বাঙালির কাছে, বিশেষ করে পঞ্চাশ থেকে সত্তর, আশি, নব্বই যাঁদের বয়স, তাঁদের কাছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একটি স্বপ্নবীজের নাম। আমি কয়েকটি নেতাজি— নেতাজি সুভাষ সমন্বিত— সুভাষ ভালোবাসা, সুভাষচন্দ্র বসুকে পাগল হয়ে ভালোবাসার কথাস্মৃতি এখানে পেশ করব।
১) গায়ত্রী রায়— ইনি সম্পর্ক সূত্রে আমার গর্ভধারিণী। আট মাস— হ্যাঁ, আট মাসই গর্ভে ধারণ করেছিলেন আমায়। অন্ধ নেতাজি, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, সারদা মা-র ভক্ত। আর অবশ্যই সুভাষ। এবং সুভাষ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মা বরাবর ভোট দিতেন কমিউনিস্টদের। না-ভাঙা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে— কাস্তে ধানের শীষ, যাদের নির্বাচনী প্রতীক, নাহ, জাতীয় কংগ্রেসের জোড়া বলদ বা অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর নির্বাচনী প্রতীক প্রদীপে। প্রজা সোসালিস্ট পার্টির কুঁড়েঘর, সংযুক্ত সোসালিস্ট পার্টির ঝুরি নামানো বটবৃক্ষ, কোনোটাই তাঁর নির্বাচনী পছন্দে ছিল না। আর বালি বিধানসভা বা লোকসভা কেন্দ্রে ফরোয়ার্ড ব্লকের কোনো প্রার্থী থাকত না। নেজাতি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তৈরি এই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীক— ইলেকশান সিম্বল সিংহ। ফলে ব্যালট পত্রের কাস্তে ধানের শীষে ছাপ অনিবার্য, অবধারিত। নিয়মিত। থাক সেসব প্রসঙ্গ। আপাতত গায়ত্রী রায়ের সুভাষ-শ্রদ্ধার কথা বলার চেষ্টা করি। মা ভোট দিতেন নির্দ্বিধায়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই-এর কাস্তে-ধানের শীষ মার্কা বাক্সে নিজের ছাপ দেওয়া ব্যালটপত্রটি ঠিকঠাক ভাঁজ করে ফেলে দিতেন। ১৯৬০-৬১-৬২ সালেও প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীক আঁকা আলাদা আলাদা ভোট বাক্স, বড়ো, মজবুত। মা ভোট দিতে যেতেন, একটু যেন ফিটফাট হয়ে, পরিষ্কার ইস্ত্রিদার লাল পাড় শাড়ি, ফর্সা কপালে সিঁদুর টিপটি ভোরের সূর্য। আমার মা ভোট দিতে যাচ্ছেন। সঙ্গে বাবাও। তখন জাতীয় কংগ্রেস দল ও অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ ভোটারদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য কলকাতার গা লাগোয়া মফঃস্বলে সাইকেল রিকশা রাখত। সাইকেল রিকশা করে করে ভোটার নিয়ে আসা হবে বুথে বুথে। আর কলকাতায় ব্যবস্থা থাকত মানুষটানা রিকশার, ভোটার আনার জন্য। আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই আছে কলকাতাতেই— বিশেষ করে বড়োবাজার ও বড়োবাজার লাগোয়া উত্তর কলকাতায় অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর প্রার্থীরা। আর তাঁদের পোস্টার— ভোটপ্রার্থীর নাম— সবই তুলনামূলক গ্লসি পেপারে, এমনকি জোড়াবলদ ছাপ জাতীয় কংগ্রেস— ন্যাশনাল কংগ্রেসের তুলনায়। কংগ্রেসের ছাপা পোস্টারের তুলনায় অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর পোস্টারের কাগজ তখন থেকেই দামি। আপাতত থাক সেই প্রসঙ্গ। যে কথা হচ্ছিল, আমার মা ও বাবা— গায়ত্রী রায় আর অমরনাথ রায় কেউই জাতীয় কংগ্রেসের স্থানীয় লোকজনের পাঠানো সাইকেল রিকশায় কখনও ওঠেননি। সেই সাইকেল রিকশার পিঠে কংগ্রেসের জোড়া বলদ, প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর হাস্যমুখ। সেইসঙ্গে বালি বিধানসভা কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। লোকসভা নির্বাচনের সময় জাতীয় কংগ্রেস ক্যানডিডেট কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাম বড়ো বড়ো অক্ষরে ছাপা থাকত। সাধারণত সাদার ওপর নীলে। বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার পোস্টারেও তাই। সাদা ভূমির ওপর নেভি ব্লুতে প্রার্থীর নাম, না কী ওশান ব্লু— সমুদ্র নীল? আর সেই নীলের দাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর মুখও কিঞ্চিৎ নীলাভ। অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রার্থী হতেন সুদর্শন, সুবক্তা, হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজের অধ্যাপক ডঃ হরিপদ ভারতী। অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর প্রার্থীর নাম সাদা পটভূমিতে গেরুয়া— গভীর গেরুয়ায় ছাপা। এইসব পোস্টারের বাঁ দিকে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মুখ। সেইসব পোস্টার অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘর ভোটার আনানোর সাইকেল রিকশা বা মানুষটানা রিকশার পিঠে। থাক এত এত সব কথা। আপাতত গায়ত্রী রায়ের সুভাষ কথায় আসি। মা সারাজীবন কমিউনিস্ট পার্টি— প্রথমে সিপিআই পরে খণ্ডিত পার্টির সিপিআই (এম)-কে ভোট দিয়েছেন। প্রথমে কাস্তে ধানের শীষ— পরে কাস্তে হাতুড়ি তারা। তো সেই গায়ত্রী রায় কথা প্রসঙ্গে— নানা রাজনৈতিক বাদ-বিতণ্ডা, তর্ক ইত্যাদির ফাঁকে বলতেন কমিউনিস্টদের সব ভালো কিন্তু দুটো দোষ আছে। আমি অতি জিজ্ঞাসু হয়ে জানতে চাই কী কী দোষ মা।
উত্তরে গায়ত্রী রায় জানান— কমিউনিস্টরা সুভাষকে মানে না। কমিউনিস্টরা ভগবানকে মানে না। অর্থাৎ আমার গর্ভধারিণী গায়ত্রী রায়ের ব্যাখ্যায় এরকম কথাই ফুটে ওঠে— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভগবানের থেকেও বড়ো। মা এই কথাটা বারবার বলতেন। এমনকি নকশাল বাড়ির ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ হয়ে যাওয়ার পর সেই আন্দোলনের সঙ্গে পুরোপুরি নিজে যুক্ত হওয়ার পর, মায়ের সুভাষ-গভীরতা কমেনি। তাঁর প্রবল বিশ্বাস ছিল, এই পোড়া দেশে সুভাষচন্দ্র— নেতাজি যদি ফিরে আসেন, বসেন দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতার পদে, তাহলে এই দেশ— ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবাংলার যা যা সমস্যা— বেকারি, দারিদ্র, অনাহার, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা— সব, সবকিছু দূর হয়ে যাবে। মায়ের এই স্বপ্ন ছিল গড়পড়তা আম বাঙালির স্বপ্ন। নেতাজি আসছেন। নেতাজি আসছেন। তিনি এলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মায়ের বিয়ের খুব পোক্ত স্টিল ট্রাঙ্ক, চামড়ার মজবুত সুটকেস ছিল। বাবার ছিল মালমুগুর যাকে বলে, তেমন অতিপোক্ত কালো রঙের দুটি স্টিল ট্রাঙ্ক। বড়ো, গভীর। তার ভেতর অনেক অনেক কিছু। আমার ঠাকুর্দা অম্বিকানাথ রায়ের পানের গোল ডিবে। বাবার স্কুল-কলেজের রেজাল্ট কার্ড— প্রোগ্রেস রিপোর্ট, মার্কশিট, সার্টিফিকেট ইত্যাদি। সেইসঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একটি ছবি— সামরিক বেশের। ফুল ইউনিফর্মে সুভাষ। এই কাচ না বাঁধানো, শুধুমাত্র বোর্ডে মাউন্ট করা সুভাষচিত্রটি বেরত ২৩ জানুয়ারি। মা শঙ্খ বাজাতেন, নেতাজির গলায় লোকাল ফুলের মালা। মা সজল চোখে আবৃত্তি করতেন— ‘অভাগা আমি সন্তান তোর/ ছাড়িয়ে চলিনু ভারতভূমি/ আবার আসিব মুক্ত করিতে/ বিদায় দে মা ললাট চুমি।’ বলতে বলতে গলা বুজে আসে গায়ত্রী রায়ের। দু চোখের ঘন কুয়াশা গঙ্গা পদ্মা হয়ে, ফর্সা গাল বেয়ে গড়িয়ে জল নামতে থাকে। ‘—অভাগা আমি সন্তান তোর/ ছাড়িয়ে চলিনু ভারতভূমি।’ মায়ের আবেগ বোজা গলায় সেই আবৃত্তি এখনও আমার কানে বাজে। বাজতেই থাকে। এই কবিতার যিনি স্রষ্টা তাঁকে প্রণাম জানাই।
২) অমরনাথ রায়— অমরনাথ রায় আমার পিতা, আগাগোড়া যাকে বলে অতি উগ্র সুভাষপন্থী। খানিকটা আচ্ছন্ন ব্যক্তি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিতে কিন্তু নিজের ভোটটি দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— না ভাঙা সিপিআই-এর কাস্তে-ধানের শীষে। তারপর এক কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে দুই হলে কাস্তে-হাতুড়ি-তারায়— সিপিআই (এম)-কে। রেল চাকুরে অমরনাথ সুভাষ অনুগামী লীলা রায়ের ট্যাবলয়েড— সম্ভবত মাসপত্র ‘জয়শ্রী’ নিয়মিত কিনে আনতেন। বালক ব্রহ্মচারীর সন্তান দল-এর ‘কড়া চাবুক’ দাবি করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বেঁচে আছেন। ও যোদ্ধা বেশে ঘোড়ার পিঠে তিনি আবির্ভূত হবেন ‘আজাদি সৈনিকদের’ সঙ্গে নিয়ে। তখন ‘জাগৃহি’ বলে একটি ট্যাবলয়েড প্রকাশ হত। তাতে ‘শৌলমারির সাধু কি নেতাজি’ এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নানা লেখা বেরতে থাকে। শৌলমারির সাধুর আর এক নাম ‘গুমনামি বাবা’। তাঁকে ঘিরেও নানা স্টোরি— কথা-কাহিনি-গুজব। পঞ্চাশের শেষ, ষাটের দশকেও এইসব কথা ঘুরপাক খেতে থাকে। বাজারে তখন জোর গুজব কল্যাণীতে নাকি দেখা গেছে সুভাষচন্দ্রকে। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর শেষ শয্যায় মাথার কাছে নাকি সুভাষচন্দ্র বসু— নেতাজি। এরপর শৌলমারির রহস্যময় সাধু, ‘গুমনামি বাবা’-কে নিয়ে অনেক অনেক গল্প। তাঁকে লেখা চিঠিপত্র, তাঁর লেখা চিঠিপত্র। প্রোফাইল পিকচার। লম্বা পাকা দাড়ি, টাকমাথা। এসব নিয়ে বইটইও তো বেরল অনেক, বাংলা, ইংরেজি-তে। অনেক, অনেক রহস্য তাঁকে ঘিরে। ‘কড়া চাবুক’ ও ‘জাগৃহি’ বিক্রি বেশ হয়, যদি নেতাজির জন্মদিন— ২৩ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবস— ২৬ জানুয়ারি, স্বাধীনতা দিব— ১৫ আগস্ট কাছাকাছি আসে। তখন একই ছবি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ম্যাটার মানে সংবাদ নির্যাস— একই। বালক ব্রহ্মচারী দাবি করতেন তাঁর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ‘সন্তান দল’-এর ‘রামনারায়ণ রাম’— ‘রাম নারায়ণ রাম’ গাওয়া সন্তানেরা বিশ্বাস করতেন, প্রচারও করতেন— নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হলেন কলির গাণ্ডিবী— অর্জুন। আর বালক ব্রহ্মচারী হলেন তাঁর সারথী— স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। ১৯৬০ দশকের শেষ পর্যন্ত এই তিনটে দিন— ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ আগস্ট— প্রত্যেক বছর বাবা হাজির হতেন মনুমেন্ট ময়দানে— তখনও মনুমেন্ট ময়দা শহিদ মিনার ময়দান হয়নি। সেখানে গিয়ে বাবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেন সুভাষ দর্শনের জন্য। যদিও অমরনাথ রায় আমাকে বলেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন শ্রমের পর তিনি বাড়ি ফিরতেন যখন শহিদ মিনার থেকে, তখন তাঁর চেহারা একেবারে হতমান জনের যেমন হয়ে থাকে তেমনই। বাড়িতে এসে তিনি প্রায় মৌন, আহারে রুচি নেই। কারণ, সুভাষ আসে নাই। সুভাষ ঘরে ফেরে নাই। বছরের এই তিনটে দিন বাবা যেন সব হারানো এক মানুষ। নেতাজি আসে নাই।
আরও পড়ুন
জুয়া মেলা, মেলার জুয়া, ঝান্ডিমুণ্ডি
৩) নেতাজিদাদু থাকতেন বাগবাজারে, ভাড়া বাড়িতে বোস পাড়ার কাছাকাছি। অসম্ভব কেতাদুরস্ত। শৌখিন। রাস্তার কলে স্নাও করতেন মলয় চন্দন সাবান ঘষে। এক সময় মাথাভর্তি কালো কুঞ্চিত কেশদাম। পরে আগাগোড়া ইন্দ্রলুপ্ত। ঘাড়ের ওপর এসে লুটোপুটি খেতে থাকে কুঞ্চিত অবশেষ। তাঁর কাছে গপপো শুনেছি— নিজের যৌবনবেলায় সেলুনে তাঁর মাথা থেকে কেটে নেওয়া কোঁচকানো কেশ সেলুন-কাটিয়ে— যিনি চুল কাটান, সেই নরসুন্দর নেতাজি-দাদুর এই সম্পদটি— কর্তিত কেশ রাখতেন আলাদা করে। তো সেই বিকচ নেতাজি দাদু, তিনি আমার পিসেমশাই গীষ্পতি ভট্টাচার্যর মামা। বাগবাজারের এই ‘নেতাজিদাদু’ সাদা ফুল শার্ট, কেমব্রিকের, মিলের কালো পাড়, ফাইন ধুতি। সেনগুপ্তর ধুতিও হতে পারে। জীবন রসিকজন। তিনি আমার পিসেমশাই গীষ্পতি ভট্টাচার্যর বড়ো মামা। শনিবার শনিবার কলকাতা রেস, অশ্বচরণে নিবেদিত প্রাণ। কিঞ্চিৎ ‘ঢুকু’-ও। কাজী নজরুলের সঙ্গে চেহারার অসম্ভব মিল। বিশেষ করে নজরুলের শেষ বয়সে ছবি। তাঁর পুত্ররা— মদন, মিহির, সমীর। ভাইয়েরা অনু, উদাই, ফুদাই। মেয়ে মঞ্জু। তাঁকে অনেকেই ‘সেপাই’ বলে ডাকে পেছনে, তাঁর শরীর সংস্থানের জন্য। মদনবাবু ফুটবলার, বাটায় খেলতেন। ভালো খেলতেন ফুটবল। বাগবাজারের অতি নামকরা সেনবাড়ির কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন প্রণয়সূত্রে। মদনবাবু একটু মোটার দিকে গড়ন, কিঞ্চিৎ স্থূলকায়, রোমশ। ফরসা, মাথায় টাক। মদনবাবুর ছোটো ভাইরা সমীর ও মিহির— দুজনেই রাজনীতি— প্রত্যক্ষ রাজনীতি— যথাক্রমে সিপিআই (এম) ও সিপিআই (এম-এল), অনুবাবু নকশালবাড়ির রাজনীতিতে, প্রত্যক্ষত। সে বড়ো সুখের সময় নয়। নেতাজিদাদু— তাঁকে ‘দুল্লবি’ বা ‘দুল্লভি’ বলতেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা। কেন ‘দুল্লবি’ বা ‘দুল্লভি’ জানা নেই। এই নামের ভাঙাভাঙিতে আরও একটি নাম ছিল। সেই নামটা কী ‘দুর্লভ’? জানি না। জানতে চাইনি তখন। মাথায় আসেনি। নেতাজি-দাদু দুচক্ষে দেখতে পারতেন না জবাহরলাল নেহরু আর মহাত্মা গান্ধীকে। ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন এই দুজনের ওপর। বহু উদ্বাস্তু গড় বাঙালি যেমন— পূর্ববঙ্গ থেকে আসা। তাঁদের অনেকেরই ব্যক্তিপুরুষ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যদিও শ্যামাপ্রসাদ আর সুভাষের চিন্তামেরু একেবারে বহু বহু দূরবর্তী। অনেক অনেক দূরের। সুভাষচন্দ্র ঘোর বিরোধী আর এস এস— রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের, হিন্দু মহাসভার। তার লিখিত প্রমাণও আছে, নানা কথা ও কেতাবে। গীষ্পতি ভট্টাচার্য— আমার পিসেমশাইয়ের বড়োমামা ‘দুল্লবি’ বা দুল্লভি— তাঁদের আরও বাকি দুই ভাই। পিসেমশাইয়ের মেজোমামা কিছুই করেন না প্রায়। টুকটাক ব্যবসা, রেসের মাঠ, শখের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। তিনি বাগবাজার থেকে হেঁটে চেতলায়— ৪০/১এ জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেন বা জয়নুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে আসতেন। শুধু দুপুরবেলায় ভরপেট খাবারের জন্য। তাঁর পরিবারটি বড়ো— তিন ছেলে, তিন মেয়ে। বড়ো ঝর্ণা, তারপর ফুচি, তারপর ঝুনু, তারও পরে একটি কন্যা। তিন ছেলে— রবি, রমু এবং দুখে। দুখের জন্ম হয় তার বাবার মৃত্যুর পর। গীষ্পতিবাবুর মেজোমামার টিবি হয়েছিল। অথবা থাইসিস। তিনি পায়রা ওড়ানো ও ঘুড়িতেও যথেষ্ট দড় ছিলেন। যাকে বলা যেতে পারে এক্সপার্ট। তাঁর পরের ভাই গ্যারেজ চালাতেন। গাড়ির গ্যারাজ। বাগবাজারে সেই গ্যারাজের ব্যবসা যথেষ্ট রমরমা। চমৎকার চলে। নেতাজিদাদুর কথা এখানেই শেষ নয়। দেশের বাড়ি ফরিদপুরে হলেও তিনি ঘোর মোহনবাগানী। মোহনবাগান সাপোর্টার। খেলার মাঠে নিয়মিত, মোহনবাগানের খেলা থাকলে। নেজাতিদাদুর কথা আপাতত শেষ। এবার লিখব আমার শ্বশুরমশাই আনন্দগোপাল ভট্টাচার্যর কথা। যিনি তাঁদের বরানগরের পৈত্রিক বাড়ি থেকে পালিয়ে, লুকিয়ে যোগ দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্রিটিশ— ইন্ডিয়ান আর্মিতে। তারপর সেই সেনাবাহিনীর থেকে অস্ত্র চালনা ইত্যাদি ট্রেনিং নিয়ে তাঁরা কয়েকজন লুকিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনী— আজাদি সেনার কাছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, লক্ষ্মী সায়গল, শাহওয়াজ খান, ক্যাপটেন ধিলোঁ, সায়গল। পরবর্তী পর্বে আনন্দগোপাল ভট্টাচার্যদের আইএনএ-তে যোগ দেওয়ার অভিযান নিয়ে বিস্তারিত।
আরও পড়ুন
মিসা ছিল ‘মিছা’-র নামান্তর
Powered by Froala Editor