ইলাহাবাদের হোলি, বাংলার দোল

ইলাহাবাদে, কাশী, বৃন্দাবনের দোল দেখেছি খুব মন দিয়ে। খেলেছিও। বৃন্দাবনে, মথুরায় দোল খুবই মশহুর— বিখ্যাত। নয়ের দশকে শুনি— মিডিয়া শোনায় ‘কাপড়া ফাড় হোলি’-র কথা। অর্থাৎ, সেরকমভাবে কাউকে বাগে এনেই, জোরজার তার জামা-কাপড় ছিঁড়ে তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে— একেবারে ল্যাংটাচোংটা— পুববাংলায় উচ্চারণ করা হত ল্যাংঠা-চোংঠা করে দিয়ে তারপর তাকে ভালো করে রং মাখানো অথবা রং মাখিয়ে ল্যাংটো বা ন্যাংটো করা। ‘কাপড়া ফাড় হোলি’ খেলতেন লালুপ্রসাদ যাদব। তখন তিনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। তার বাংলোতেই ‘কাপড়া ফাড় হোলি’। লালু-জায়া রাবড়ি দেবী বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ও ‘কাপড়া ফাড় হোলি’ চালু বিহারে। তখন তো লালুপ্রসাদ যাদবের নামে ‘চালু চালিশা’ বেরোয় একাধিক। একেবারে ‘হনুমান চালিশা’-র আদলে। লোকের— সাধারণ জনের মুখে মুখে ফেরে এই বার্তা— ছিকুলি হয়ে— ‘যবতক সামোসা মে আলু/ তব তক বিহার মে লালু’। তো সেই যাই হোক, সামোসা— সিঙ্গাড়ার পুরে আলু থেকে গেছে। কিন্তু বিহারে লালুপ্রসাদ বা লালুজির রাজত্ব থাকেনি। পৃথিবীর নিয়মই এরকম। শাসন ক্ষমতায় শাসক চিরকালীন, চিরায়ত, চিরস্থায়ী নয়, তা তিনি যে মতাদর্শেরই হোন না কেন। আর এই স্থায়িত্ব, স্থায়ী হয়ে কায়েমিভাবে, গেড়ে বসা উচিতও নয়। কলকাতায় ছোটোবেলায় দোল বলতে লাল— ‘খুন-খারাপি’ রং। বাবা এনে দিতেন, বড়োবাজার থেকে, কৃষ্ণ মার্কা ছোটো টিনের কৌটোয় সিল বন্দি রং। দারুণ, খুব পাকা। বাবা সেই রং গুলে দিতেন টিনের পিচকিরিতে। টিনের পিচকিরি, ছোটোর দাম একটাকা, বড়ো পাঁচটাকা। কৃষ্ণ মার্কা ‘খুন-খারাপি’ রঙের কৌটো তিনটাকা। অ্যালুমিনিয়াম ডাস্ট, সোনালি চূর্ণ রং, বাঁদুরে রং, এসব তো ছিলই। ছিল পাড় বেগুনি আর হলুদ রং। আবির তো লালই— অভ্র মেশানো লাল আবির। দুটাকার আবির কিনলে ভেসে যায়, সেই আবিরে রং ঢালেন একটু পয়সাঅলা আর্থিক সামর্থবানেরা। আবির— ভালো, বিশুদ্ধ আবির দিয়ে কোরামিনের কাজ হত চার, পাঁচ, এমনকি ছয়ের দশকেও। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া রোগীর— এমনকি মরণোন্মুখ মরিজ— রুগির হাতের পাতায়, পায়ে, কপালে আবির, আবির ঘষে দেওয়া। তখন তো লাল আবিরই, সেই আবির দিয়ে আবিরখেলা। সুযোগ আর আধাসম্মতি পেলে প্রিয় নারীর গাল, কপাল, এমনকি স্তনাগ্রও আবির রঞ্জিত। বড়োদের— গুরুজনদের, মাস্টারমশাইদের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করা— এ ছিল হিন্দু বাঙালির রীতি-রেওয়াজ। আমার গর্ভধারিণী গায়ত্রী রায় গপ্পো করেছেন, চারের দশকের শেষ দিকে, উত্তর কলকাতার বাগবাজারের লক্ষ্মী দত্ত লেনে হেরম্ব কবিরাজ মশাইয়ের বাড়িতে এক খানা ঘর নিয়ে ভাড়া থাকতেন হরিপদ রায়। শিক্ষক হরিপদ রায়ের পায়ে আবির দিতেন তাঁর ছাত্ররা। সেই আবির গুঁড়ো, যেটুকু সি্মেন্ট মাজা পাকা মেঝেতে পড়ত, সেটুকুও হাতের আঙুল খুব সন্তর্পণে কুড়িয়ে, কাচিয়ে নিতেন গায়ত্রী রায়, নমিতা রায়, ঊষারানি রায়ের তদ্দিনে বিবাহ হয়ে গেছে। ওই আবিরটুকুই গায়ত্রীদের দোল-সম্পদ। পাঁচ, ছয়, সাতের দশসকের গোড়াতেও বাঙালির আবির বলতে লাল আবিরই। তারপর তো ক্রমে ক্রমে ম্যাজেন্টা এল। এরপর সবুজ। এখন তো লাল, ম্যাজেন্টা, সবুজ, হলুদ, নীল। কত রং আবিরের। আমাদের বাল্যকালে ছিল ম্যাজিক রং বা ভ্যানিশ রং। জলে গুলে তা ছোটো প্লাস্টিক পিচকিরিতে নিয়ে সাদা শাড়ি বা সফেদ পাঞ্জাবিতে দিলে আধ ঘণ্টা, চল্লিশ মিনিটের মধ্যে তা একেবারে হাওয়া। সাদা যে কে সেই। আমার পিতৃদেব— অমরনাথ রায় যতদিন না প্লাস্টিকের পিচকিরি বাজারে এসেছে, ততদিন একটাকা দামের টিনের পিচকিরির ভেতরে রং তুলে আনার জন্য পুরনো ন্যাকড়া, মূলত মায়ের শাড়ির পাড় দিয়ে ওয়াশার তৈরি করে দিতেন। তাতেই রঙের জয়জয়ন্তী। পূর্ব ও পশ্চিমবাংলায় হিন্দু বাঙালির কাছে দোলের ‘মিষ্টি’ বা ‘মিঠাই’ মানে সাদা ও লাল বাতাসা, মুড়কি, চিনির মঠ। সেইসঙ্গে ফুটকড়াই, কদমা। তিলোই বা বীরখণ্ডী। তিলোই বা বীরখণ্ডী। এবং কদমা সরস্বতী পুজোতেই চলে বেশি। মঠও সামান্য। সেইসঙ্গে আবিরও দেওয়া হয় সরস্বতীকে। চিনির মঠ হয় রঙিন ও সাদা। রথ, মন্দির, ময়ূর, পাখি, মেম-পুতুল, কুকুর, হাঁস। রথই বেশি চলে, নয়তো মন্দির। ফুটকড়াই সাদা আর রঙিন— দুরকমই হয়। মেম-পুতুল মডেলের মঠ এখন আর প্রায় দেখিই না। মনে আছে ১৯৫৫ সালে কি ১৯৫৬-ও হতে পারে, আমার কালান্তক টাইফয়েড হয়। মরতে মরতে বেঁচে যাই, তখনও অ্যান্টিবায়োটিক বেরোয়নি, পেনিসিলিনও কি বেরিয়েছে, তো সেই টাইফয়েডের একুশ দিনের জ্বর, আমাকে একেবারে পেড়ে ফেলে। তখন শিবপুরের চাষা-ধোপা পাড়া লেনে ঢ্যাঙ মশাইদের বাড়ি একটা ঘর, দূরে রান্নাঘর ও কমন পায়খানা নিয়ে বাবা ভাড়া থাকেন। তো সেই যে আমার টাইফয়েড— জ্বর, তা দোলের পরও ছিল। মা রঙিন মঠ আর ফুটকড়াই তুলে রেখেছিলেন আমার জন্য, আরোগ্যের পর আমি খাব বলে। জ্বর রেমিশন হলে, ২১ দিনের পর উঠে আমি কাঁচকলা, পেঁপে, শিঙমাছ বা শিঙিমাছের ট্যালটেলে ঝোল দিয়ে নরম— বেশি সেদ্ধ করা ভাত দিয়ে টাইফয়েড মুক্তি পথ্যি করেছি। তারপর সেই মঠ, ফুটকড়াই। গায়ত্রী রায় রেখেছেন, তাঁর ভড়ো খোকা খাবে বলে। তখন গ্লুকোজের ভারী টিনের কৌটো হত, আবার পিসবোর্ডেরও। টাইফয়েড হওয়ার পর অনেক অনেক গ্লুকোজ খেতে হয়েছে আমায়, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। অ্যাস সাচ টাইফয়েডের তখন কোনো অ্যালোপ্যাথি ওষুধ নেই, সেই ১৯৫৫-৫৬ সালে। তখন ফিডিং কাপে করে রোগীদের ওষুধ খাওয়ানো হয় সম্পন্ন হিন্দু বাঙালি পরিবারে। আর ছিল ছোটো, বেঁটে ওষুধ খাওয়ার কাচের ক্লাস, তরল মিক্সচারের জন্য। এসবই ছিল আমাদের, এসেছিল আমার টাইফয়েড উপলক্ষ্য। যদিও আমার কোনোভাবেই, কোনো দিক থেকেই সম্পন্ন ছিলাম না, কিন্তু বাবা এনে দিয়েছিলেন তাঁর বড়ো পুত্রের আরোগ্যের জন্য। তো সে যাই হোক, মা তার বড়ো খোকার জন্য দোলের মঠ-ফুটকড়াই রেখেছিলেন মুখবন্ধ কৌটোর ভেতর, যাতে না গন্ধ পিঁপড়ে, কালো পিঁপড়ে অথবা লাল পিঁপড়ে ধরে। গায়ত্রী রায়ের আদরের বড়োখোকা সেই দোলের মিঠাই খেয়েছে, জ্বর মুক্ত হয়ে। টাইফয়েড হলে তখন সেই পাঁচের দশকের গোড়ায়, হয় চোখ, নয় কান, অথবা মস্তিষ্ক নয়তো হাত-পা— কিছু একটা যায়। আমার অবশ্য কিছুই যায়নি। কোনো অঙ্গহানিই হয়নি। ইলাহাবাদে দোলের মিঠি বলতে গুজিয়া, পেড়কি, ক্ষীর— পায়েস। গুজিয়া হল ভাজা সুজির ঝুরো পুর দেওয়া পিঠে, শুকনো। আর পেড়কি হল অনেকটা যেন পশ্চিমবঙ্গবাসীদের কাটা পুলি, তেমন কিছু একটা। ভাঙ— সিদ্ধি আর শরাব— দুই-ই খুব চলে ইলাহাবাদে। বেনেতি মশলার দোকান থেকে সিদ্ধিপাতা এনে, তা আগের রাতে ভিজিয়ে রেখে পাথরের শিলে বাটেন নারীরা। তারপর জল ভাঙে ক্বাথ তৈরি হয়ে গেলে তাতে কাজু বাটা, বাদাম— চিনা বাদাম বাটা, মখানা বাটা, পেস্তা বাটা, কিশমিশ— মুনাক্কা বাটা, গোলমরিচ বাটা— সব দেওয়া হয়। ভালো করে ভাঙ ঘোঁটা হতে থাকে অ্যালুমিনিয়ামের ঘটির ভেতর। দুধ, মালাই, খোয়া ক্ষীর— সব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মিষ্টি— চিনি। পশ্চিমবাংলায় সিদ্ধি বা ভাঙ তৈরি হয় বাটা সিদ্ধির সঙ্গে পেস্তা, কাজুবাদাম, চিনে বা চিনা বাদাম, গোলমরিচ বাটা মিশিয়ে ডাবের জলে গুলে। তার সঙ্গে সিদ্ধির নেশাকে আরও কড়া— মজবুত করার জন্য মেশানো হয় সিগারেটের ছাই, তামার পয়সা ঘষা, নারকেল বা সুপারি গাছের শেকড় বাটা। এইসব দ্রব্য মেশালে সিদ্ধির ‘নেশার ধক’, ‘দ্রব্যগুণ’ আরও অনেকটাই বেড়ে যায় বলে বিজ্ঞজন, রসিকজনের মতো। ইলাহাবাদে হোলি, মূলত তিনদিন। তবে তার রেশ থেকে যায় দিন সাতেক। হোলির আগের দিন মহল্লায় মহল্লায় হোলিকা রাক্ষষীর প্রতীক— হোলিকা নামের রাক্ষসীকে দমন বা তাৎক্ষনিকভাবে দাবানোর জন্য জ্বালানো হয় হোলিকা। বড়ো বড়ো কাঠের গুঁড়ি এনে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে মহল্লায় মহল্লায়— চৌরাস্তা— চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে ‘হোলিকা’ প্রজ্জ্বলন বা ‘হোলিকা’ জ্বালানো। হোলিকা জ্বালাবার কাঠ কেনার জন্য ভালো মতো টাকা তুলতে মোটা টাকার চাঁদা— চান্দার দাবি থাকে গৃহস্থের কাছে। যিনি অপারগ বলেন বা শ-পচাশ, পঞ্চাশ-একশো টাকা চাঁদা দেন না, ‘চান্দাবালা’দের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন, তাঁর বাড়ির দরজায় গুয়ের হাড়ি ভাঙা হয়। পাঁচ, ছয়, সাত দশকের ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা সহ অন্যান্য জায়গায় এই ছবি স্পষ্ট। তখন ইলাহাবাদে খাটা পায়খানা। তার মল অতি সহজলভ্য। পোড়া মাটির বড়ো বড়ো হাঁড়িতে সেই খাটা পায়খানার গু ভর্তি করে করে ‘হোলিকা’-র চান্দা দিতে অনিচ্ছুক জনেদের বাড়ি বাড়ি সেই টাট্টি পটাকনো। হোলিকার রাত অর্থাৎ হোলির আগের রাত থেকেই তো চলে ভাঙ আর মদোৎসব। ঠররা— কানট্রি লিকার যেমন আছে, তেমনই রয়েছে আংরেজি— ইংলিশ শরাব। তখন ‘মোহনমেকিংস’-এর রাম, হুইস্কি, বিয়ার— সবই বাজার কাড়া। মোহনমেকিংস-এর ক্যালেন্ডারও দারুণ। বুক, নাভি, উন্মুক্ত সব, সিক্ত বসনা সুন্দরীরা। হতে পারে তারা রবি বর্মা, হয়তো হতে পারে হেমেন মজুমদার, হতেও পারে চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায়। দামি, বিলিতি আর্ট পেপারে ছাপা, রঙিন, বর্ণময়, কি ভালো ছাপা। ১৯৭৯ সালে কলকাতার প্রেস ক্লাবে এক পেগ রাম, এক পেগ হুইস্কি, এক পেগ জিনের দাম আট টাকা। খোলা বাজারে, শপে তখন ষোলো টাকা এক পেগ, সবই— সবেতেই ৪৫% অ্যালকোহল। সেইসময়ে রাম বলতে ওল্ড মঙ্ক, রয়্যাল ট্রেজার, রয়্যাল রিজার্ভ। বাজারে সেভাবে ভোদকা বা ভদকা আসেনি। ‘স্মিরনভ’ ব্যান্ড ভোদকা আরও পরে। ‘ব্লু শার্ক’ আরও পরবর্তীতে, বহু পরে। পাঁচ, ছয়, সাতের দশকে পেট্রোল ও মদ— দুই-ই প্রায় ‘জলের দরে’। তখন অবশ্য সাধারণ জনের গড় রোজগার খুবই কম। ‘হোলিকা’-র রাতের পর, তিন দিনের, দিন রাতের হোলি। সাতের দশকের গোড়ায় ঘোড়ার পিঠে ইউনিফর্ম পরে হোলি খেলেছেন পুলিশের ডিএসপি, নিজে রঙিন, উর্দিও রঙিন, এ দৃশ্য ইলাহাবাদের। এই হোলির হুড়দঙ্গ— লওনডা-লাপাড়িদের গণ্ডগোলের ভেতরই ইলাহাবাদে, বনারসে— কাশীতে নারীরা ও ইসলাম ধর্মের নারীরা তো বটেই, পুরুষরাও রাস্তায় নামেন না, বেরোন না বাড়ি থেকে। কারণ ইসলাম ধর্মে রং ‘হারাম’, তাঁরা রং খেলেন না, লিবাস— পোশাকে রং নেন না। রং যদি দেওয়া হয়, তাহলে দাঙ্গা-ফাসাদ বেঁধে যেতে পারে, তাই অগ্রিম সতর্কতা। পশ্চিমবঙ্গে যেমন পুকুর ও নর্মদার পাঁক, মেশিনের কালি, কাঠ দিয়ে রান্না করা বড়ো হাঁড়ি-হান্ডার পোঁদের কালি— সব নিয়েই দোল দোল দোল। রং ফুরিয়ে গেলে শুধু জল। দোল খেলার পর পুকুরে নেমে স্নান। পুকুরের পানি দোলের রং-আবিরে লাল। বাঁদুরে রং, অ্যালুমিনিয়াম ডাস্ট— রুপোলি রং, শত সহস্র কেরোসিন প্রহারেও তারা কায়েমি, অটুট, অনড়। আর দুহাতের তালুতে, নখের কোণে থাবা গেড়ে বসে আছে রং আর রং। জলে মেশানো রং, লাল রং, বাঁদুরে রং, গোলাপী রং, কালো রং, সবুজ, হলদে, নীল রং— সবের মিলমিলোন্তি ককটেল। ইলাহাবাদে হোলির দ্বিতীয় দিনে প্রত্যেক পাড়ার— মহল্লায় মহল্লায় টাইটেল প্রদান। যেমন রমেশ— রমেশ ছিপকলি (টিকটিকি), বেড়ু-কাউয়া (বেড়ু-কাক), তিরভুবন নসুড়িয়া (তিরভুবন অপয়া), লাল্লু ঘোড়া (লাল্লু ঘোড়া)। ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায় দুজন লাল্লু বা লল্লু— ১) লাল্লু ঘোড়া, ২) লাল্লু বাড়া। নাহ, চন্দ্রবিন্দু নেই। বড়োসড়ো, খোলা লরির ওপর ভাঙচুর, মদচুর কমবয়সিরা। তাদের বেশিরভাগ জনের পরনেই সাইড কাটা— প্রায় বড়ুয়া কাটিং তানজেবের কুর্তা, লখনউ চিকনে তৈরি। লখনউ চিকনে তৈরি সোজা বোতাম, রেডিমেড কুর্তার দাম কম। সাউড কাটা প্রায় বড়ুয়া কাটিং তানজেবের কুর্তা হলে তার দাম অনেকটাই বেশি। ছয় দশকে অর্ডিনারি লখনউ চিকন কুর্তা দশ টাকা। আদ্দির কাপড় নয়, কেলিকো বা ন্যাড়া রাজা মার্কা আদ্দির তখন সবচেয়ে ভালো আর মহার্ঘ্য। ‘শাহজাদা’, কেমব্রিজেরই হবে কুর্তা। তাতে লখনউ চিকনের মেশিন-আজ। আর তাজজেবের কুর্তায়— পাঞ্জাবিতে যে চিকনের কাজ, তা একেবারেই অন্যরকম। তার দাম ছয়ের দশকে পঁচিশ টাকা। রেণুমাসি— বড়োমাসির মেজোপুত্র দিলীপ ভট্টাচার্য— বেড়ুদা এই তানজেবের কুর্তা পরত। খুব পছন্দ ছিল আমার, তানজেবের কুর্তা, হয়নি। সামর্থে কুলোয়নি। তাই আর পরা হল না লখনউ চিকনের তানজেবের কুর্তা। ইলাহাবাদের হোলির হুড়দঙ্গের সময় মাথায় অনেকেই মোটা কাগজে তৈরি নেহরু ক্যাপ পরতেন, সাদা, রঙিন। তখনও দেশ জুড়ে কংগ্রেস-শাসন। দু-একটা রাজ্যে জাতীয় কংগ্রেস ক্ষমতার গৃহ থেকে সরতে বাধ্য হচ্ছে। দেশ জুড়ে বিক্ষোভ। তামিলনাড়ুতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন, দিল্লি সহ গো-বলয়ে গো-হত্যা বিরোধী আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য আন্দোলন। হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম— ডিএমকে, দিল্লি সহ গো-বলয়ে গোহত্যা বিরোধী আন্দোলন করছে অখিল ভারতীয় জনসঙ্ঘ, সেই সঙ্গে গো-বলয়ে ‘আংরেজি হটাও’ আন্দোলন চলছে মূলত সোশ্যালিস্টদের নেতৃত্বে। যার প্রধান মুখ ডঃ রামমনোহর লোহিয়া। তাঁর সঙ্গে রাজনারায়ণ প্রমুখ আছেন। লালুপ্রসাদ যাদব, নীতিশকুমার, জর্জ ফার্নান্ডেজ— সবাই লোহিয়াপন্থী। রামমনোহর লোহিয়ার অনুগামী। ইলাহাবাদের হোলি তিন দিনের, মূলত। এর মধ্যেই পুরানা ‘দুশমনির’ হিসাবে-কিতাব নেওয়া হবে। হবেই। পুরানা দুশমনকে হোলির নেওতা— দাওয়াত দেওয়া হল। আর যতই দুশমন হোক, একবার নেওতা বা দাওয়াত দিলে, তখন সেই আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়া মানে সে মর্দ নয়, মেহেরুল— মেহেরা— হিজরা— ডরপোক। ফলে নিমন্ত্রণ গ্রহণ। ঠান্ডাই— ভাঙ, শরাব পান। তারপর ঠাঁয় ঠাঁয় ঠাঁয়— সুযোগ বুঝে। ইলাহাবাদের পুরানা কাটরায় এভাবেই মারা পড়ে— খুন হয় শঙ্কর— শঙ্কর আহির। বছর ছাব্বিশের ডামিশ— বদমাশ— ছাঁটা হুয়া বদমাকা শঙ্করকে ডেলে দেয় বাব্বু। বাব্বু— বাব্বু যাদব, ছুরা-পিস্তল— ছুরি-পিস্তল— সব চলে পরপর। শঙ্কর আহির স্পট ডেড, তারই বিরাদারের মানুষের হাতে। বাব্বু— বব্বু তখন আঠারো কি উনিশ। সেটা ১৯৭১ সালের কথা। কট্টা বা কানট্রি মেড— দিশি পিস্তল দিয়ে নয়, বব্বু— বাব্বু যাদব অটোমেটিক চিনা মাল, বাব্বু চালিয়ে দিল শঙ্কর আহিরের ওপর। ব্যস, শঙ্কর ফিনিশ। একদম ফিনিশ। শঙ্কর খুন হয়ে গেল তারই তাতি— বিরাদারির লোক বব্বু বা বাব্বু যাদবের হাতে। দোল পূর্ণিমার লালচে, ভরা চাঁদের আলোয় শঙ্করের সদ্য কেনা কালো ‘রয়্যাল এনফিল্ড’-এর চাকা ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে, রাস্তার ওপর একদিকে কাত হয়ে পড়ে গিয়ে। ইলাহাবাদের এই ঘটনা— খুন— খুনকা বদলা খুন, মার্ডার— পাল্টা মার্ডার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতি হোলিতেই তা হবে। ইলাহাবাদে প্রেম করা, প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নিয়ে পার্কে বা অন্যত্র কোথাও বসা, সময় কাটানো ছিল অত্যন্ত গর্হিত কর্ম, অন্যথায় ধরা পড়লে প্রেমিক ও প্রেমিকা দুজনেরই হালত খারাপ হয়ে যায়, একদম খান্ডা যাকে বলে। তাদের দুজনকেই ফেলে বেধড়ক ধোলাই। অন্ধাধুন্ধ নির্মম মার, মার, নিষ্ঠুর প্রহার। যাকে বলে গরু পেটানো বা চোরের মার। চোর— তস্করকে যেভাবে মারে। অথচ, ‘উনকো হাম রখখে হ্যায়’। তাকে আমি রক্ষিতা— রাখেল হিসাবে রেখেছি— এই কথা বলার মধ্যে একটা মোহাতান— গোঁফ চুমরনো ব্যাপার আছে। রাখেল— রক্ষিতা রাখা। রাণ্ডিঘর— রাণ্ডি বাড়ি— রাণ্ডোকা ঘর— বেশ্যা বাড়ি যাও। কিন্তু প্রেম নৈব নৈব চ। ধরা পড়লে তোমার অবধারিত মার জুটবে কপালে। এমন প্রহার যে প্রাণ সংশয় হতে পারে। ইলাহাবাদে প্রেম নিষিদ্ধ। কিন্তু বেশ্যাগমন, রক্ষিতা রক্ষণ, ধর্ষণ— সবই মান্যতা পায়, কেবল প্রেম-পেয়ার-মহব্বত ছাড়া। অথচ সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে রোম্যান্টিক, প্রেম-ভিত্তিক হিন্দি সিনেমা। আশ্চর্য বৈপরীত্য।

Powered by Froala Editor