ভাষাতে পৃথিবী

ভাষা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়প্রহর। গেলবারের লেখাতেই সেই কথাটা বলার, বোঝানোর চেষ্টা করেছি বার বার। কত কত কত বিচিত্র ভাষা। স্থান-কাল রূপভেদে তার বহিরঙ্গ আর অন্তরঙ্গের কি বিপুল রদবদল, পরিবর্তন। ‘ভাষা’ নামে একটি বাংলা সিরিয়ালই তো হয়েছিল গত কয়েক বছর আগে, কোনো এক প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে, তা হবে বছর চোদ্দ-পনেরো আগেই। এক তথাকথিত ‘বস্তির মেয়ে’-র লড়াই করতে করতে মূলস্রোতে উঠে আসা সিরিয়াল কথা। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই টিভি অপেরায়। কি চমৎকার অভিনয় করছিলেন তিনি। চলে যাওয়ার আগে সম্ভবত এটাই তাঁর শেষ সিরিয়াল— মেগা ধারাবাহিকে অভিনয়। ছোটো বেলা থেকে ভাষার যে পরিবর্তন— রদবদল লক্ষ্য করেছি, তা বুঝবার জন্য নোয়াম চমস্কি, ডঃ শহিদুল্লাহ, আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ডঃ সুকুমার সেন, ডঃ পবিত্র সরকার হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। যেমন ‘চোটে’— এই শব্দটি। ‘চোটে’— এই শব্দটি একটি সম্বোধন, তেমনই ‘কোম্পানি’, ‘এই যে কোম্পানি’ সম্বোধন, হাওড়া জেলার বালিতে শান্তিরাম রাস্তায় সাগর পাঁজা বা সাগরবুড়োর কালীমন্দির। সাগরবুড়োর আসল নাম নীলমণি দাস। তাঁর পাঁচ ছেলে— লক্ষ্মীনারায়ণ, সত্য, হরিমোহন, মোহন, রতন। লক্ষ্মীনারায়ণ চাকরি করতেন বালি জুট মিলে। ‘মহাবীর জুট মিল’— তার নাম ছিল কী? অথবা ‘হনুমান জুট মিল’? আবার এসব কিছু নাও হতে পারে— মানে এই দুই নামের একটিও। বালির এই জুট মিল মাঠ বা মিল মাঠে তখনকার— ষাট-সত্তর দশকে কলকাতা লিগে ফুটবল ফার্স্ট ডিভিশন খেলা বালি প্রতিভা। তখন কলকাতা লিগে কালীঘাট, হাওড়া ইউনিয়ন, রাজস্থান, পোর্ট কমিশনার্স, স্পোর্টিং ইউনিয়ন, সবাই খেলে। আর মাঝে মাঝেই তারা কলকাতা ময়দানের তথাকথিত বড়ো টিম— ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং, ইস্টার্ন রেল, বিএনআর— বিএন রেলওয়েকে রীতিমতো ‘মিট্টি কা ধুল চাটিয়ে দেয়’। কলকাতা লিগে তখন ফুটবলই ফুটবল নিয়ে মাতন। বড়ো ম্যাচের দিন ‘স্টেডিয়াম’, ‘ওলিম্পিক’, ‘গ্যালারি’, ‘ময়দান’, ‘খেলার মাঠ’ নামে ট্যাবলয়েড বেরোয়। ‘খেলার আসর’, ‘ক্রীড়াআনন্দ’ তখন স্বপ্নেরও বাইরে। খেলোয়াড়দের একই ছবি প্রায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জিঙ্ক ব্লক। ঝাপসা, ধ্যাবড়া, সিপিয়া কালার। তাতেই বলরাম, চুনি, পিকে, জার্নেল সিং, রামবাহাদুর, পি দে (পরিমল দে), আর এক নামে— মানে ডাকনামে যিনি ‘জংলা’, অসীম মৌলিক, পিটার থঙ্গরাজ, বিক্রমজিৎ দেবনাথ, শান্ত মিত্র, প্রশান্ত সিনহা— প্রশান্ত সিংহ, সুনীল নন্দী, নিখিল নন্দী, সীতেশ দাস, মঙ্গল পুরকায়স্থ, দিপু দাস, অরুময় নৈগম, পি বর্মণ— প্রদ্যোৎ বর্মণ, কমল সরকার, সি মুস্তাফা, মিরকাশিম, সুকুমার সমাজপতি, আরও আরও কত কত কত নাম। তখন বড়ো ফুটবলাররা কি এমন টাকা পান? কিসসু না। ল্যাংচা মিত্তির, নীলেশ সরকার— এঁরা দুজনেই বালির মানুষ। শৈলেন মান্না তাঁর নামও তখনই কিংবদন্তি হয়ে গেছে, কলকাতা ফুটবলে। তখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলে কতই বা টাকা পাওয়া যায় নগদে? ভালো খেললে একটা চাকরি হতে পারে বড়োজোর, ব্যাঙ্কে— স্টেটব্যাঙ্কে, তখনও ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, রাজন্যভাতা বিলোপ— প্রিভিপার্স ইত্যাদি খারিজ করার সময়ে পৌঁছতে পারেনি আমাদের এই দেশ। স্টেটব্যাঙ্কের মাইনে-কড়ি অন্য অন্য ব্যাঙ্কের তুলনায় একটু ভালো। এছাড়া কলকাতা লিগে ফুটবল প্লেয়ারদের জন্য ছিল চাকরি ‘বাটা’-য়, ‘বাটা’-র টিমে খেললে। ‘বাটা’ তখন ক্যালকাটা লিগে ফার্স্ট ডিভিশন খেলে। ভালো টিম করে। চাকরি দিয়ে প্লেয়ার রিক্রুট করে বাটা। ইস্টার্ন রেলওয়ে, বিএন রেলওয়ে তো খেললে চাকরি। দীপক দাস ভারালু, আপ্পালা রাজু, রাজেন্দ্রমোহন, টিরকে— সবাই বিএনআর-এর চাকুরে ফুটবলার। আবার ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করে খেলতেন প্রদীপ ব্যানার্জি— পিকে ব্যানার্জি, মিরকাশিম কাজল মুখার্জি, প্রদ্যোৎ বর্মণ— পি বর্মণ। পি বর্মণ ছিলেন ভালো গোলকিপার। বলাই দে, তরুণ দেরা পি বর্মণ, সনৎ শেঠ, দীপক দাস, কমল সরকার, পিটার থঙ্গরাজ, সি মুস্তফাদের পরের প্রজন্ম। প্রতুল চক্রবর্তী, রবি চক্রবর্তীরা ছিলেন কলকাতা ময়দানের সেরা রেফারিদের অন্যতম। প্রতুল চক্রবর্তীকে কেউ কেউ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে টেনে ম্যাচ খেলাতেন, এমন কথা বলেছেন, মানে সেই সময়কার সমর্থকমণ্ডলী— যাঁরা কাঠের গ্যালারি, সবুজ গ্যালারি আলো করে বসতেন, থান ইটের টুকরো, কাচের বোতল নিয়ে ঢুকতেন মাঠে। কখনও কখনও ছুরি, ক্ষুর। মহামেডান স্পোর্টিং মাঠে জল ঢুকে পড়ত, জমতও। সিএফসি-মোহনবাগান গ্রাউন্ড ছিল কলকাতার অন্যতম সেরা মাঠ। ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব— সিএফসি তখন খুবই নামকরা ফুটবল ক্লাব— ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব। ক্যালকাটা ক্লাবের— ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের দাপট স্বাধীনতার আগে। তখন সল্টলেকের যুবভারতী স্টেডিয়াম স্বপ্নের বাইরে। কলকাতার হকি লিগও ছিল খুব নামকরা। কলকাতা হকি লিগে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং, বিএনআর, গ্রিয়ার, হাওড়া ইউনিয়ন সকলেই হকি খেলত। ইনামুর রহমান, আনিসুর রহমান— এই দুই ভাই ছিলেন কলকাতা হকি লিগের স্টার প্লেয়ার, বিশেষ করে ইনামুর রহমান, তাঁর স্টিকের কাজ দেখেছি খেলার মাঠে— ময়দানে। আনিসুর তেমন বড়ো হকি খেলোয়াড় নন, মানে ইনামুরের তুলনায়, তাঁর খেলাও দেখেছি। ইনামুর-আনিসুর ষাটের দশকে ইস্টবেঙ্গলে। পরে মোহনবাগানে যান। ভেস পেজ— ভি পেজ, লাকড়া— এঁরাও ছিলেন নামকরা হকি খেলোয়াড়। লাকড়া সম্ভবত আদিবাসী জন ছিলেন— যতদূর মনে পড়ছে, ছিলেন গুরুবক্স সিং, যোগিন্দর সিং প্রমুখ। তাঁরাও কলকাতারই। গুরুবক্স, যোগিন্দর দুজনেই অলিম্পিক খেলেছেন, ভারতের হয়ে। গুরুবক্স, যোগিন্দর— দুজনেই ছিলেন অসামান্য হকি খেলোয়াড়। ভিপেজও তাই। ধ্যানচাঁদ ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত হকি খেলোয়াড়। অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমস— সবেতেই তিনি মাহির— অতি প্রসিদ্ধ। গোলের পর গোল, গোলের পর গোল করেছেন তিনি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ম্যাচে। তাঁর হাতের স্টিকে নাকি জাদু ছিল। তাঁকে হকির জাদুকরও বলা হত, সে তো সকলেই জানেন। ধ্যানচাঁদ নাকি শুধু স্টিক দিয়েই নয়। ছাতার বাঁট দিয়েও গোল করতে পারতেন, এমন অতিকথা মিশে আছে তাঁর যাপনের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়া অথবা ইউরোপের কোনো দেশে, তাঁর স্টিকের ক্যারিশমা, জাদুকরি দেখে হকি ম্যাচ দেখতে আসা দর্শকরা দাবি করলেন, ধ্যানচাঁদের হাতের হকি স্টিকে নাকি ম্যাজিক অথবা অন্য ট্রিক আছে। ধ্যানচাঁদ তখন নাকি নিজের হাতের হকি স্টিক রেখে দিয়ে ছাতার বাঁট নিলেন আর তা দিয়েই চার চারটে গোল করেন, তাঁর দলের হয়ে। এসব তো অতিকথন, গপপো, গপ্পো— ‘গল্পের গরু’ যে শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়, গাছে কিংবা অন্যত্র, কে বলবে? ‘গল্পের গরু’ গাছ কেন হিমালয় আল্পসেও চড়ে বসতে পারে। এই ছাতার বাঁট দিয়ে গোল করার কাহিনি অনেকটা যেন পিসি সরকার— প্রতুলচন্দ্র সরকার (সিনিয়র)-এর সেই অতি বিখ্যাত গল্পটির কথাই মনে করায় যেন, যেখানে পিসি সরকার তাঁর ম্যাজিক শো-তে সামান্য কয়েক মিনিট দেরি করে পৌঁছে দর্শকদের অভিযোগ-গুঞ্জন শুনতে শুনতে ঘড়ি মিলিয়ে নিতে বলছেন জাদু প্রদর্শনীতে আসা দর্শকদের। এই গল্পটি খুবই প্রচলিত মুখরোচক গল্প। বাস্তবে যা হয়নি। ধ্যানচাঁদের ছাতার বাঁট দিয়ে গোল করার গল্পও তাই। যা একসময় প্রায় মুখে মুখে ফিরত। অন্তত পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে, এমনকি সত্তর দশকেও। সত্তর দশকের গোড়াতে তো বটেই। ধ্যানচাঁদ আশির দশকেও ধ্যানচাঁদই— ধ্যানচাঁদ। তারপর তো অশোককুমারদের যুগ। ঘাসের বদলে অ্যাস্ট্রোটার্ফ। আন্তর্জাতিক হকিতে ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া ভারতের। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। আবার পুনরুত্থান। পৃথিবীজোড়া যেটুকু হকি খেলা, তাতে ভারত, পাকিস্তান, দু’দেশই একটু একটু একটু একটু করে পিছতে বাধ্য হল। ঘাস-মাঠ ছেড়ে অ্যাস্ট্রোটার্ফ, যে একটা কারণ তো বটেই। তাছাড়াও স্টিকের কারিগরি, ব্যক্তিগত স্কিল, হকি-সৌন্দর্য, তিন-চার-পাঁচজনকে কাটিয়ে নিয়ে ডি-এর মধ্যে ঢুকে পড়া, তারপর গোল করা, সে এক বিস্ময়ই তো বটে। কিন্তু খেলার ধক, ধারা বদলে দিল জার্মানি, স্পেন, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস। সেইসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া। খেলার ধারাটাই যেন বদলে গেল। সেইসব নিয়ে আর বিস্তারে যাচ্ছি না। পেনাল্টি স্ট্রোক, লং কর্নার, পেনাল্টি কর্নার, খেলতে খেলতে বলকে স্কুপ করা— সব কেমন যেন বদলে গেল। তৈরি হল ‘চাক দে ইন্ডিয়া’-র মতো ছবি। শাহরুখ খান হলেন কোচ কবির খান। হকি— পুরুষদের হকির পাশাপাশি মহিলা-হকি, আইস-হকি সকলের কথাই মনে আসছে এখন। হকি নিয়ে কলকাতায় মাতামাতিও তো কিছু কম ছিল না। কলকাতা হকি লিগ, বেটন কাপ— এই হকি টুর্নামেন্ট ছিল সর্বভারতীয়। বেটন কাপ, কলকাতা হকি লিগ— সবই তো বন্ধ। ল্যাগডেন শিল্ড, হরেন্দ্রকুমার মুখার্জি শিল্ড, এলেন লিগ— সবই তো ছিল একস্ময়। কলকাতা ফুটবল লিগ, আইএফএ শিল্ড, কলকাতার বাইরে রোভার্স কাপ, ডুরান্ড কাপ, বরদলৈ ট্রফি, ক্রিকেট ফুটবল মিলিয়ে সে এক দারুণ ধামাকাদার সময়। কলকাতা হকি লিগে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং, বিএনআর— বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে, গ্রিয়ার, এরিয়ান্স— সবাই হকি খেলে, সে কথা আগেই লিখেছি। রাজস্থান ক্লাবে এক সময় খেলতেন ফেন— দুর্ধর্ষ ডিফেন্স। জার্নেল সিং— মোহনবাগানের অতি বিখ্যান জার্নেল সিং, রাজস্থান ক্লাবে ডিফেন্ডার হিসাবে খেলার সময় তাঁর মাথার ঝুঁটিতে লেগে লেগে সেমসাইড গোল হয়েছে, এমন কথাকলি কলকাতা ময়দানে ছিল। কলকাতা ময়দানে কেম্পিয়া, নর্সিয়া, সি প্রসাদ, রহমান, গুরুদেব সিং, মজিদ বাকসার জামশেদ নাসিরি, চিমা ওকেরি, ব্যারেটো— কত কত নাম, স্বদেশী-বিদেশী মিলিয়ে। কড়া স্টপার জার্নেল সিং সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসাবেও খেলেছেন, প্রয়োজনে।। তিনি ছিলেন মাথাঠান্ডা ফুটবলার। যেমন সৈয়দ নইমুদ্দিন, যেমন সুধীর কর্মকার, যেমন শান্ত মিত্র। যেমন রামবাহাদুর ছেত্রী। কলকাতা ফুটবল লিগে এইসব ফুটবলারদের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত ছিল। লেখা হয়নি। হাবিব, আকবার, শ্যাম থাপা, তাঁদেরই বা তেমন করে কে মনে রাখছে? জেভিয়াস পায়াস, উলগানাথন— এঁদের কথা মনে রাখেন কজন? একটু আগেই কথা হচ্ছিল হকি খেলা নিয়ে। হকি খেলা কলকাতা ময়দানে বহু বছরই বন্ধ। হকি পাগল পাবলিকও উধাও প্রায়। হকি স্টিক নিয়ে পেটাপেটি, লাঠালাঠির বদলে স্টিকাস্টিকি একসময় খুব হত কলকাতায়। ষাট ও সত্তর দশকে। হকি ম্যাচের যে মাঠ, সেই মাঠের বাইরেও, পাড়া ক্ল্যাশ— পাড়া সংঘর্ষ আর রাজনৈতিক অ্যাকশন, মারামারিতেও হকি স্টিকের বেধড়ক ব্যবহার। শুধু পশ্চিমবাংলাতেই নয়, অখণ্ড উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদের ছাত্র সংঘর্ষে ‘হকি’— হকি স্টিক একটি অন্যতম উপকরণ। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে— ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি চত্বরে ছাত্র-সংঘর্ষে— বিদ্যার্থীদের ঝামেলায় ‘হকি’— হকি স্টিক বহুক্ষেত্রেই অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্মণ নামে এক অতিবিখ্যাত গোলকিপার ছিলেন ভারতীয় হকি দলে। বিভিন্ন বিদ্যালয়েও ছিল হকি টিম। আমাদের স্কুল— বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়েও ছিল হকি টিম। প্যাড পরতেন গোলকিপার, তখনকার ক্রিকেট প্যাড আর হকি প্যাড, কোনোটাই তেমন মজবুত নয়, একটু প্যাতপ্যাতে। শুরু করেছি ভাষা দিয়ে— মন্দিরের ভাষা, বেশ্যাবাড়ির ভাষা, জেলখানার ভাষা, রোয়াক বা রকের ভাষা, পুরনো কলকাতায় ‘ঝি’, চাকরদের ব্যবহার করা ভাষা, কত কত বৈচিত্র তার। ধরা যাক মন্দিরের ভাষা— দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের কালী মন্দিরে যাঁরা পালাদার— হালদাররা আর তাঁদের দৌহিত্র বংশ— মুখুজ্জে বা মুখার্জিরা, সেই পালা আবার কেনাবেচাও হয় নিজেদের মধ্যে, ষাট সত্তরের দশকেই ছিল হাজার হাজার টাকার লেনদেনের খেলা। ষাটের দশকেও কালীঘাটের কালী মূর্তির ছবি তোলার ওপর কড়া নিষেধ। তখন যেসব ছবি কাচ-কাঠে বাঁধিয়ে বিক্রি হয় বিগ্রহের তা ছাপা ছবি। তার আগে তো ছিল কালীঘাটের পট, সে তো হাতে আঁকা, তা নিয়ে আর্চারের অতিবিখ্যাত বই আছে। আবার আর্চারের তত্ত্বকে সম্পূর্ণ নাকচ করে পূর্ণেন্দু পত্রীর অনবদ্য প্রবন্ধ— কালীঘাটের পটের ওপর। সেই কালীঘাটের কালী মন্দিরে পাণ্ডাবুলি— পাণ্ডাদের ভাষার নানারকম কারিকুরি।

১. সিক চাকি
২. দিক চাকি
৩. হরিচাকি
৪. নেত্যচাকি
৫. দয়লা
৬. মাথি মাশুল (পাণ্ডা উচ্চারণে— ‘মাতি’)
৭. বলিদান করে দাও
৮. খোলো মাজা করা

সিকচাকি, দিকচাকি, হরিচাকি, নেত্যচাকি, দয়লা— সবই বিভিন্ন মূল্যমানের মুদ্রার কথা বলে। হরিচাকি, সিকচাকি, দিকচাকি, নেত্যচাকি, দয়লা— পাণ্ডা মুখে এইসব কথা বিকশিত নয়, বিচ্ছুরিত হতে থাকে। মন্দিরের এই ভাষা সৌকর্য, ভাষা কৌশল, ভাষা ছলনা ও ভাষা কুহক নিয়েই পরবর্তী ‘মুছে যায়’-তে কথা বলব। কালীঘাটের কালীর সামনে পাঁঠা উচ্ছুগ্গু— উৎসর্গ করা পাঁঠা বলি করাতে গেলে যে পয়সার ভাগ ষাট-সত্তরে দেখেছি, তা নিশ্চয়ই এখনও অপরিবর্তিত নেই। ঘাতক— মানে যিনি বলি করান, ঢাক বাজান যিনি বলির সময়, সেই ঢাকি, প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট পয়সা পেয়ে থাকেন। বলিকর— ঘাতক আট আনা পঞ্চাশ নয়া পয়সা পেলে ঢাক বাজিয়ে চার আনা পাবেন। মাথি মাশুল হল বলিপ্রদত্ত ছাগের মুণ্ডবাবদ দেওয়া টাকা, সেটি পান পালাদার। আগেই বলেছি, পালাদারের পালা হাজার হাজার টাকা বিনিময়ে সেদিনের জন্য হাত বদল হয়। আমার বন্ধু মহাদেব মুখার্জিরা ছিল কালীঘাটের পালাদার, তারা ছিল হালদারদের দৌহিত্র বংশ। হালদার পরিবারের খুব নামকরা জন ছিলেন গুরুপদ হালদার, অমিয় হালদার। মুখার্জিদের মধ্যে যথেষ্ট নামকরা বা নামজাদা ছিলেন অলক মুখার্জি। তাঁর বড়ো বড়ো দুচোখ। ধুতি-শার্ট, চমৎকার গানের গলা। বিশেষ করে শ্যামাসঙ্গীত। লেখক ও তন্ত্রসাধক কালিকানন্দ অবধূত— মরুতীর্থ হিংলাজ, উদ্ধারণপুরের ঘাট, ‘হিংলাজের পর’, ‘নীলকণ্ঠ হিমালয়’, ‘ফক্কড়তন্ত্রম’ ইত্যাদি গ্রন্থপ্রণেতা কীভাবে স্কচের বোতল মুখে লাগিয়ে চোঁ ওঁ করে নিট টেনে নিতেন, তার বিবরণ অলক মুখার্জির কাছে শুনেছি। তিনি ১৫/বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে মাতৃকাশ্রম-প্রণব সংঘ-এ সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারীজির কাছে আসতেন।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
নেতাজির সঙ্গে সঙ্গে