একটি দীর্ঘশ্বাসের গল্প: মারাদোনা এবং কলকাতায় কিছু ভিজে যাওয়া চোখ

ব্রাজিল সমর্থক হয়েও ’৯৪-এর ফুটবল বিশ্বকাপ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল টিঙ্কুদা। সেবার ব্রাজিল বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও আনন্দ করেনি সে। কারণটা বিশ্বের ফুটবল ময়দানের চিরশত্রু দেশের এক ফুটবলার, দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। এবং গল্পের শুরুটা সেই বিশ্বকাপ থেকেই। গ্রিসের বিরুদ্ধে তাঁর গোল, পাশের বাড়ির ছেলেটার মতো তাঁর সেলিব্রেশন যেন আমাদেরও। কাকার তো আমাকে কোলে তুলে ‘সাজন’ সিনেমার গান চালিয়ে সে কি আনন্দ! টিঙ্কুদাও সেদিন খুশি। তার প্রিয় দল ব্রাজিল, প্রিয় প্লেয়ার মারাদোনা। তখন কে জানত, অমন ট্র্যাডিজি ঘটে যাবে! অথচ নিষিদ্ধ হওয়ার পর তিনি ফিরেছিলেন। সেই ’৯১-এর মার্চে বারির বিপক্ষে অভিশপ্ত ম্যাচ। কোকেন টেস্ট। রিপোর্ট পজিটিভ আসা। মাদকদ্রব্য রাখার এবং বিতরণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ফিফার আদেশে ১৫ মাসের ব্যান। সবই তো সহ্য হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। নিষেধাজ্ঞার সময় ইন্ডোর ফুটবলে ব্যস্ত ছিলেন দিয়েগো। খবরের কাগজে কিংবা দূরদর্শনের রাত এগারোটার বুলেটিনে কখন বলবে তাঁর খবর, তা নিয়ে তো তখন লম্বা অপেক্ষা। এরই মাঝে খবর, বার্সেলোনা থাকার সময় মাদক সমস্যায় ভুগছিলেন মারাদোনা। সে-সময় প্রথম পরিচয় ‘ড্রাগজি’ (druggie) শব্দটার সঙ্গে। ধুত্তোর! এসব কঠিন কঠিন কথা তখনকার ছোট্ট আমিটা বুঝবে কীভাবে! টিঙ্কুদাই পরিষ্কার করে সহজ বাংলায় বলে দিয়েছিল, এসব নাকি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের চক্রান্ত। কিন্তু ’৯৪ বিশ্বকাপের ওই ঘটনা আমাকে চূর্ণ করে। তছনছ করে। মারাদোনাই তো আমার মতো অসংখ্য অজস্রকে ‘আর্জেন্টিনীয়’ বানিয়েছেন। নুতোদা, রাজুদারা নিজেকে দ্বৈতনাগরিক বলত। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেয়ারের এমন পরিণতি আমাদের শূন্য করে― আরও শূন্য করে।

কোনো ধরনের পক্ষপাতকেই পছন্দ ছিল না আমাদের পরিবারের। সেই কারণেই হয়তো ছোটো থেকে স্টারিওটাইপিক্যাল বা বাঁধাধরা চিন্তাভাবনার অবকাশ পাইনি। আসলে ছাঁচটাই অমন তৈরি হয়ে গিয়েছিল বাবা-মায়ের পাখি পড়ানোর মতো করে নীতিজ্ঞান শেখানোর সময়পর্ব থেকেই। মনে পড়ে, নাইজেরিয়া ম্যাচের পর যখন চাউর হয়ে গেল মারাদোনা আর মাঠে নামবেন না, বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ— বাড়িতে যেন অঘোষিত ‘অশৌচ’ শুরু হল। বাবার হাল দেখে মাকে দেখেছি কোনো রকমে আলুসেদ্ধ ভাত বসাতে। বাবা বাজার পর্যন্ত যেত না। বললেই খেঁকিয়ে উঠত। বাড়ির তাকে শোভা পেত মারাদোনার একটা ছবি। নামাবলি পরা বিখ্যাত সেই ছবিটা। তা কিন্তু আগের মতোই রাখা ছিল। বাবা বলত, ওর (মারাদোনা) হয়তো সবচেয়ে বড় দোষ ছিল ওর বিশ্বাস এবং আদর্শ। ফাঁসিয়ে দেওয়া হল ওকে।

গ্রিসের বিরুদ্ধে গোল করবার পর সেই বিখ্যাত সেলিব্রেশন

 

বাবা আরো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিল। গ্রহের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী দেশের বিশ্বকাপে বিদায় নিতে হল মারাদোনাকে। বুঝিনি অতকিছু। এখন বুঝি, মানুষ কতটা চটজলদি সবকিছু ভুলে যেতে পারে। আর্জেন্টিনা তখনো ’৯৪ বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। একদিকে লা আলবিসেলেস্তেও টুর্নামেন্টের যোগ্যতা অর্জনের জন্য লড়াই করছিল। অন্যদিকে, খাস কলকাতায় আসন্ন ফুটবল মরশুমকে কেন্দ্র করে দলবদলের সময় আলোচনায় সবুজ-মেরুন জার্সিধারীদের ক্লাব। কারণ, ১৮ বছরের এক দক্ষিণী তরুণকে সই করিয়েছে মোহনবাগান। জো পল আনচেরি। ওই মরশুমে সেরা ফর্মে ছিলেন। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন তাঁকে বর্ষসেরা ফুটবলার হিসাবে মনোনীতও করে। তা এমন এক প্রতিভাবান ফুটবলারকে দলে নিয়ে ভারতীয় ফুটবলে আলোড়ন তুলে দিয়েছে বাগান। ওই বছর মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন তনুময় বসু। বেশ শক্তপোক্ত দলও গড়েছিল। আই এম বিজয়ন, অলোক মুখার্জি, সুদীপ চক্রবর্তী, হেমন্ত ডোরা, ক্রিস্টোফার, আকিল আনসারি, সত্যজিৎ চ্যাটার্জিদের মতো তারকারা দলে। আট বছর ডুরান্ড জেতেনি দল। লক্ষ্য আট বছরের সেই অধরা ট্রফি জেতা। তাছাড়াও রয়েছে সিকিম গোল্ড কাপ, ফেডারেশন কাপ, কলকাতা লিগ। কিছু খেলা দেখানো হবে DD1, DD Sports-এ। মোহনবাগানের মতো ট্রফি নির্ভর ক্লাব দল গড়েই ট্রফি জেতার জন্য। হামেশাই তখন সংবাদপত্রে এসব খবর শোভা পেত ’৯৪ বিশ্বকাপের খবরের সঙ্গে। ওই বছর ইস্টবেঙ্গলও কিন্তু আলোচনায় ছিল, ফুটবল নয়, ক্রিকেটের কারণে। কপিল দেব, শচীন তেন্ডুলকর, অজয় জাদেজা, প্রবীণ আমরের মতো স্টার ক্রিকেটাররা লাল-হলুদ দলে ছিলেন। ইডেন গার্ডেন্সে অনুষ্ঠিত ফাইনালে মোহনবাগানকে হারিয়ে পি সেন ট্রফি জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। যদিও এই ট্রফি বিশ্বকাপের আগে হয়েছিল নাকি পরে, তা মনে পড়ছে না। 

আরও পড়ুন
মেসিময় সান্ধ্যনগরী

মেডিক্যাল নার্সের সঙ্গে মাঠের বাইরে যাচ্ছেন মারাদোনা

 

আরও পড়ুন
মান্না পাঁচালি

যাই হোক, হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের খাস কলকাতায় খবর পৌঁছে গেছে, বোধহয় আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে খেলতে পারবে না। তার ওপর বুয়েনস আইরেসে কলম্বিয়ার কাছে ০-৫ গোলে হেরে গেল তারা। অথচ কোকো বেসিল ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আর্জেন্টিনা দারুণ দলও তৈরি করেছে। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, দিয়েগো সিমিওন এবং অভিজ্ঞ ক্লাউদিও ক্যানিজিয়া কে নেই সেই দলে! সহজেই বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করবে, এমনটা তো ধরেই নিয়েছিল সবাই। কিন্তু বাস্তবটা একটু বেশিই যেন কঠিন। তাই অবশেষে এল সেই ডাক― দেশের প্রধান অস্ত্রকে আহ্বান―  যেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা― মারাদোনাকে ডেকেছিল আর্জেন্টিনা। একজন দেবদূতের মতো নশ্বরদের প্রার্থনার উত্তর দিয়ে মারাদোনা তাঁর দেশকে বাঁচাতে ফিরে আসেন। এমন ইতিহাস ক’জনেরই বা আছে! এসব কি কোনোদিন বুঝবেন ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়াদারির লোকজন? মারাদোনা আসার আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম লেগের অ্যাওয়ে ম্যাচে ১-১ গোলে ড্র করেছিল আর্জেন্টিনা। আর জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির পর তাঁর দেশকে বুয়েনস আইরেসে ১-০ ব্যবধানে জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই দিয়েগোই।

আরও পড়ুন
আইনের ফাঁক গলে গোল

’৯৪-এর প্রেস কনফারেন্স। ছবি সূত্র: এপি প্রেস অ্যাসোসিয়েশন

 

আরও পড়ুন
জাতীয় লিগে প্রথমবার সেরা হওয়ার জমাটি মুহূর্তগুলি

দূরদর্শনে প্রথম খবরটা পাওয়া গেল। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে খেলবে। তা কি আনন্দ! বাবা পরের দিন সকাল হতেই বাজার থেকে আনল গলদা। মোহনবাগান-আর্জেন্টিনা-মারাদোনা মিশে একাকার। কিন্তু আচমকা... ছন্দপতন। মারাদোনা ফেব্রুয়ারিতে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে তুলে নিলেন। মাত্র এক লাইনেই খবর সেরে খালাস তখনকার বাংলা সংবাদমাধ্যম। দু-দিন পর কাগজে বেরোলো, তাঁর ওপর খুব বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে। আর আর্জেন্টিনার জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে মানসিকভাবে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না মারাদোনা। সেই সময় কাগজ এলেই শেষের পাতায় মারাদোনাকে নিয়ে খবর খুঁজতাম। জানা গেল, মারাদোনার বাড়ির বাইরে হত্যে দিয়েছিল প্রেস। কিন্তু কেস ঘুরল অন্য দিকে। একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন মারাদোনা। সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্ভবত দুর্ব্যবহারও করে ফেলেছিলেন। থানা-পুলিশ, আইন-আদালত কিছুই বাদ যায়নি। আর আমরা চুপচাপ প্রার্থনা ছাড়া কিই বা করতে পারি তখন! জুনের বিশ্বকাপের আগে সব ঠিক হয়ে যাবে। এটুকুই আশা। মারাদোনা খেলবেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপে। মনেপ্রাণে এটাই চাইছিল সক্কলে। সবকিছু ঠিক হয়েওছিল। আর তারপর পুরো ছবিটাই পাল্টে গেল। পাড়া সেজে উঠল আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে। আর স্কুলপাড়ার কাছাকছি বিক্রি হওয়া শুরু হল মারাদোনার ছবি দেওয়া জার্সি। যা মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয়েছিল।

মারাদোনা ১৯৯১। মাদকদ্রব্য রাখার এবং বিতরণের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর বুয়েনস আইরেস পুলিশ স্টেশন ছেড়ে বেরোচ্ছেন। ছবি সূত্র: এপি প্রেস অ্যাসোসিয়েশন

 

 

সত্যিকারের শিল্পী যাঁরা, তাঁরা বার্ধক্যকেও অতিক্রম করে। বিশ্বকাপে মারাদোনা হয়তো এমনই কিছু প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। বিশ্বকাপের তাদের প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল গ্রিসের। ফক্সবারো স্টেডিয়ামে। প্রায় ৫৫ হাজার দর্শকের সামনে। টিভিতে আমার প্রথম বিশ্বকাপ দেখা― থুড়ি, মারাদোনাকে দেখা। গাঢ় ‘কালো’ জার্সি পরে খেলেছিল আর্জেন্টিনা। তখন আমাদের ওনিডা কোম্পানির সাদা-কালো টিভি। গাঢ় নীল জার্সিটাকে গাঢ় কালোই মনে হয়েছিল। তখনই জাদুকরকে মঞ্চে, মানে খেলার মাঠে বল পায়ে প্রথম লাইভ দেখা। যে নিন্দুকেরা তাঁর বিরুদ্ধে ‘আত্মধ্বংসে’র অভিযোগ করেন, এই ম্যাচে পেনাল্টি বক্সের সামান্য বাইরে থেকে গোল করে তাঁদের জবাব দিয়েছিলেন মারাদোনা। পরিষ্কার মনে আছে, গ্রিসের পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে ছ’টি ওয়ান-টাচ পাসে বল এসে পড়বি তো পড় এক্কেবারে মারাদোনার বাঁ-পায়ে। সামান্য একটু টাচ দিয়েই নিজেকে অরক্ষিত করে বাঁ-পায়েই ঝটিকি শট নেন। তীরের বেগে বল চলে যায় গোলের ওপরের ঠিক বাঁ-কোনে। গ্রিসের গোলকিপার নড়তেও পারেননি। তার পরেই তাঁর সেই সেলিব্রেশন। সাইড লাইনের ক্যামেরার দিকে তাঁর ছুটে যাওয়া। মারাদোনা ছুটছেন। তাঁর পিছনে গোটা আর্জেন্টিনা দল... আমরাও তো ছুটেইছিলাম। ছুটতে গিয়ে কখন তাঁকে ছুঁয়েই ফেলেছি। দলে বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া-সহ একগুচ্ছ তারকা রয়েছেন। আর্জেন্টিনা সেবারেও ফেভারিট। অথচ মাতামাতি তাঁকে ঘিরেই। এমনকী গ্রিস ম্যাচে বাতিস্তুতা হ্যাটট্রিক করলেও আলো কেড়ে নেন মারাদোনাই। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম, সাপোর্টটা কাকে করছি, আর্জেন্টিনা নাকি মারাদোনাকে?

নিষেধাজ্ঞার সময় বুয়েনস আইরেসে ইন্ডোর ফুটবল খেলে ব্যস্ত ছিলেন মারাদোনা। ছবি সূত্র: এপি প্রেস অ্যাসোসিয়েশন

 

এরপর এক রবিবারের গল্প। মামা, দাদু সব এসে হাজির। সামনে নাইজেরিয়া। রাত জাগতে হবে। যদিও খেলা শুরু হতে উলটো পড়ল। প্রথম ১০ মিনিটের আগেই এগিয়ে গেল নাইজেরিয়া। ‘এই রে’ বলে কপাল চাপড়িয়ে বসে পড়েছে তখন মামা। মারাদোনা-প্রেমী বাবার মুখে ফিচকে হাসি। সে অতশত বিদেশি ফুটবল না দেখলেও ব্রাজিল। যাই হোক, মারাদোনা যখন আছেন, একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। এমন বলতে বলতেই ফ্রি-কিক পায় আর্জেন্টিনা। দাদু বলে উঠল, চিন্তা নেই ভাই, গোল হবে। আমি দেখলাম, ফ্রি-কিক নিতে আগুয়ান মারাদোনা। কিন্তু একি! এ যে রাম ‘চুক্কি’! শট না মেরে অদ্ভুত একটা ফলস দিয়ে বল বাড়িয়ে দিলেন এক সহ-খেলোয়াড় বাতিস্তুতার দিকে। মাটি ঘেষা শট নিলেন তিনি। বল সরাসরি গোলকিপারের কাছে। ডান দিকে ঝাঁপ দিলেও গ্রিপ করতে পারেননি তিনি। বল চলে আসে অরক্ষিত ক্যানিজিয়ার কাছে। ব্যস! স্কোর লাইন ১-১। সেই যে বেগ পেয়ে গেল আকাশি-সাদা ব্রিগেড, তা আর থামল না। ছয়-সাত মিনিটের মধ্যে আরো একটা গোল। মোটামুটি ৩০ মিনিটের মধ্যেই স্কোর লাইন বদলে হল আর্জেন্টিনার পক্ষে ২-১। খেলা শেষের বাঁশি বাজার সময়ও ওই রেজাল্টই রইল।

’৯৪ বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত মারাদোনা। ছবি সূত্র: এপি প্রেস অ্যাসোসিয়েশন

 

কিন্তু কিন্তু কিন্তু... ম্যাচের একদিন পরের সকালটা অন্যরকমই শুরু হল। যেই আনন্দ করতে গেছি, থামিয়ে দিয়েছিল মামা। বলেছিল, চুপ কর। আনন্দ পরে। কাগজ দেখ। একটা স্টিল ছবি পরের দিন আনন্দবাজার ছেপেছিল। মারাদোনাকে একজন মেডিক্যাল নার্স ড্রাগ টেস্টিং এলাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে বিবিসির ম্যাচ ক্লিপিংয়ে এই ঘটনা নজরবন্দি করেছি বড় বয়সে। নাহ, এই দৃশ্য বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে মোটেও চেনা নয়। তবে, মারাদোনা কিন্তু যথেষ্ট হাসিখুশি ছিলেন। মাঠ ছেড়ে বেরোনোর সময় দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বেশ হাসেনও। সেই মেডিক্যাল নার্স তখনও মারাদোনার বাঁ-হাতটি ধরে। দিয়েগোর ডান হাতে আকাশি রুমাল। বিশ্বাস করুন, একবারের জন্যও ড্রাগ টেস্ট-ফেস্ট নিয়ে মাথাই ঘামাইনি। বরং মন তখনো উড়ছিল। কারণ, আর্জেন্টিনা নকআউট পর্ব নিশ্চিত করেছে। কে জানত, এই ঘটনার চারদিন পর এতটা খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে... ফিফা প্রেসিডেন্ট শেপ ব্লাটারের ঘোষণায় জানা গেল, মারাদোনার প্রস্রাবের নমুনা ইতিবাচক। নাইজেরিয়া ম্যাচে ডোপিং কন্ট্রোলের শর্ত লঙ্ঘন করেছেন মারাদোনা। তাই বিশ্বকাপে আর মাঠে নামতে পারবেন না তিনি।

বালক বয়সের ছেলেরা যেমন হয় আর কী! রাগ-দুঃখ-আনন্দ সবটাই তখন প্রকট। যাঁর জন্য এত পাগলামো, যাঁকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বকাপ দেখতে বসা, শৈশবের সেই নায়কই কিনা... মারাদোনা যেন ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে হত্যা করেছেন। তিনিই দোষী― ইফিড্রিন পজিটিভ― খেলা থেকেও যে এত দুঃখ মেলে, এই ঘটনা না ঘটলে জানতেই পারতাম না। সেই দুঃখ জুড়িয়েছিল বিশ্বকাপের পরে ভরা ভারতীয় ফুটবল মরশুমে মোহনবাগানকে দারুণ খেলতে দেখে। ওই মরশুমে তনুময় বসুর নেতৃত্বে কলকাতা ফুটবল লিগ, সিকিম গভর্নর্স গোল্ড কাপ, ডুরান্ড কাপ এবং ফেডারেশন কাপ জিতেছে। কিন্তু মারাদোনা? বড় হয়েছি যত, তাঁর জীবন সম্পর্কে যত জেনেছি, ক্ষমাও করে দিয়েছি তাঁকে। কথায় আছে― তাপসের ক্রোধহীনতা, ধর্মের ছলহীনতা এবং বলবানের ক্ষমা স্বভাবের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূষণ। এভাবেই জেনেছি যে, কর্মক্ষমতা-বর্ধক ইফিড্রিন হাঁপানি রোগীরা তাঁদের শ্বাসযন্ত্র পরিষ্কার করতে গ্রহণ করেন। এটি ওজন কমাতেও সহায়ক। বোস্টনে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে নামার আগের দিনগুলিতে সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন মারাদোনা। নাক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর থেকে রেহাই পেতে ‘দ্য প্রফেসর’-এর সাহায্য চেয়েছিলেন মারাদোনা। প্রফেসর ছিলেন ফার্নান্দো সিগনোরিনি। মারাদোনার দীর্ঘদিনের ট্রেনার। ড্যানিয়েল সেরিনির সঙ্গে তিনি ’৯৪ বিশ্বকাপের ১২ মাস আগে থেকে ব্যক্তিগতভাবে মারাদোনার ফিটনেস দেখাশোনা করছিলেন। তো তাঁরা কীভাবে এই ওষুধ মারাদোনাকে দিয়েছিলেন, তা এখনো কুয়াশায় ঢাকা। কুয়াশা কেটে গেলেই ঝকঝকে আকাশ। মারাদোনার জীবনও তেমনই। বারবার তাঁর জীবন কুয়াশায় ঢেকেছে, বারবার কুয়াশা কেটেওছে। এতে তাঁর ‘ঈশ্বরত্ব’ নষ্ট হয়নি। ঈশ্বরের গায়ে কলঙ্ক লেপা যায় না যে।

Powered by Froala Editor

Latest News See More