চেতলা— ‘চেদলা’ এবং…

চেতলা বয়েজ হাইস্কুল— দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট লাগোয়া চেতলা বয়েজ বা চেতলা বয়েজ হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন আমার পিসিমা কিরণপ্রভা ভট্টাচার্যর শ্বশুরমশা শ্রীপতি ভট্টাচার্য। তিনি দুই পুত্র গীষ্পতি এবং রমাপতির পিতৃদেব। তাঁর হাই ব্লাড স্যুগার। সম্ভবত তিনি সংস্কৃত পড়াতেন। আমার বড়ো মেসোমশাই মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য— ডাকনামে গণেশ, শ্রীপতি ভট্টাচার্যর ছাত্র ছিলেন। গীষ্পতি ও মহেন্দ্রনাথ চেতলা বয়েজ হাইস্কুলে সহধ্যায়ী। শ্রীপতি ভট্টাচার্যর প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন। এই পক্ষে তাঁর একটিই কন্যা— অঞ্জলি। চেতলায় আমার পিসতুতো দিদি যাঁকে বড়দি ডেকেছি বরাবর, তাঁরই সমবয়সি অঞ্জলি পিসি। অর্থাৎ গীষ্পতি ভট্টাচার্যর কন্য ও শ্রীপতি ভট্টাচার্যর কন্যা প্রায় এক বয়সি। আগে— আজ থেকে বছর তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট আগে এমন তো হামেশাই হত ইদানিং ব্যাপারটা কল্পনাও করা যায় না হয়তো। শ্রীপতি ভট্টাচার্য মধুমেহর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আসা অন্য অন্য পার্শ্ব অসুখে প্রয়াত হন। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল কালীঘাটে। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন বড়দি— দীপালিদি— দীপালি ভট্টাচার্য। সেইসঙ্গে পিসিমা— মিসেমশাইয়ের ছোট কন্যা অদিতি— মিনু। চেতলা গার্লস স্কুল ভাড়া করে ১৯৬৬-র গ্রীষ্ণে দীপালিদিদি— বড়দির বিবাহ হয় কালীঘাটের চারুভূষণ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। সুদর্শন জামাইবাবু একটু শ্যামবর্ণ। কিন্তু চোখ ও মুখশ্রী অপূর্ব। অনেকটা যেন বাংলা সিনেমার অভিনেতা দিলীপ রায়। তখন সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে চালের অকাল, খাদ্যের তীব্র অভাব। দেশজুড়ে জাতীয় কংগ্রেসের শাসন। রাজ্যে কংগ্রেস শাসন। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন— পিসি সেন। খাদ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রীও তিনি। চাল নেই। চাল নেই। তখন হাফ রেশনিং, ফুল রেশনিং এলাকায় ভাগ করা গোটা পশ্চিমবাংলা। কর্ডনিং, লেভি, হোমগার্ড, এনভিএফ— ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার ফোর্স, ‘চাল ধরা পুলিশ’— এইসব শব্দাবলী ঢুকে পড়ছে বাঙালি জীবনে। চাল পাচার হয়, চোরা চালান। ব্ল্যাকে— ব্ল্যাক মার্কেটে চাল দামি। ৯৭ নয়া পয়সা দশ আনার ফাইন চাল, এক কিলো চাল দশ আনা ঝড়াস করে এক লাফে এক টাকা হয়ে গেল। এক টাকা মানে একশো নয়া পয়সা। চেতলাকে কালীঘাটের বাসিন্দারা একটু ‘খাটো’ বা মাটো চোখে দেখতেন। চেতলায় তখনও খোলার ঘর— হোগলার ঘরে ওড়িয়া জনেরা তেলেভাজা ভাজেন। ডালবড়া, ফুকুরি, আলুরি, কুমড়ি, পেঁয়াজি, আলুর চপ, বেগুনি, শাকের বড়া, খুব বিক্রি। চেতলায় তখন ওড়িয়া যাত্রা হয়— রামলীলা। আমি ছয় দশকের কথা বলছি। তখনও আদি গঙ্গার ওপর কাঠের সেতু। তার ওপর দিয়ে বাস, ট্যাক্সি, গাড়ি, স্কুটার, মোটর সাইকেল তো ছার, মানুষ টানা রিকশাই যায় না। তখন চেতলা থেকে সরকারি— লাল দোতলা বাস ছাড়ে। রাজ্য ঘুরে— শেয়ালদা ইত্যাদি হয়ে উত্তর কলকাতায় পৌঁছায়। ৩৩ নম্বর সরকারি লাল বাস। ১৭ নম্বর প্রাইভেট বাস চালু হয়নি। ১৭এ-ও না। থ্রি বি আছে। ১৭ নম্বর প্রাইভেট বাস হাওড়া-চেতলা, চেতলা-হাওড়া যাতায়াত করে। সরকারি এস সেভেনটিন চালু হতে অনেক অনেক দেরি। চেতলায় কালীপুজো বিখ্যাত। চামুণ্ডা, দশমুণ্ড কালী। পরে তো চামুণ্ডা দুটো পুজো হতে থাকল। কাছেই গা লাগোয়া আলিপুর। নিউ আলিপুর। আলিপুর চিড়িয়াখানা, আলিপুর কোর্ট, আলিপুর পুলিশ কোর্ট, জাজেস কোর্ট— সেশানস কোর্ট, বড়ো পোস্টাপিস। চেতলার আফতাব মস্ক লেনে কবি দীনেশ দাস থাকেন। তাঁর পুত্র, তিনিও কবি, শান্তনু দাস, শান্তনু দাসের স্ত্রী— তখনকার— সাত দশকের বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী সীমন্তিনী দাস, সবাই আফতাব মস্ক লেনের বাড়িতে। দীনেশ বাবু বাংলা পড়ান চেতলা বয়েজ-এ। সামান্য স্ট্যামার করেন। কথা বলতে গেলে থুতু ছেটে। শ্যামবর্ণ। হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি আর ধুতি, পায়ে পাম্প শ্যু। সাম্যবাদের আদর্শে বিশ্বাসী এই কবি লেখেন তাঁর অতিবিখ্যাত কবিতা ‘কাস্তে’।  

বেয়নেট হোক যত ধারালো—
কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিও বন্ধু
নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে!
ইস্পাতে কামানেতে দুনিয়া
কাল যারা করেছিল পূর্ণ,
কামানে-কামানে ঠোকাঠুকিতে
আজ তারা চূর্ণবিচূর্ণ
চূর্ণ এ-লৌহের পৃথিবী
তোমাদের রক্ত-সমুদ্রে
গ’লে পরিণত হয় মাটিতে,
মাটির—মাটির যুগ ঊর্ধ্বে!
দিগন্তে মৃত্তিকা ঘনায়ে
আসে ওই! চেয়ে দ্যাখো বন্ধু!
কাস্তেটা রেখেছো কি শানায়ে
এ-মাটির কাস্তেটা, বন্ধু!

দিনেশ দাসের আর একটি কবিতার বই ‘রাম গেছে বনবাসে’। খুব যে ভালো পড়াতেন, এমন নয়, ক্লাস ম্যানেজের ক্ষমতাও খুব ছিল না। ক্লাস ম্যানেজ বা ক্লাস কনট্রোলের। কিন্তু কবি তো তিনি। কবি দিনেশ দাস। চেতলা বয়েজ হাই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই শৈলেনবাবু— শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নাকি বন্দ্যোপাধ্যায়, সে যাই হোক, তিনি ছিলেন ঘোর জাতীয় কংগ্রেসি। প্রার্থীও হয়েছিলেন নির্বাচনে। জিততে পারেননি, সম্ভবত কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে। তখন কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের— ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর নির্বাচনী প্রতীক জোড়া বলদ নয়। ঘড়ি— বড়োসড়ো দাঁড় করানো পেন্ডুলাম সহ ঘড়ি। না ভাঙা কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী প্রতীক কাস্তে ধানের শীষ নয়, পাকা বাড়ি, পাকা বাড়ি হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি বা বিরোধীদের নির্বাচনী চিহ্ন। ভোটের মিছিলে রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান উঠত— ‘ভোট দেবেন কীসে? ঘড়ি মার্কা বাক্সে’, ‘ভোট দেবেন কীসে? পাকা বাড়ি মার্কা বাক্সে।’ এছাড়াও কুঠার, কুঁড়েঘর, জোড়া পাতা, জোড়া পায়রা, টর্চ লাইট ছিল কর্পোরেশন ভোটে নানা দলের, গোষ্ঠীর নির্বাচনী প্রতীক। হাওড়া পুরসভা নির্বাচনে সাধারণতন্ত্রী দল, যা এখন বিলুপ্ত বহু বছর হল, সেই সাধারণতন্ত্রী দলের সঙ্গে নির্বাচনী আসন সমঝোতা করে জাতীয় কংগ্রেসকে পরাচিত করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে সেই প্রথম জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী যুক্ত ফ্রন্টের চিন্তার সূচনা হল। সেটা পাঁচের দশকের শেষ সম্ভবত। প্রশান্ত সরকার— কমিউনিস্ট পার্টির টেক নেমে যিনি ধরনী, তিনিই প্রথম এই জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী অকংগ্রেসি যুক্ত ফ্রন্টের স্থপতি। তাঁর মাথা থেকেই এই জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী অকংগ্রেসি জোটের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আসে। প্রশান্ত সরকার পার্টি টেক নেমে ‘ধরনী’। অবশ্য পরে না-ভাঙা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সিপিআই থেকে ‘এক্সপেলড’— বহিষ্কৃত হন। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। পরে কখনও বলা যাবে। চেতলায় বরাবরই সিপিআই-এর একটা প্রভাব ছিল। মণি সান্যাল ছিলেন সিপিআই-এর অবিসংবাদী নেতা। তিনি বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়াতেন ও জিততেন, আলিপুর কেন্দ্র থেকে। কাস্তে ধানের শীষ তাঁর দলীয় প্রতীক চিহ্ন— ইলেকশন সিম্বল। কলকাতা পুরসভার নির্বাচনেও তিনি দাঁড়াতেন, না-ভাঙা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে। পরে এক পার্টি ভেঙে দুই হলে তিনি সিপিআই-তেই থেকে যান। চেতলার অধিকাংশ মানুষ সিপিআইকে নয়, ব্যক্তি মণি সান্যালকে ভোট দিতেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের নেতা। ‘মণিদাকে ভোট দিন। মণিদাকে ভোট দিন। মণিদাকে ভোট দিন।’ এই উচ্চারণ তখন মুখে মুখে। সাদা ধুতি, মিলের। সাদা পাঞ্জাবি। মাথার কালো চুলে ব্যাকব্রাশ। পায়ে ঝকঝকে জুতো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ইনি মণি সান্যাল, সিপিআই নেতা। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি— ‘চোখের মণি’। তখন চেতলা আলিপুর কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। মণি সান্যাল দাঁড়াতেন কাস্তে-ধানের শীষ— এই নির্বাচনী প্রতীক চিহ্নে। বিধানসভায় দাঁড়াতেন মণি সান্যাল। আলিপুর কেন্দ্রে লোকসভায় সিপিআই প্রার্থী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর যেমন সিপিআই ক্যানডিডেট লোকসভায়, ১৯৭৪ সালে পার্টি— সিপিআই— ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে সিপিআই ও সিপিআই (এম) হওয়ার পর সিপিআই (এম) আলিপুর কেন্দ্রে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা— সিআইটিইউ নেতা মনোরঞ্জন রায়কে প্রার্থী করে। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত জেতেন। এই আলিপুর কেন্দ্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী হন নরেন সেন। জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক তখন জোড়া বলদ। চেতলায় সিপিআই-এর কিছু সমর্থক ছিলেন। সিপিআই (এম)-এরও। পরে নকশালপন্থীদের— সিপিআই (এমএল)-এরও প্রভাব তৈরি হয় খানিকটা। জয়নুদ্দিন বা জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে আমার পিসিমা কিরণপ্রভা দেবী ও পিসেমশাই গীষ্পতি ভট্টাচার্যর বাড়ি। গীষ্পতি ভট্টাচার্যর ছোটোভাই রমাপতি ভট্টাচার্য। তাঁর একটি অতি চমৎকার বুক স্টল ছিল রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে। ‘শ্রী গোপাল বুক স্টোর্স’ বা ‘গোপাল বুক স্টোর্স’। রমাপতিবাবুর বই-ম্যাগাজিনের দোকান বলেই অতি পরিচিত ছিল সেই বই দোকান। যতদূর জানি সেই বুকস্টলের মালিকানা হস্তান্তর হয়ে গেছে— আজ কয়েক বছর হল। এই দোকানের— বই দোকানের সঙ্গে বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। শৈশবের— বালক বেলার— কৈশোরের। রমাপতিবাবু— ডাকনামে পঞ্চা, তাঁকে তো ‘কাকু’ বলেই সম্বোধন করতাম, যেহেতু পিসতুতো দাদা, দিদিরা, ভাই-বোনেরা তাঁকে ‘কাকামণি’ সম্বোধন করেন, তাই তিনি আমারও ‘কাকু’। তিনি— রমাপতিবাবু খুবই শৌখিন মানুষ ছিলেন। চমৎকার ফাইন ধুতি-পাঞ্জাবি বা ধুতি-শার্ট। চোখে কালো ফ্রেমের— লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা। পায়ে ঝকঝকে জুতো, ব্যাকবেল্ট অথবা কাবলি। লম্বার দিকেই গড়ন। সিগারেট খেতেন। পাইপ। চুরুট। চুরুট মাঝে মাঝেই। তবে তা বর্মা চুরুট নাকি হাভানা চুরুট বলতে পারব না। দেশী চুরুট বা চুরোটও হতে পারে। আবার তামাক— অশলা পাকিয়ে সিগারেট বানিয়ে খেতেন। তাও দেখেছি। ‘ক্যাপস্টেন’ বা ‘ফিলটার উইলস’। জৈনুদ্দিন বা জয়নুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে ‘বলাই স্মৃতি সংঘ’ নামের ক্লাব। আমার পিসিমার বাড়ির ঠিকানা ৪০/১এ জয়নুদ্দিন বা জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেন। তার উল্টোদিকের মাঠেই ‘বলাই স্মৃতি সংঘ’, চেতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব। ৪০/১এ জয়নুদ্দিন বা জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনে বলাই স্মৃতি সংঘের তাসের আড্ডা, প্রতি রবিবার। ওমে, কিমে, ষাঁড় বাপি, সুবল, কেষ্ট, পিচিনাথ, মদন। বাপি থেকে ষাঁড় বাপি। সুবল, কেষ্ট ভাই। সুবল সামান্য বাহুবলী টাইপ, ব্যায়াম করে নিয়মিত। তাদের এক দাদা সুলু— সে দিনরাত হাতে ঘড়ি, ছিটের হাফ শার্ট, অল্প উঁচুতে তোলা পায়জামা, যাকে পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় বৈটি— হ্যাঁ, বৈটি পায়জামা বলা হয়, পায়ে স্যানডেল। কেষ্ট-সুবলদের দাদা সুলু যাকে বলা যেতে পারে সাজা পাগল। সব সময় নস্যি। হাফ শার্টের বাম পকেট বা ঝুল পকেটে নস্যির ডিবে। সঙ্গে নস্যির রুমাল। সুলুর একটু ‘ছেলেবাজির’ দোষ আছে। নাদুসনুদুস, গোলগাল বাচ্চা দেখলেই টেনে কোলে বসানো, হয়তো একটু জোর করেই। তারপর চুমু দেবে সেই শিশু বা বলকের গালে। এই হচ্ছে সুলু। কেষ্ট-সুবল নিজের ধান্দায়। ষাঁড় বাপি টার্গেট করে বলাই স্মৃতি সংঘর মাঠের পাশে দতলা বাড়ির সুশীল রায়ের কন্যা স্বপ্নাকে। স্বপ্না ফর্সা, আলগা সৌন্দর্য আছে। তার তিন ভাই দীপক, কমল, তাপস। দীপক, কমল দাদ, তাপস ছোটো ভাই। সুশীল রায়ের বাড়ির পাশেই পাইনবাবুদের তিনতলা, একদম রাস্তার ওপর। সুশীল রায় রোগা-পাতলা, ফর্সা, মিলের ধুতি, সাদা কেমব্রিজের শার্ট। সামনের ওপরের পাটির দাঁত সামান্য উঁচু। পায়ে স্যানডেল। সুশীল রায় জৈনুদ্দিন মিস্ত্রি লেনের চেতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি। ফলে অষ্টমীর ভোগের লুচি— অবশ্যই গাওয়া ঘিয়ের, তাঁর বাড়িতে বড়োসড়ো কাঁসার থালা ধরে। সঙ্গে ঘি চপচপে কিশমিশদার হালুয়া— মোহনভোগ। স্বপ্নাকে— সুশীল রায়ের মেয়ে স্বপ্নাকে দেখতে অনেকটা তার মা যেমন, তেমন। বলাই স্মৃতি সংঘের মাঠে নিয়মিত হাড্ডাহাড্ডি ফুটবল, টুর্নামেন্ট। এই মাঠের ওপরই শিবাজি আর নেতাজিদের বাড়ি— দুই ভাই। একতলা বাড়িতে মা, বাবা ও দুই ভাই— শিবাজি ও নেতাজি। নেতাজি বড়ো, শিবাজি ছোটো। সম্ভবত তাদের পদবি মিত্র। আমার পিসতুতো ভাই বাচ্চু— অলক ভট্টাচার্যর বন্ধু— সহধ্যায়ী শিবাজি। নেতাজি শিবাজির থেকে অনেকটাই বড়ো, বয়সে। শিবাজি তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে পড়ে, বাচ্চুর সঙ্গে। বাচ্চু— অলোক ভট্টাচার্য প্রথমে চেতলা বয়েজ হাইস্কুল, তারপর তীর্থপতি ইনস্টিটিউশন। দেশপ্রিয় পার্কের উল্টোদিকে তীর্থপতি। পাশেই প্রিয়া সিনেমা। আমি ১৯৬৯ সালে বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয় থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করি, কমার্স নিয়ে। তখন বাণিজ্য শাখায়— কমার্স নিয়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করা বেশ কষ্টের— পরিশ্রমের। তখন ঘোর রাজনীতি করি। নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে সিপিআই (এমএল)। ১৯৬৭-র ২৪-২৫ মে নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ। তখন পশ্চিমবাংলায় যুক্তফ্রন্টের শাসন। গুলি চলল নকশালবাড়িতে। নিহত হলেন কৃষক, কৃষক-রমনীরা। ১৯৬৯-এর ২২ এপ্রিল লেনিনের জন্মদিনে তৈরি হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)— সিপিআই (এমএল)। ১৯৬৯-এর পয়লা মে— ঐতিহাসিক মে দিবসের দিনে মনুমেন্ট ময়দানে— তখনও মনুমেন্ট ময়দান শহিদ মিনার হয়নি, তো সেই মনুমেন্ট ময়দানে বাঁধা মঞ্চ থেকে কানু সান্যাল ঘোষণা করলেন নতুন পার্টি— নতুন কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই (এমএল) গঠনের কথা। কানু সান্যালের সেদিন হাতে পিকিংয়ে ছাপা রেডবুক— মাও-সে-তুঙের অতি বিখ্যাত ‘লাল বই’, যার ভূমিকা-কথা ভাইস চেয়ারম্যান লিন-পি-য়াও বা লিন-বি-য়াও-এর। কানু সান্যাল সেদিন খাকি হাফ প্যান্ট পরা, গোল গলা সাদা গেঞ্জি। 

Powered by Froala Editor