ডায়মন্ডহারবারে ‘কুমির মাছ’, বাড়ছে বিপদের সম্ভাবনা, কেন?

লম্বা, প্রশস্ত চোয়ালে সাজানো ধারালো দাঁতের সারি। সারা গায়ে শক্ত আঁশের আস্তরণ। আকার দেখলে কুমির বলেই মনে হবে যে কারোর। অথচ, শরীরে রয়েছে সাত-সাতটি পাখনা। এবার এমনই এক অদ্ভুতদর্শন মাছের দেখা মিলল ডায়মন্ডহারবার (Diamond Harbour) পুরসভার লেনিননগর এলাকার খালে।

৫ ফুট দীর্ঘ মাছটির ওজন প্রায় ৪৫-৫০ কেজি। ‘অ্যালিগেটর গার’ (Alligator Gar) নামে খ্যাত এই বিশেষ প্রজাতির মাছটি সর্বোচ্চ ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। আজ থেকে ন্যূনতম ১০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে আবির্ভাব হয়েছিল এই বিশেষ মৎস্য প্রজাতির। তারপর প্রায় অবিবর্তিত হয়েই পৃথিবীর বুকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এই প্রাণীটি। প্রাচীনতম মৎস্যপ্রজাতি হওয়ায় ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ বা ‘লিভিং ফসিল’ হিসাবেও পরিচিত ‘অ্যালিগেটর গার’।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল। এই প্রাণীটি ভারতের বাসিন্দা নয়। বরং, মূলত পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়। ফলত, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে হঠাৎ করে বাংলার বাস্তুতন্ত্রে এমন একটি জীবের আবির্ভাব হল কীভাবে? “এই ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব ভারতের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গেই খাপ খায় না। হয়তো বাইরে থেকে কোনো সময় ছোটো অবস্থায় মাছটিকে নিয়ে এসেছিলেন কোনো অ্যাকোরিয়ামপ্রেমী। এখন অন্যান্য মাছেদের এটি মেরে ফেলায় স্থানীয় জলাশয়ে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন সেটিকে”, জানালেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা ট্যাক্সোনমি বিশেষজ্ঞ ডঃ সুমিত মণ্ডল।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বরং, এই ঘটনার তলায় লুকিয়ে রয়েছে আরও বড়ো একটি সমস্যা। নদী, খাল কিংবা স্থানীয় জলাশয়ে এই ধরনের মাছের উপস্থিতি বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে রীতিমতো হুমকিসম, সেই আশঙ্কার কথাই শোনালেন ডঃ মণ্ডল। তাঁর কথায়, “প্রতিটা প্রাণীরই একটা ইকোলজিক্যাল পেরিফেরি থাকে। এই ধরনের মাছ হাইলি প্রিডেটর। এবং অন্য মাছ থেকে শুরু করে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী, কচ্ছপ— সমস্ত প্রাণীদেরই আক্রমণ করে এরা। এদের বংশবিস্তারও হয় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। এখনও পর্যন্ত বুঝে ওঠার সুযোগ নেই এই প্রাণীটি আদৌ ভারতীয় পরিবেশে বংশবিস্তার করেছে কিনা। যদি সেটা হয়ে থাকে, তবে দুর্যোগ আসন্ন।”

আরও পড়ুন
একঝাঁক নতুন প্রজাতির আবিষ্কার বাংলায়, জানাচ্ছে রিপোর্ট


আরও পড়ুন
টুইটারের পাখি ‘ল্যারি’ প্রজাতির! কে এই ল্যারি?

এই বিশেষ প্রজতির মাছটি ভারতীয় বাস্তুতন্ত্রের অংশ না হওয়ার কারণে, এই মাছটির জন্য কোনো খাদকেরও অস্তিত্ব নেই এখানে। ফলে, এই প্রাণীটি জলজ বাস্তুতন্ত্রে অন্যান্য প্রাণীদের একক খাদক বা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও প্রবল। ভারত তথা বাংলার অর্থনীতি অনেকটাই মৎস্যশিকারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সেখানেও বিপত্তি আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন
ভারতের নিজস্ব ‘জুরাসিক পার্ক’, দাপিয়ে বেড়াত ১৩টি প্রজাতির ডাইনোসর!

বাস্তুতন্ত্র এই ধরনের বহিরাগত জীবের আগমনকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘বায়ো ইনভেশন’। ভারতীয় পরিবেশে এর আগেও একাধিকবার ঘটেছে বায়ো ইনভেশনের ঘটনা। আর সেটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলে বাস্তুতন্ত্রে, তার সুস্পষ্ট উদাহরণ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে কচুরিপানার উপস্থিতিকেই। তবে এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৬ সালে সুভাষ সরোবরে পাওয়া গিয়েছিল অ্যালিগেটর গার। এবার দ্বিতীয়বার ভারতীয় পরিবেশে তার সন্ধান চিন্তা বাড়াচ্ছে জীববিজ্ঞানীদের। 

“অন্যান্য দেশে যেকোনো জিনিস আমদানির সময় সেগুলি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু ভারতে সেই পরিকাঠামো না থাকায় সহজেই বেআইনি পথে এই ধরনের প্রাণীর আমদানি সম্ভব হচ্ছে। অ্যালিগেটর গার তো বটেই পোষ্য হিসাবে এই ধরনের অন্যান্য প্রিডেটর প্রাণীগুলিকে সরকারের তরফে আইন প্রণয়ন করে নিষিদ্ধ করা দরকার”, জানালেন ডঃ মণ্ডল। তবে শুধুই কি আইন করে এই জৈববিপর্যয় আটকানো সম্ভব? এই বিপর্যয়ের জন্য আমাদের সচেতনতার অভাবকেও অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো…

Powered by Froala Editor