গণ্ডীকাটা— দণ্ডীকাটা— দণ্ডীঘর

হত্যে দেওয়া বা হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা, দণ্ডী কেটে কেটে— বুকের ভরে প্রায় সরীসৃপ হয়েই যেন রাস্তা পেরোনো দেখেছি বহুবার মূলত সনাতনী ধর্মস্থানে। হুগলি জেলার তারকেশ্বরের ‘বাবা তারকনাথ’-এর নামে দণ্ডী কাটা— দুধপুকুর থেকে তারকেশ্বরের মন্দির পর্যন্ত— ‘স্বপ্নাদেশ’ পাওয়ার পর বা আগে সেই ‘দণ্ডীযাত্রা’ বা ‘দণ্ডী কাটা’। ‘দণ্ডী কাটা’ দেখেছি সতী মায়ের মেলায়, দুলাল চাঁদের রাসে, আউলচাঁদ বা আওলচাঁদের নাম করে। এছাড়াও অনেক অনেকবার দণ্ডী কাটা চোখে পড়েছে, লোকাল নানারকম দেবতা, দেবী, জলাশয় বা বৃক্ষ ধরে। কয়েক বছর আগে ঘোর গ্রীষ্মরোদে দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের খানিক আগে ‘ভবানী’ সিনেমার পাশের গলি থেকে দণ্ডী কাটা দুজন মহিলাকে বেরোতে দেখি। তাঁরা রাস্তার ওপর সটান শুয়ে পড়ে দণ্ডী কেটে যাচ্ছেন। সঙ্গে অনেক অনেক আম পাবলিক। ঢাক-ঢোল-কাঁসি। মা-মা-মা-মা রব— চিৎকার। খবর নিয়ে জানলাম তাঁরা তাঁদের মানত পূর্ণ হয়েছে বলে দণ্ডী কেটে কেটে যাবেন কালীঘাটের কালী মন্দিরে। নিজেদের মাথার কাছে শুয়ে পড়া অবস্থাতেই তাঁরা নিজেদের হাত দিয়ে কাল্পনিক দাগ টেনে টেনে উপুড় হওয়া অবস্থায় এগোচ্ছেন। লক্ষ করে দেখেছি বার বার তুলনায় তথাকথিত উচ্চবর্ণের নারীরা দণ্ডী কম কাটেন, মানত পুরো হওয়ার পর। অর্থাৎ মোদ্দা ব্যাপারটা দাঁড়াল তাঁরা— ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থরা দণ্ডী কাটার মানও তুলনায় কম করেন তথাকথিত প্রান্তিক, অন্ত্যজ মানুষের তুলনায়। হাড়ি, বাগদি, দুলে ইত্যাদি প্রভৃতি ‘নোটোর দল’ বা ‘রাজার এঁটো’-রাই অনেক বেশি দণ্ডীময়। দণ্ডী কাটার দলে। খর গ্রীষ্ম, তীব্র গরমের মধ্যে দেখেছি সেই ‘ভবানী’ সিনেমার কাছ থেকে মুদিয়ালি, লেক মার্কেট হয়ে তাঁরা— দুই নারী চলেছেন কালীঘাটের কালী মন্দির ও আদিগঙ্গার উদ্দেশ্যে। একবার স্নান সেরেছেন তাঁরা, ভিজে গা, খোলা— এলো চুল বার বার অসুবিধা তৈরি করছে। কৃষ্ণবর্ণ কপালে বড়ো করে তেল-সিঁদুরের ফোঁটা। দু-চোখ আরক্তিম। আগেই বলেছি, এই যাত্রাপথে প্রবল জোরে ঢাক-ঢোল-কাঁসি বাজছে। সেইসঙ্গে প্রবল উলু উলু রব— উলুধ্বনি। সেই পূর্ববঙ্গীয় ‘জোকার’ বা এই বঙ্গের উলু উলু ধ্বনিতে বুকে কাঁপন ধরে। দেখেছি দণ্ডী কাটা স্তনময়ী নারীরা তাঁদের স্তন ঢাকতে নতুন গামছা বেড়িয়ে রাখেন। বড়ো— দু’হাতি নতুন গামছা, সাধারণভাবে তার রং লাল, টকটকে লাল। এখন একখানা ভালো— সুতির গামছা কখনও কখনও একশো টাকা প্রায়। আমি ভালো গামছা চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সায় দেখেছি। একটা জোড়া— একজোড়া— দুটো গামছা আট আনা—পঞ্চাশ নয়া পয়সা। গামছার দাম ইত্যাদি নিয়ে একটি চমৎকার গল্প শুনেছিলাম ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবাসরীয় দপ্তরে— কবি, সাংবাদিক, স্মৃতিধর— শ্রুতিধর, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির দৌহিত্র বংশ কল্যাণাক্ষ— কল্যানদা— কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গল্পটা এরকম— কল্লোল যুগের কোনো এক নাম করা লেখক তাঁর গল্পে সাতখানা গামছার কথা লিখেছিলেন, একটি বিবরণ দিতে গিয়ে। ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ— নিজেকে— নিজের নাম যিনি ‘হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘষ’ হিসাবে উচ্চারণ করতেন, ‘ঘোষ’ নয়, ‘ঘষ’, তিনি সেই গল্পটি দেখে বললেন, তাঁর সাহিত্য সহকারীর কাছে জানতে চাইলেন, অমুক গল্প লিখে কত টাকা পায়? সহকারী উত্তর দিলেন, আজ্ঞে পাঁচটাকা। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ— হেমেন্দ্রপ্রসাদ ‘ঘষ’ তাঁর থুতনিতে জমানো সাদা— পাকা— পেকে যাওয়া ‘ফ্রেঞ্চ’ অথবা ‘গোটি’ সামান্য চলকে বললেন, পাঁচ টাকার গল্পে সাতখানা গামছা হয় না। সাহিত্য সহকারী তখন জানতে চাইলেন, তাহলে কী করব? 

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল— ওটা কেটে তিনখানা গামছা করে দাও। ‘দৈনিক বসুমতী’-র প্রতিটি ইটের সঙ্গে, কড়িবরগায় জড়ানো, জমানো অনেক অনেক গপ্পো— গপ্পো-গাছা। যেমন একটু হয়তো অশ্লীলই মনে হবে, তবু বলি, সমস্ত সাহিত্য পত্রিকাতেই কবিতা ছাপা হত পাদপূরণ হিসাবে। কোনো উপন্যাস বা গল্প শেষ হলে তার পায়ের নিচে যতটুকু জায়গা ফাঁকা, তা পূরণের জন্যই কবিতা। আলাদা করে তার জন্য কোনো স্পেস ইত্যাদি বরাদ্দ নেই। পাতা— কবিতার আলাদা পাতা তো কল্পনার বাইরে। তো সেই ‘বাবু’-র আমলের ‘বসুমতী’-তে অর্থাৎ অশোক সেনের সময়কার ‘বসুমতী’-তে প্রেস সুপার ভাইজারাও— মাইতি তাঁর পদবি— আমি আর তাঁর নামে যাচ্ছি না, তো তিনি এসে ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটককে বললেন, জায়গা তো খানিকটা ফাঁকা যাচ্ছে। তা নিয়ে আমি ভাবছি না। মহাশ্বেতার পোঁদের ভেতর প্রেমেন্দ্র মিত্রকে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। ‘বসুমতী’-র প্রেস সুপারভাইজারের এই কথা শুনে প্রাণতোষ ঘটক তো থ। তিনি কী বলবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। বিষয়টা এরকম— মহাশ্বেতা দেবী— তিনি তখন মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য নামে লেখেন, তো সেই মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যের উপন্যাস শেষ হওয়ার পর, সেখানে প্রেমেন্দ্র মিত্রর কবিতাটি দিয়ে দেওয়া হল বা ‘গুঁজে দেওয়া হল’— এই হচ্ছে মূল ব্যাপার। কবিতা এরকমই হেলাচ্ছেদ্দা— হেলাফেলার জিনিস ছিল তিন, চার, পাঁচ, ছয়ের দশকে— তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাটের দশকেও। কবিতা তখন নেহাৎই বোঝার ওপর শাকের আঁটি। এমনকি প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, অরুণকুমার, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত— এঁরা সবাই গদ্যের পাদটীকা, পাদপূরণ। জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতাও তাই— উপন্যাস বা গল্পের শেষে সাদা স্পেস ভরানোর উপাদান। বাঙালির প্রেমে পড়া, কবিতা লেখা, বাম রাজনীতি— র্যাডিক্যাল রাজনীতি করে— সবই ষোলো থেকে ছাব্বিশ বছর আয়ুষ্কালের ভেতর। কিন্তু কবিতা লেখা, কবিতা নির্মাণ বিষয়ে বাঙালি সেভাবে সশ্রদ্ধ হল কবে থেকে? নেহাৎ রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন, নাহলে কী যে দশা হত তাঁর কবিতার! কাব্যটাব্য করে কবিতা-টবিতা লেখে— এসবই ছিল, এখনও খানিকটা আছে, বাঙালির উন্নাসিকতায়, কবিতা বিষয়ক মন্তব্যে। থাক সে সব কথা। আমরা আপাতত দণ্ডী কাটায় ফিরি। দণ্ডী কাটাকে কেউ কেউ ‘গণ্ডী কাটা’-ও বলে থাকেন। খুব কমই অবশ্য ব্যবহৃত হয় ‘গণ্ডী কাটা’। ‘গণ্ডী কাটা’ বলতে তো সেই নিষেধের গণ্ডী— রামায়ণ কথা অনুসারে রামচন্দ্র যে গণ্ডী জেটে গিয়েছিলেন স্বর্ণমৃগ ধরা— শিকার করার জন্য। রামায়ণের কাহিনি অনুসারে লঙ্কার রাক্ষসরাজ— লঙ্কেশ— লঙ্কাধিপতি রাবণের প্রতিনিধি মারীচ। মারীচ মায়াবী রাক্ষস। যে-কোনো সময় যে-কোনো রূপ সে ধরতে পারে। সীতাহরণ চক্রান্তে তার সোনার হরিণ— স্বর্ণমৃগ সেজে ওঠা। সীতা জনকদুহিয়া— জানকীর আবদারে রামচন্দ্র চলল স্বর্ণমৃগ পাকড়াতে। রেখে গেল তার লক্ষ্মণ ভাইকে। রামের এই যে গণ্ডী কেটে দিয়ে যাওয়া, তা এক অতি পুরাতন সংস্কার ভারতীয় জীবনে। গণ্ডী যেন কোনো রক্ষাকর্তা। গণ্ডীর বাইরে যাওয়া যাবে না কোনোভাবেই, কোনোরকম প্ররোচনাতেই। কিন্তু সন্ন্যাসীবেশী রাবণকে অস্বীকার করতে পারল না সীতা, ফলে যা হওয়ার তাই তো হল। যে কাহিনি তো বিস্তারে আছে রামায়ণে। আমি তা নিয়ে আর নতুন কোনো বিবরণে যাচ্ছি না। গণ্ডী ব্যাপারটা আমাদের জীবনে যেমন আছে, তেমনই ‘দণ্ডী’ ব্যাপারটাও রয়ে গেছে অন্যভাবে। হিন্দু বাঙালি জীবনে ব্রাহ্মণ পরিবারে উপনয়ন হয়। পৈতের ঘরে থাকতে গেলে তখন বিল্বকাষ্ঠ— বেল কাঠের দণ্ডী লাগে। বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের পৈতের ঘর— গণ্ডীঘরে থাকতে হয় তিন দিন। চারদিনের দিন নিয়মভঙ্গ। পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে এগারো দিন দণ্ডীঘরে। তেরো দিনের দিন মৎস্যমুখী— নিয়মভঙ্গ— রাজবেশ। দণ্ডী ভাঙতে হয় এগারো দিনের পর গঙ্গাতীরে, অন্য নদী বা জলাশয়ের ধারে। এই তিন দিন বা এগারো দিন সূর্য ও শূদ্রের মুখ দেখা নিষেধ। বৈদ্যশ্রেণীর জনেরাও থাকেন পৈতের পর দণ্ডী ঘরে— তিন দিন। গুপ্ত, সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, দাশ, সেন। সেন অবশ্য অন্য অন্য বর্ণেরও হন। সেনশর্মা, দাশশর্মা— তাঁরাও বৈদ্যশ্রেণীর। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পদবি লাহিড়ী, ভাদুড়ী, মৈত্র, বাগচি, সান্যাল, খাঁ, ঢোল। কখনও কখনও ভট্টাচার্য। বরেন্দ্রভূমির বাসিন্দা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরা রাজশাহি, পাবনায় ছিলেন প্রধাণত, যুক্তবঙ্গে। বৈদ্য ও বারেন্দ্রজনেরা অসম্ভব প্রতিভাধর, বহুক্ষেত্রেই। দণ্ডী নির্মিত হয় বাঁশের পোক্ত সরু কঞ্চিতে, দণ্ডী তৈরি হয় বেলকাঠে। একটি প্রচলিত ছড়া বা ছিকুলি আছে এই পৈতের ঘরের— ব্রহ্মচারীদের বিষয়ে। প্রচলিত ছড়া বা ছিকুলিটি এরকম—

‘ব্রহ্মচারী দণ্ডীধারী
দণ্ডী দিয়ে কুত্তা মারি
কুত্তা করে ঘেউ ঘেউ
ব্রহ্মচারী উঠে দৌড়…’

এই ছড়া বা ছিকুলিটির অন্যতর কথন হল—

‘ব্রহ্মচারী দণ্ডীধারী
দণ্ডী দিয়ে কুকুর মারি
কুকুর বলে ঘেউ ঘেউ
ব্রহ্মচারী উঠে দৌড়…’

দণ্ডীঘরে কঠোর— অতি কঠোর নিয়ম-নিষ্ঠা— পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের জন্য। সূর্য ও শূদ্রের মুখ দর্শন করা নিষেধ, সে তো আগেই লিখেছি। কোনোরকম মিষ্টদ্রব্য, লবণ— সব বারণ। কেউ কেউ অবশ্য লবণের— নুনের বদলে সৈন্ধব লবণ বা করব লবণ খেয়ে থাকেন। শুধু আতপ চালের ভাত, তাতে কাঁচকলা সেদ্ধ, আলু নেই, অন্য কোনো তরকারি নেই। সঙ্গে গব্য ঘৃত। গাওয়া ঘি। মুগের ডালা। মুগ ডাল ভেজানো খাওয়া, চিনি-গুড় ছাড়াই। ভূমিতে কম্বল পেতে শয়ন। কানের লতি ফুটো করা হয়েছে, বেল কাঁটায়— বেল গাছের কাঁটা দিয়ে। নরসুন্দর— নাপিতভাই কানটি ছিদ্র করেছেন। ফুটো করেছেন কানের লতিতে। অনেকে সেই ফুটোয় ‘বালি’ ভরতেন, সোনার। সাধারণত সুতো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়— ঠিকভাবে বললে হত এই কর্ণলতির ছিদ্রে। কেউ কেউ রুপোর বালি— সরু গোল কর্ণভূষণ পরেন। বেলকাঁটার ব্যবহার উঠে গিয়ে পরবর্তী সময়ে ছুঁচ-সুতো দিনে কান ফুটো করা বা কান বেঁধানোর ব্যাপারটা হত। খুব ব্যথা, যন্ত্রণা, পেকে ওঠা, পুঁজ। মেয়েরা যেমন কান ফোটায় বা কান বেঁধায়, সেভাবেই অনেকটা যেন, তবে মেয়েরা সাধারণভাবে কানের লতি কর্ণভরণ বা দুল পরার জন্য ফুটো করালে সেই কাঁচা ছিদ্রর ভেতর নিম কাঠি— অতি সরু নিমকাঠি গুঁজে দেওয়া হত, তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকিয়ে গিয়ে নর্মাল— স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। পৈতের ঘরে ঢোকার আগে মস্তকচুম্বক— মাথা ন্যাড়া করার সঙ্গে সঙ্গে কানও ফোটানো হত বা ফোঁড়া হত। এক কান ফুটো করার পর সেখানেও সুতো নয়তো বেলের সরু কাঠি দেওয়া হত। পরবর্তী সময়ে নিয়মনিষ্ঠা— নিষ্ঠা কাষ্ঠা অনেক শিথিল হয়। তখন বহুক্ষেত্রেই কান ফোটানো বা ফোঁড়ানোর পরিবর্তে কানের লতিতে ছুঁচ ছুঁইয়ে দেওয়া হত। বা এখনও হয়। আর মেয়েরা তো কানের লতিতে ফুটো করার— করানোর জন্য বাড়ির বড়োদের— মা-কাকিমা-জ্যেঠিমাদের ওপর নির্ভর করে না, সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তন বহু বছরই— হ্যাঁ, তা হবে প্রায় পাঁচ দশক। বাঙালি যৌথ পরিবারগুলিকে খোলামকুচি করে দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন অণু পরিবার সব। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। যেমন হয়ে থাকে আর কি। পৈতে হয়ে যাওয়ার পর ন্যাড়া মাথায় দ্রুত— অতিদ্রুত জেগে ওঠা আলপিন সদৃশ খোঁচা খোঁচা চুলে মাথায় ঘোমটা দেওয়ার গেরুয়া বস্ত্রটুকু বেঁধে গিয়ে অসুবিধা তৈরি করে নবীন ব্রহ্মচারীর। এছাড়াও কানে যদি দুল বা সোনার বালি থাকে, তাহলে তার আঁকড়াতেও গেরুয়া বস্ত্র বেঁধে গিয়ে অসম্ভব জোড়ে টান পড়ে কানে— কানের লতিতে ও যন্ত্রণা, বেদনা, ব্যথা তৈরি হয়। রীতিমতো জল বেরিয়ে আসে চোখ দিয়ে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি এই সব কথা। সাধারণভাবে একটু সম্পন্ন পরিবারে দু’সেট গেরুয়া দেওয়া হয় নবীন ব্রহ্মচারীকে। কারণ বর্ষাকাল হলে গেরুয়া কাপড় শুকোতে দেরি হয়, তখন এক বড়ো সমস্যা, রীতিমতো সমস্যা যাকে বলে। দণ্ডী ঘরে থাকা দুটি গেরুয়া কাপড় ও চাদর পরে ব্যবহার করা যায় বা ব্যবহার করা হয়। সেই কবে কোন বালকবেলায় ধুতি পরা পছন্দ করেছি, শিখেছি ও একটু একটু করে, হাতেখড়িতে ধুতি পরা, সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়ার সময় ধুতি পরা, সে আবার বাসন্তী রঙের ধুতি। ১৯৫৫-৫৬-৫৭ সালে দু টাকায় ছ’হাতি ধুতি পাওয়া যায়। আট হাতি খাপি ধুতির দাম আর একটু বেশি। এগারো হাত ধুতি পরতেন প্রাপ্তবয়স্করা। ছ’হাতি, আট হাতি, দশ হাতি, এগারো হাতি— এমন হত ধুতির মাপ। শাড়িও তাই। এখন সম্ভবত আট হাতি, দশ হাতি ধুতি পাওয়া যায় না। তবে সরস্বতী পুজোর সময় বাসন্তী রঙের ধুতি, শাড়ি মেলে দোকানে। আমাদের ধুতি মা রং করে দিতেন রঞ্জক সাবানে। রঞ্জক সাবান পাওয়া যেত মুদির দোকানে। চার আনার তার দাম। মুখে মুখে চার আনা মানে চার গণ্ডা পয়সা। এক গণ্ডা পয়সা মানে চৌষট্টি পয়সার এক টাকার হিসাবে এক আনা। একশো নয়া পয়সায় টাকার হিসাবে চার আনা মানে পঁচিশ নয়া পয়সা। ষোলো আনায় তখন একটাকা। ম্যাট্রিক পদ্ধতির হিসাব ধরে একশো নয়া পয়সায় টাকা আসার আগে এই হিসাবই তো চলত। পাঁচ, ছয়, সাত, আটের দশকেও বাড়িতেই কান ফোটানো বা কান ফোঁড়ানো হত মেয়েদের, আগেই লিখেছি। এখন সবই বিউটি পার্লারে— কান ফোঁড়ানো— ফোটানো, নাক ফোঁড়ানো— সবই বিউটি পার্লার। আজ থেকে বছর কুড়ি বা তিরিশ আগে উপনয়নের সময় কান ফোঁড়ানোর বদলে কানের লতিতে ছুঁচ— সোনামুখী-পাখি ছুঁচ ছুঁইয়ে দেওয়ার একটা রীতি-রেওয়াজ চালু হয়েছে। এখনও হয়তো তা-ই চালু আছে। এই ছুঁচ ছোঁয়ানো বাবদ মূল্যে ধরে দিতে হয় নরসুন্দরকে। যেমন শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে মূল্য ধরে দেওয়া হয় বামুনকে।

Powered by Froala Editor