেকে নিজেকে রাখতেন যোজন-তফাতে। অমলা জানিয়েছিলেন, অথচ সেই তাঁরই এসময় তৈরি হল অর্থের প্রতি ‘অদ্ভুত একটা আকর্ষণ’। কখনও-কখনও অমলার বিরুদ্ধে অভিযোগ হেনে চিঠি লিখলেন বাইরের মানুষজনকেও। বেদনাহত হলেন অমলা, কিন্তু  ফিরিয়ে দিলেন না আঘাত।    

আরও পড়ুন
নিজের প্রৌঢ়ত্বের সামনে উদয় দাঁড়ালেন দ্বিধাদীর্ণ

আনন্দশঙ্কর ও তনুশ্রীশঙ্করের বিবাহ-অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায় ও অমলাশঙ্কর।

 

আত্মীয়স্বজনরা যেতেন উদয়শঙ্করের কাছে, গাড়ি করে কখনও তাঁদের পৌঁছে দিতেন অমলা। তাঁরা চলে যেতেন ওপরে    অথচ উদয়শঙ্করের কাছে যাবার পথ রুদ্ধ অমলাশঙ্করের। বাবার কাছে যেতেন তাঁর সন্তানরা। যে কোনো বড়োকাজে যুক্ত হবার আগে প্রণাম করে আসতেন তাঁরা। সন্তানদের প্রতি তাঁর স্নেহ অবিচল থাকলেও সবসময় সহজ হতে পারেনি পরিস্থিতি। আনন্দশঙ্করের বিবাহের আগে অমলা গিয়েছিলেন উদয়ের কাছে। শুভ অনুষ্ঠানে তাঁর আশীর্বাদ আর অনুমতিটুকু নিতে। নিমন্ত্রণপত্রে, অমলা রাখলেন গৃহকর্তারই নাম। কিন্তু পুত্রের বিবাহানুষ্ঠানে এলেন না উদয়শঙ্কর।

জীবনের অন্তিম পর্বে এসে চূড়ান্ত ব্যর্থতা আর রূঢ় অসম্মানের সামনে দাঁড়াতে হল উদয়শঙ্করকে। সফল হতে পারেনি সাউথ পয়েন্ট স্কুলের এক্সপেরিমেন্টাল ডান্স ক্লাস, সেই মর্মে আর্থিক ক্ষতিস্বীকার করে উদয়শঙ্করকে বহাল রাখতে রাজি নয়, জানাল কর্তৃপক্ষ। ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এল তাঁর আশ্রয়ের অধিকারটিও। ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৫, উদয়শঙ্করকে পত্রাঘাত করলেন স্কুলের রেক্টর সতীকান্ত গুহ। লিখলেন, ‘আপনার অনুরোধে যে এক্সপেরিমেন্টাল ডান্স ক্লাস শুরু করা হয়, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার জন্য প্রতি মাসে এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির ভার অত্যন্ত বেশি। … আমি শুধু বলতে চাই প্রতি মাসের ক্রমবর্ধমান আর্থিক লোকসান এবং যে সব অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি কাজ ব্যাহত করছে তার কথা। আপনার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা সত্ত্বেও এই লোকসান মেনে নিয়ে প্রতিষ্ঠান যে ক্লাস চালিয়ে যাবে তা আশা করা আমার পক্ষে অনুচিত।’ তারপর লিখলেন, ‘অতএব ওই চুক্তি তিন মাসের নোটিশে বাতিল করা ছাড়া আমার আর কোনও পথ নেই। আপনি যদি চান তা হলে এই নোটিশের পরিবর্তে যে কোনও দিন তিন মাসের মাইনে নিয়ে যেতে পারেন।’

পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে উদয়শঙ্কর।

 

মনে পড়ে উদয়শঙ্করের খ্যাতি, তাঁকে নিয়ে পৃথিবী জুড়ে তাবড় গুণীদের উচ্ছ্বাস, সর্বোপরি আলমোড়ার রাজাধিরাজ উদয়শঙ্করের মূর্তি। তার পাশে এ চিঠি রাখলে শিউরে উঠতে হয়। চিঠি শেষ হল এই বার্তায়, ‘যদিও একটি প্রসঙ্গ এড়াতে চেয়েছিলাম, আমি বাধ্য হয়েই আপনাকে অন্য কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করার জন্য বলছি, কারণ তিন মাসের নোটিশের শেষে (আমাদের) প্রতিষ্ঠানকে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে।’

আমরা বললাম বটে, উদয়ের সেই হীরকমণ্ডিত অতীতের সাপেক্ষে শিউরে উঠতে হয় এই পত্রে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে গেল অনুরোধ-উপরোধ, চিঠিতে নিজের অবমাননাকে সীমাহীন করে তুললেন স্বয়ং উদয়শঙ্কর। ১১ মার্চ ১৯৭৫-এর পত্রে তিনি লিখলেন, ‘আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ এবং যতদিন বেঁচে আছি আপনি আমার জন্য যা করেছেন তা কখনই ভুলব না।  …আমি একেবারে অসহায় এবং বৃদ্ধ বয়সে কোথায় কী করে থাকব সেই ভেবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। ... এরকম দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে আমাকে কখনও যেতে হয়নি। এপ্রিল’৭৫-এর পরে যে আমার থাকার কোনও জায়গা বা খাওয়াপরার অর্থ থাকবে না সেই ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে আছি।’ শেষে একথাও জানাতে দ্বিধা করলেন না, ‘আমি আমার পরিবারের সঙ্গে থাকতে ফিরে যাব না। দয়া করে আমাকে উপার্জন এবং থাকার অন্য ব্যবস্থা করার জন্য আরেকটু সময় দিন।’

দেশিকোত্তম প্রদান অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে উদয়শঙ্কর।

 

শুধু একটি চিঠিতেই নয় নানা চিঠিতে এবং নানান সংবাদপত্রেও উদয়শঙ্কর দাবি করলেন তাঁর অর্থাভাবের কথা। খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন বহু চেনা-পরিচিত মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাড়ি ফেরার পথে বাধা নেই কোনো, পরোক্ষে আশ্বাসবার্তা পাঠান অমলাও। অথচ অভাবটা সত্যই অর্থের নয়, অভাব তখন এক স্থির, সামঞ্জস্যপূর্ণ চিত্তের। এই পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়েছিলেন অমলাশঙ্কর, এর আগেই উদয়শঙ্কর গ্রহণ করেছেন বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘দেশিকোত্তম’। প্রোডিউসার এমেরিটাস হিসেবে আকাশবাণী থেকে প্রতি মাসে লাভ করেন সাম্মানিক। মাসিক বৃত্তি পেতেন তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রক এবং শ্রীরাম ফাউন্ডেশন থেকেও। তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সহায়তা প্রদান করেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী।

অভাবের কথা প্রচার হওয়ায়, পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৭ দাদাকে সতর্ক করে চিঠি লিখলেন ভাই রাজেন্দ্রশঙ্করও। লিখলেন, ‘সম্প্রতি কিছু কাগজে, এমনকী টাইমস-এও তোমার দুরবস্থার কথা লেখা হয়েছে— অত্যন্ত কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে এখনও। আমি খবর পেয়েছি যে দিল্লির সরকারি মহলে এর প্রভাব খুব একটা ভাল নয়। ওদের ধারণা যে ওদের সব সাহায্যের পরেও যদি খবরের কাগজ বলে যে তোমার খাবার জুটছে না, তাহলে কোনও কিছুই (তোমার পক্ষে) যথেষ্ট হবে না। ... সংবাদপত্রের (প্রতিনিধিদের) সঙ্গে যদি তোমার দেখা হয় এবং সরকার ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য এবং সমবেদনার জন্য তুমি যদি ধন্যবাদ জানাও তা হলে বোধহয় ভাল হবে। খেতে পাচ্ছ না, খুব কষ্টে আছ— এইসব মিথ্যা গুজব যদি একবার খণ্ডন কর, তা হলে পত্রপত্রিকারাও এই খবর রটানো বন্ধ করে দেবে।’ শেষে লিখলেন, ‘জীবনের শেষ পর্যায় পৌঁছে আমরা সকলেই একই শান্তি আর নির্লিপ্ততা খুঁজি। ... ওরা যা সব লিখেছে তা যে তুমি কখনই বলতে পার না আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত…’। শান্তি আর নির্লিপ্ততার বার্তায় অগ্রজকে দিশা দেখাতে চাইলেন রাজেন্দ্র। এ অসত্যকথন উদয়ের বলে বিশ্বাস করেন না তিনি, এ কথায় উদয়ের উজ্জ্বল চারিত্র্যটিকেও স্মরণ করাতে চাইলেন তিনি। শিল্পী মৃত্যূত্তীর্ণ--- কিন্তু জীবৎকালেই শিল্পীসত্তার কী বেদনাদায়ক এ আত্মখণ্ডন, এ আত্মসংহার।

Powered by Froala Editor