জাতীয় লিগে প্রথমবার সেরা হওয়ার জমাটি মুহূর্তগুলি

খবর একটা রটেছিল বটে। উড়ো নয়, এক্কেবারে পোক্ত খবর। মাহিন্দ্রা ইউনাইটেডের সঙ্গে ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন চাতুনির মোহনবাগান। এরইমধ্যে শেষ ম্যাচটিতে বাগান খেলোয়াড়দের ওপর পুষ্পবৃষ্টি হবে বলে খবর রটে গেল। এরজন্য আসবে ভাড়া হওয়া হেলিকপ্টার। অমন তো বিলেতে হয় শুনি! এবার হবে খোদ কলকাতায়, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। পাড়ার মঙ্গলদাদুর দোকান কিংবা বিজলির চায়ের দোকান, সর্বত্রই এই হেলিকপ্টার নিয়ে আলোচনা। গতবছরের ঝড়ের ক্ষতও যেন উধাও একঝটকায়। বাগান সমর্থকরা খোশমেজাজে গোঁফে তা দিচ্ছে। চাইছে, তাদের মন্দিরকে ধরে বাঁচতে। ইস্টবেঙ্গলের লোকেরাও আঁচ ভাপিয়ে নিয়ে কিছু যে একটা হতে চলেছে কলকাতায়, তা ভাবছেন। সম্ভবত, মার্চের শেষের দিকের ম্যাচ। ভারতসেরাদের বরণ করে নিতে প্রায় সত্তর হাজার মানুষ সেদিন স্টেডিয়াম-মুখো। খেলা শুরুর আগে স্টেডিয়ামের আকাশে খেঁচরের মতো চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। সেখান থেকে নেমে আসে সবুজ-মেরুন পতাকা। ফুলের বৃষ্টিও চলে। আর, সত্তর হাজার মানুষের চিৎকার যেন বিজয়শঙ্খের মতো। তবে এই বরণীয় মুহূর্তের স্মরণীয় কথা বলার আগে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাব। 

কোচ তখনো রিজার্ভ বেঞ্চে বসার ছাড়পত্র পাননি। কোচ ছাড়া জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচে এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে এক গোলে হেরেছে মোহনবাগান। পরের ম্যাচ চার্চিলের সঙ্গে। আর কোচ টিকে চাতুনি গ্যালারিতে। সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ের পর মোহনবাগান টেক্কা দিল ২-১ গোলে। কিন্তু অতি আনন্দে নিরাশাবাদী হওয়ার মতো লোকও ছিল। তেমনি একজন গৌতম কাকা। পরেরটাই বড় ম্যাচ। ‘ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ কি হবে রে কি হবে রে’ করে করে তার তো প্যালপিটিশন হওয়ার জোগান। আমাদের কোচ গ্যালারি থেকে দলকে চালাবেন বলে তার হয়তো ভাতেও বদহজম। মোহনবাগানই তার হজমিগুলি। এমন সব হজম, বদহজম, অম্বলের মাঝে বড় ম্যাচ শুরু। গৌতম কাকা মাঠে গেল না। বলল, মানত করেছে, পরে বলবে। তা সদলবলে পাড়া থেকে দুই দলের পাগলরা মাঠের পথে। দেশের জাতীয় লিগের প্রথম বড় ম্যাচ। সেবার জাতীয় লিগ স্পনসরের দায়িত্বে ফিলিপস। ম্যাচের সেরাকে তারা দেবে মিউজিক সিস্টেম। আমাদের ঘোড়া চিমা। তিনিই পাবেন সুরযন্ত্র! বাসু-অমিত-সত্যের ত্রিফলায় মাঝমাঠ বাগানের দখলে। তুল্যমূল্য লড়াইয়ের মাঝেই লাল-হলুদ গোলকিপার কল্যাণ চৌবেকে লাল কার্ড রেফারির। তিরিশ মিনিট পেরিয়েছে ম্যাচের বয়স। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বল কাছে চলে আসে বাগান স্ট্রাইকারের কাছে। সমূহ বিপদ বুঝে দলের কল্যাণে এগোন কল্যাণ। বুঝতে পারেননি যে, পেনাল্টি বক্সের বাইরে চলে এসেছেন। হাত দিয়ে বল আটকতেই রেফারির বাঁশি আছলা বাঁশ হয়ে দাঁড়ায় কল্যাণ চৌবের কাছে। লাল কার্ড। মাথা হেঁট করে মাঠের বাইরে লাল-হলুদ গোলকিপার। এর ঠিক পরে পরেই গোল পেয়েছিলেন চিমা। গোলার মতো শটে। হাফটাইমে যাওয়ার আগে এক গোলে এগিয়ে বাগান।

আনন্দঘন মুহূর্ত... ছবি goal.com

 

গ্যালারিতে যখন ‘চিমা-চিমা' স্লোগান চলছে, একটি দৃশ্যের জন্ম হল। সত্যজিৎ চ্যাটার্জি এগিয়ে গেলেন গ্যালারির দিকে। গ্যালারি থেকে চাতুনিও নেমে এলেন। খানিকক্ষণ কথা হল দু-জনের। শুনেছিলাম, আঘাতের পরে পরামর্শ ওষুধের মতো। কিন্তু আঘাতের আগে? দশজনের ইস্টবেঙ্গল যে ম্যাচে ফিরবে, আন্দাজ করেছিলেন চাতুনি। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম কোয়ার্টারে ম্যাচে ফিরল লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু পাল্টা গোলও করল মোহনবাগান। জাতীয় লিগের প্রথম বড় ম্যাচ জিতল চাতুনির বাগান। আর ওই সুরযন্ত্র পেলেন হিরো বনে যাওয়া চিমা। এরপর সালগাওকার ম্যাচ বাদে টানা দশ ম্যাচ না হেরে আমাদের বাগানে কোকিল ডাকছে। গোষ্ঠ পাল সরণির আমাদের ক্লাব তাঁবুতে তখন জাতীয় লিগ ঢুকবে ঢুকবে করছে। যদিও পিছন থেকে তাড়া করেছে ইস্টবেঙ্গল। তাই মাহিন্দ্রার সঙ্গে শেষ ম্যাচে এক পয়েন্ট দরকার হলেও বিশেষ উচ্ছ্বাসী ছিলেন না চাতুনি। তাঁর পুরো পয়েন্ট চাই-ই চাই। কিন্তু সমর্থকদের সেসব কে বোঝাবে! তারা তো মাঝেমাঝেই বেমক্কা। যেন জিতেই গেছে জাতীয় লিগ। তারই মাঝে 'নিরাশাবাদী' গৌতম কাকা ঠিকই করে নিল যে, মাঠে যাবে না কোনোদিন। মোহনবাগানকে চ্যাম্পিয়ন করাতে সেটাই ছিল মানত— ধনুক ভাঙা পণও। ম্যাচের দিন যেখানে সকাল থেকেই চাপা উষ্মা। স্টেডিয়ামে তো বটেই, ব্যায়াম সমিতি মুখোও হল না গৌতম কাকা।

শ্রীগোকুলম গোপালন টি কে চাতুনিকে সম্মান জানাচ্ছেন। ছবি গোকুলম কেরালা এফসি টুইটার।

 

অতগুলো হোম ম্যাচে না হারা, বম্বেতে মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড, মারগাওতে সালগাওকার এবং কেরালায় এফসি কোচিনকে টেক্কা মেরে জিতে আসা সবুজ-মেরুনের আম-সমর্থকের চেয়ে বিলকুল ব্যতিক্রমী এই গৌতম কাকা। সে কিন্তু ম্যাচের আগের দিনও ক্লাবে বসে ইস্টবেঙ্গল নিয়ে বেশ সম্ভ্রম দেখিয়ে বলেছিল, “ইস্টবেঙ্গল কেমন খেলছে দেখেছিস! ঘাড়ের কাছে এসে নিশ্বাস ফেলছে কিন্তু। খোদ লুধিয়ানায় গিয়ে জেসিটি-কে কিন্তু বেশ বেগ দিয়েছে ওরা। আর শেষ রাউন্ডে ডেম্পো ম্যাচটা মনে কর। বাইচুং কিন্তু ছিঁড়ে খেয়ে নিয়েছিল। তাই এত নিশ্চিত হচ্ছিস কীভাবে তোরা? লিগ তো ওপেন।” এরপর ম্যাচের সকাল। আর যারা মাঠে গেল, তারা গৌতম-দর্শন পেল না। কারণ ওটাও মানতের মধ্যেই। গতবছর ফেডারেশন কাপের সময় বানানো পালতোলা নৌকা কি কেলো-বাপ্পাদের সঙ্গে মাঠে যাবে? দু-একজনের তাতে আপত্তি। তাদের কাছে ওটা ‘অপয়া’। কিন্তু ক্লাবের প্রতীককে অপয়া বলায় তারাও তখন কপোতারির নজরে। ‘তোদের মাঠেই যেতে হবে না শালা’ গোছের চেয়েও বেশি কটুকাটব্য ভাষায় তাদের ওপর তখন ফতোয়া জারি। যাই হোক, আয়োজনে ত্রুটি ছিল না। পালতোলা নৌকাটি সাজল টুনি আলোয়। তাতে সাঁটানো সে-বছরের জাতীয় লিগের বাগান খেলোয়াড়দের ছবির পেপার কাটিং। মাহিন্দ্রা ম্যাচের দিন সকালে তাতে শোভা পেল গোরের রজনীমালা। তারপর, আগিয়ে দিয়ে দখিন পা, যথা ইচ্ছা তথা যা... 

চিমার সঙ্গে আই এম বিজয়ন। ছবি বিজয়নের টুইটার

 

খেলা শুরুর আগে আকাশ পরিক্রমায় হেলিকপ্টার। নেমে আসে সবুজ-মেরুন পতাকা। পুষ্পবৃষ্টিও হল। গ্যালারিতে ‘মোহনবাগান... মোহনবাগান...’ চিৎকারে কান পাতা দায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনেছি, প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা সবুজ-মেরুন পতাকা দেখা গিয়েছিল মাঠে। গোটা মাঠ ঘুরছে সেই পতাকা। এমন রাজার মেজাজেই কিকঅফ। দাপুটে শুরু। কিন্তু বাগান সভাপতি টুটু বসু চাতুনির কাছে গিয়ে কি যেন বলছেন বারবার... চাতুনি এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোলকিপার হিসাবে হেমন্ত ডোরার জায়গায় নামিয়েছেন নবাগত রাজু এক্কাকে। চাতুনিকে হয়তো সেটাই বোঝাচ্ছেন টুটুবাবু। কিন্তু তিনি কোচ। নিজের বিন্দুতে ঠায় দাঁড়িয়ে রাজুকে প্রায় চল্লিশ মিনিট পর্যন্ত মাঠে রাখলেন। খারাপ সামলাননি রাজু। হয়তো রাজুকে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে চাতুনির নীতির অংশ ছিল এটা। রাজুর বদলি হিসাবে হেমন্ত ডোরাও নেমেছিলেন এরপর। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা নেই বলে যখন গ্যালারিতে ফিসফাস, ঠিক তখনই চিমার গোল। হ্যাটট্রিক করেছিলেন। দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। গ্যালারি তখন উদ্বেল। জ্বলছে রংমশাল, তুবড়ি— বুড়িমার চকোলেটও... এই আবেগকে বশে রাখা যায় না। গেলও না। স্টেডিয়াম থেকে বাগান জনতার মিছিল কদম কদম এগিয়ে গেল। কলকাতা অবরুদ্ধ। তাদের গন্তব্য একটাই― গোষ্ঠ পাল সরণির মোহনবাগান ক্লাব তাঁবু। মজার ঘটল ঘটল গৌতম কাকাকে নিয়ে। গোটা দলকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। ক্লাবের তরফে ঘোষণা। হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গাইবেন ইন্দ্রানী সেন, সৈকত মিত্র। “ঝুমঝুম ময়না নাচো না... আমি কিন্তু যাচ্ছিই।” গৌতম কাকার মনে ঝুমঝুমি। ঝুমঝুম ময়না হয়ে নেচেছি আমরাও। আমরা এমন আবেগের করুণায় থেকেছি। অনুষ্ঠানে গেলেও গৌতম কাকা আজো কিন্তু মাঠে যায় না। টিভিতে দ্যাখে। চব্বিশ বছর কেটে গেছে... মানত না ভেঙে কথা রেখেছেন গৌতম।

Powered by Froala Editor