প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই নতুন ধানের প্রজাতি আবিষ্কার, হরিপদ কাপালী-র ‘কৃষিবিপ্লব’

১৯৯৪ সাল। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ উপজেলার আসাননগর গ্রাম। হঠাৎ করেই যেন শোরগোল পড়ে গেল সেই গ্রামে। দূরদূরান্ত থেকেই ভিড় জমাতে থাকলেন হাজার হাজার কৃষক। কেউ এসেছেন উত্তরাঞ্চল থেকে। কেউ আবার একাবারে দক্ষিণ বঙ্গভূমের বাসিন্দা। কিন্তু হঠাৎ এই পরিযায়নের কারণ কী? শোনা গেল, ঝিনাইদহেরই এক দরিদ্র কৃষক নাকি আবিষ্কার করে ফেলেছেন এক নতুন ধানের প্রজাতি। তার ফলনও যেমন বেশি, তেমন রুইবার খরচও বেশ কম। আর সবথেকে বড়ো কথা, বিনামূল্যেই তিনি বিতরণ করছেন এই অভিনব কৃষিদানা। সেই ধানের বীজ সংগ্রহ করতেই তাই এমন ভিড়।

অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? কোনো প্রযুক্তি ছাড়া, উন্নত গবেষণাগার ছাড়াই নতুন এক ধানের প্রজাতি আবিষ্কার করা সম্ভব নাকি! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। এমনটাই করে দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশের কৃষক হরিপদ কাপালী। এবং তা প্রথাগত শিক্ষা তো বটেই, ন্যূনতম অক্ষরজ্ঞান ছাড়াই। কিন্তু কীভাবে এমন এক যুগান্তকারী আবিষ্কার?

শুরু থেকেই শুরু করা যাক গল্পটা। নব্বইয়ের দশকের একেবারে শুরুর দিক সেটা। নিজের বিঘা দুয়েক জমিতে ইরি ধান বুনেছিলেন ঝিনাইদহের এই দরিদ্র কৃষক। ফসল কাটার সময় এক অদ্ভুত ঘটনা নজরে আসে তাঁর। গোটা জমিতে একই ধান রোপণ করলেও, কিছু কিছু ধান গাছের চরিত্র খানিকটা ভিন্ন। ব্যতিক্রমী সেই ধানের শিষে যেমন দানার আধিক্য বেশি তেমনই তার গড়নও অন্যান্য ধানের থেকে বেশ পুরু, মোটা। 

এই বিশেষ ধানগুলিকেই শনাক্ত করে পৃথকভাবে তাদের বীজ সংগ্রহ করেন হরিপদ কাপালী। ঠিক পরের মরশুমে আলাদাভাবে রোপণ করে সেই বীজ। তারপরই হাতে নাতে স্পষ্ট ফলাফল পান তিনি। হ্যাঁ, যেখানে বিঘা প্রতি উচ্চফলনশীল বিআর-১১ বা স্বর্ণার ফলন ১৮ মণের কাছাকাছি, সেখানে এই নতুন ধানের ফলন প্রায় ২২ মণ। পাশাপাশি তার জল সহনশীলতাও বেশ খানিকটা বেশি। কাণ্ড মোটা হওয়ায় তা জলে পচে যাওয়ার কিংবা পোকার ধরার সম্ভাবনা অনেক কম। এমনকি এই নতুন ধান রুইতে প্রয়োজন পড়ে কম পরিমাণ সারেরও।

আরও পড়ুন
আন্টার্কটিকায় নতুন উদ্ভিদ প্রজাতি আবিষ্কার ভারতীয় গবেষকের

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কোথা থেকেই ইরি ধানের ক্ষেতে উদয় হল এমন অভিনব প্রজাতির চারা? “ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বের ব্যাপারে আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। এই বিষয়টাও তেমনই। কোনোরকম বিশেষ পরিচর্যা ছাড়াই যে কোনো বিশেষ প্রজাতির মধ্যেই ছোট ছোট অভিযোজন ঘটে থাকে। এক্ষেত্রেও ঘটেছিল তেমনটাই। ইরি ধানের কিছু নমুনার অভিযোজনের ফলেই এই নতুন ধান্য প্রজাতির জন্ম। তবে চোখে দেখেই সেগুলোকে পৃথক করা, বা আলাদা করে সেগুলির রোপণ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। সেদিক থেকে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে এবং পর্যবেক্ষণ শক্তিতে অস্বীকার করার জায়গা নেই”, জানালেন পশ্চিমবঙ্গ ধান্য গবেষণা কেন্দ্রের মৃত্তিকা বৈজ্ঞানিক কৌশিক মজুমদার। তাঁর ভাষায়, “নতুন ধানের ব্রিডিং-এর জন্য একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে একটি পদ্ধতি হল সিলেকশন ব্রিডিং। হরিপদবাবু সেই পদ্ধতিতেই এই নতুন ধান আবিষ্কার করেছিলেন।” প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই এমন পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার সত্যিই অবাক করার মতোই।

আরও পড়ুন
সুন্দরবনে নতুন অঙ্গুরিমাল প্রাণী আবিষ্কার প্রেসিডেন্সির গবেষকদের

তবে এই আবিষ্কারকে আর পাঁচ জন কৃষকের থেকে গোপন রাখেননি তিনি। বরং, বছর দুয়েক নিজের জমিতে এই নতুন ধানের চাষ করে ভালো ফলন পাওয়ার পর ৯০ শতাংশ দানাই তিনি বিতরণ করে দেন স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে। দ্রুত সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বছর তিনেক পর ১৯৯৫ সালে সংবাদ মাধ্যমের নজরে আসে এই পরিচয়হীন ধান্য প্রজাতি। তারপরেই নড়ে-চড়ে বসেন গবেষকরা। কৃষি অধিদপ্তরের কিছু আধিকারিক অবশ্য প্রথমে অস্বীকার করেন তাঁর দাবি। বলা হয়, এটি নতুন কোনো প্রজাতি নয় বরং স্বাভাবিক স্বর্ণা বা বিআর-১১-ই। কিন্তু পরবর্তীতে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর বদলে যায় সেই ধারণা। ৯০ দশকের শেষের দিকে গিয়ে এই নতুন ধান আবিষ্কারের প্রশাসনিক স্বীকৃতি ওঠে তাঁর নামে। আর পরিচয়হীন এই প্রজাতির নামকরণ করা হয় ‘হরিধান’।

আরও পড়ুন
সিডি, ক্যাসেট, পোর্টেবল রেকর্ডারের উদ্ভাবক তিনি; প্রয়াত ডাচ প্রযুক্তিবিদ লু অটেন্স

তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই দশক। বাজারে এসেছে একাধিক নতুন ধানের প্রজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের একাধিক অঞ্চলে এখনও বেশ প্রচলিত এই হরিধান। তার একটা কারণ হয়তো ধান রুইবার খরচ সেখানে সামান্যই। তবে আর্থিক অনটন সত্ত্বেও ব্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা না করে নিজের আবিষ্কারকে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সাহস, কজনই বা দেখাতে পারে এমন? হরিপদ কাপালী পেরেছিলেন। সফল হয়েছিলেন বাংলাদেশের বুকে একক উদ্যোগে এক কৃষি বিপ্লবের জন্ম দিতে। ২০১৭ সালে ঝিনাইদহেই ৯৫ বছর বয়সে মারা যান দরিদ্র এই কৃষক তথা উদ্ভাবক। হরিধানের রোপণ আজও অব্যাহত থাকলেও, বিস্মৃতির অতলেই তলিয়ে গেছে তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কার…

তথ্যসূত্রঃ
এক অসামান্য উদ্ভাবক কৃষক হরিপদ কাপালী, আহমাদ ইশতিয়াক, দ্য ডেইলি স্টার

Powered by Froala Editor